অতএব এক সন্ধ্যার ঘণান্ধকারে মিনতি কাকিমা কুয়োতলায় স্টোনম্যানকে মাথার ওপর পাথড়ের চাঁই তুলে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে আসতে দেখে দাঁত কপাটি লেগে চিৎপাত হয়ে পড়লেন। নানা সাজে অভিজ্ঞ সুকান্ত বলাকার মেকআপ বক্সটি ভালোই ইস্তেমাল করেছিল। অতএব যারা ওকে গাছপালার আড়ালে মিলিয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে একঝলক দেখেছে, তাদের বর্ণনা শুনেই বাকিদের মাথা ঘুরে যেত। অতঃপর ভয় দেখানো চলতে থাকে।
৭.
পালবাবু প্রাচীন কম্পাউন্ডার, চা-বাগান এবং কুলি লাইনে বেজায় পসার। ওঁর কাছে রুগি গেলে নাকি আর ফেরে না। সকাল-বিকেল ভিড়ের ঠেলায় দেখা পাওয়াই দায়, হাটবারে তো কথাই নেই। রোজগারও প্রচুর। একদিন গয়েরকাটা থেকে বাগানের ভিতর দিয়ে শর্টকাট মারার সময় একটি পাকা আম পড়বি তো পড় ওঁর মাথাতেই ঢিপ করে খসেছে। আর যায় কোথায়! পাঁচ মাইল পথ তিন লাফে পেরিয়ে চৌপাত্তিতে খোট্টার দোকানের সামনে সোজা ফ্ল্যাট। তারপর ‘জল আন’, ‘বাতাস কর’, ‘খবদ্দার ওর দোকানের ওষুধ দিবি না, তাহলে আর বাঁচবে না’ ইত্যাদি গোলমালে এলাকা গুলজার!
আসলে ক’দিন যাবৎ মিনতি কাকিমা এবং দাসবাবুকে স্টোনম্যান ছায়ার মতো ফলো করায় এলাকা জুড়ে মৃত্যুভয় বেশ জাঁকিয়েই বসেছিল। তার ওপর টিপুর মতো কিছু বেয়াদব বাচ্চার কল্যাণে প্রত্যেকেরই মনে হতে থাকে যে, সে-ই অদৃশ্য ঘাতকের একমাত্র টার্গেট। টিপুর আসল নাম মনে নেই আর, তবে গুলতি চালনায় ওর অকল্পনীয় পারদর্শিতার ফলে ক্লাস সিক্স থেকেই এলাকায় ‘টিপু শয়তান’ নামে খ্যাতি লাভ করে। ভয়ের আবহ কাজে লাগিয়ে সে ওই বয়সেই যাদের ওপর জাতক্রোধ, তাদের ওপর প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছিল। অবলা পথচারীদের সন্ধের মুখে একা দেখলেই পিছন থেকে, ‘ওরে বাবারে মেরে ফেললে রে’ ইত্যাদি আর্তনাদ শুরু করত। দুই পায়েই জড়িয়ে থাকা ধুতি, একপায়ে ছেঁড়া হাওয়াই চটি, বহুকালের পুরনো বাত, শ্বাসকষ্টের কারণে খাট থেকে অপরের সাহায্য ব্যতীত উঠতে না পারা ইত্যাদি প্রতিবন্ধকতা মৃত্যুভয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য মানুষ কত সহজে জয় করতে পারে, তা আমরা সে সময় দেখেছি। অনেক সময় পাশ দিয়ে ‘আসছে, আসছে’ বলে দৌড়ে পালানোর অভিনয় করলেও একই প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়েছে– টিপু বহু লোকের ওপর জমা রাগ সিরিফ দৌড় করিয়ে মিটিয়েছে।
আসলে প্রতিশোধেরই গল্প এটা। অমিতাভ বচ্চন হওয়ার বাসনা বুকে আগলে রাখা কমলের অভিনয় জীবনে সবচেয়ে বড় বিপর্যয় রূপে মিনতি কাকিমা অবতীর্ণ হন, এবং পার্টির কালচারাল উইং থেকে যে ক’টি নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল, তার প্রত্যেকটিতে উনি বেচারিকে কান পাকড়ে ফিমেল রোলে নামান– ভাইঝির গোলাপি ফ্রক জোর করে পরিয়ে, ‘তরে দারুণ মানাইব’ বলার পর আর কোনও তর্কের জায়গা থাকে না। এর ফলে স্কুলেও বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত সাংস্কৃতিক মিলনমেলায় ওকে কুন্তী সাজতে হয়– ক্লাস টেনের ছেলের পক্ষে তা ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’, এবং সেবার মহাভারত অভিনীত হবে বলেই কলকাতা থেকে সাজ এসেছিল। কৌরব পাণ্ডবদের ড্রেস, তরোয়াল, তীর ধনুক দেখে বেচারার সে কী দীর্ঘশ্বাস ফেলা, সে যদি তোমরা দেখতে। ফোঁস ফোঁস করে আর বলে, ‘কত করে বললাম কুন্তীর রোলটা কেটে বাদ দিতে– অন্তত রণক্লান্ত সৈনিক সাজতে দিলেও…।’ পরের বছর ওকে রাবণের পার্ট থেকে নির্মম ভাবে ছেঁটে কৈকেয়ী অথবা মুখোশ পরে সুগ্রীবের তৃতীয় অনুচর সাজার অফার ধরানো ছাড়াও ‘নটি বিনোদিনী’-তে রাসমণি সাজানো হয়। কমল এর পর ‘বীরপাড়া সাংস্কৃতিক মঞ্চ’ বা ওইরকম কোনও একটি দলে যোগ দিয়ে এলাকার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিলেও মিনতি কাকিমাকে ভোলেনি। যে লোকটা সুকান্ত সেজেছিল, সেও না।
অতএব, হাটে দেখা হওয়ার পর দু’জনে দ্রুত বলাকা নাট্যসমিতির সাজঘরটিকে নিজেদের স্থায়ী ডেরা বানিয়ে ফেলে। বুকের অন্তস্থলে লেলিহান প্রতিশোধ স্পৃহা ‘বহ্নীমান’ না ‘প্রজ্জ্বলিত’ কী যেন বলে, সেরকম জ্বললে পুরনো একটি ডিসকার্ডেড গন্ধমাদন পর্বতকে সারিয়ে সুরিয়ে বড় পাথড়ের আদল দেওয়া কোনও ব্যাপারই নয়। তাছাড়া যে সময়ের কথা বলছি, সে সময় ক্যান্টনমেন্ট এলাকা বাদে রাস্তাঘাটে বিজলির আলো প্রায় ছিলই না, চা বাগান সংলগ্ন জনবসতিগুলোর কথা বাদই দিলাম।
অতএব এক সন্ধ্যার ঘণান্ধকারে মিনতি কাকিমা কুয়োতলায় স্টোনম্যানকে মাথার ওপর পাথড়ের চাঁই তুলে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে আসতে দেখে দাঁত কপাটি লেগে চিৎপাত হয়ে পড়লেন। নানা সাজে অভিজ্ঞ সুকান্ত বলাকার মেকআপ বক্সটি ভালোই ইস্তেমাল করেছিল। অতএব যারা ওকে গাছপালার আড়ালে মিলিয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে একঝলক দেখেছে, তাদের বর্ণনা শুনেই বাকিদের মাথা ঘুরে যেত। অতঃপর ভয় দেখানো চলতে থাকে। কখনও রান্নাঘরের জানালা দিয়ে উঁকি মেরে হিংস্র গোঁ গোঁ আওয়াজ ছেড়ে, বা দিন দুয়েক অন্তর পাশে বিমল জেঠুদের বাড়ির কার্নিশ থেকে ‘ছাতু করে দেব, পিষে মেরে দেব’ ইত্যাদি হুংকার দিয়ে ওরা এমন অবস্থা তৈরি করেছিল যে, মিনতি কাকিমা দোতলার একটি ঘরে দোর এঁটে খিল দিলেন। ঘরটা এমনিতেই বিপ্লবের পর প্রতিক্রিয়াশীল শ্বেত দস্যুদের ইন্টারোগেশনের জন্য পুরনো হারমোনিয়াম, তানপুরা, তবলা ইত্যদিতে পরিপূর্ণ ছিল, অতএব বাড়ির লোকেদের এই ব্যবস্থায় কোনও অসুবিধেই হয়নি।
ওরা দাসবাবুকে কোনও কারণ ছাড়াই ভয় দেখাত। শেষদিকে সুকান্ত একজন পরিণত এবং এক্সপার্ট স্টোনম্যান। অভিনয় ব্যাপারটা ওর ন্যাচেরালি আসে ইত্যাদি আত্মোপলব্ধির পর থিয়েটার দলে যোগ দেওয়া তো বটেই, পরবর্তীকালে এমনকী সিনেমায় নামার সুখস্বপ্নও দেখত। এমতাবস্থায় উৎসাহের আধিক্যে বাড়াবাড়ি অস্বাভাবিক নয়। দাসবাবুকে রাস্তায় ফেলে বুকের ওপর পা তুলে ‘বল নরাধম, এই কী রে তোর কর্তব্য পালন… বল কোথায় বাঘ মারা দোনালা বন্দুক, নইলে দিলাম ছেঁচে’ ইত্যাদি ভয়ানক ব্যাপার প্রায়ই ঘটতে থাকে। এতে এলাকাবাসী যতখানি আতঙ্কিত হয়েছিল, টিপুর ক্ষুদ্র এবং শয়তানি বুদ্ধিতে ভরপুর মাথা ততখানি নয়। ওর গোড়া থেকেই মনে হয়েছিল কোথাও একটা গোলমাল হচ্ছে।
শোনা যায়, এই দুই কীর্তিমান পুরুষ ভয় দেখানোর পর কোনও এক নিরিবিলি জায়গায় বেশভূষা ছেড়ে, মুখের রং তুলে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে হাসত। কমল ছিল নজর রাখার দায়িত্বে, এবং অভিনয় প্রতিভার বিকাশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যেহেতু সুকান্তর সাহসও বাড়ছিল, তাই ওকে খানিকটা সামলানোর দায়ও নিতে হত। স্বাভাবিক কারণেই কমলের মনে হয় যে, আতঙ্ক একটি পরিবারে সীমিত রাখলে অদূর ভবিষ্যতে এলাকাবাসীর মনে সন্দেহ জাগতে বাধ্য। অতঃপর ওরা পরিধি বিস্তৃতিতে মন দিল। দু’জনে যেদিন নেপালবাবুদের পোড়ো কালীমন্দিরের চাতালে বসে পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনায় মগ্ন, ঠিক সেই সময়ে ওই মন্দিরের খোঁদোল থেকেই বেজির ছানা ধরতে এসে টিপু দুই মূর্তিমানকে দেখে ফেলে। ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাওয়ায় লুকিয়ে কাছাকাছি পৌঁছয়, এবং পুরো ব্যাপারটা শোনে। তারপর গটগট করে অন্তরাল ছেড়ে বেরিয়ে এসে বলে, ‘আমাকে তোমরা দলে না নিলে সবাইকে সব কথা বলে দেব।’