বাগবাজারে গিরিশবাবুর বাড়ি প্রথম দেখি যখন, নাটক দেখার বয়স হয়নি। ভেবেছিলাম শুধু মদ খেয়ে যদি রাস্তার মাঝখানে এত বড় বাড়ি বানানো যায়, তাহলে বড় হয়ে সেই কর্মই করা উচিত।
আমাদের বাড়িতে মদ খাওয়ার চল ছিল না। মদ এবং মাতাল– এই দুই শব্দেই ভনভনিয়ে মাছি আসত দালানে। হালকা মেজাজের আড্ডায় কোনও পাঁড় মাতালের কথা উঠলেই মা বলতেন, ‘আরে ওর কথা ছাড়। ও তো সন্ধে থেকেই গিরিশ ঘোষ।’ সমসাময়িক কোন নাট্যকার বা অভিনেতা সম্পর্কে তাত্ত্বিক আলোচনায় গিরিশ ঘোষের তুলনা টানতে শুনিনি কখনও। উত্তর কলকাতায়, আমার পাড়ায়, কয়েকজন গিরীশবাবু ছিলেন। আমাদের বাড়ির মূল দরজার বাইরে যে ছোট্ট রোয়াক ছিল, যার পাশে লো-ভোল্টেজ বাল্ব জ্বলা ঢ্যাঙা ল্যাম্পপোস্ট, সেখানে দাঁড়িয়ে আমি এক নম্বর গিরিশবাবুকে দেখতাম। রাত আটটা নাগাদ আমাদের তস্য গলির মুখে তিনি আবির্ভূত হতেন সিল্কের পাঞ্জাবি আর কোঁচকানো ধুতি পরে। যে কোনও মুহূর্তে উল্টে পড়ে যেতে পারেন, অথচ একটা আনস্টেবল ইকুইলিব্রিয়াম বজায় রেখে তিনি আমাদের গলি টপকে নিজের রাস্তায়, প্রায় হাফ কিলোমিটার হেঁটে, বাড়ির দরজায় কড়া নাড়তেন। মাঝে মাঝে আমার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হাত তুলতেন, তখন ব্যালান্স একটু ঘেঁটে যেত। একটু বড় হয়ে যখন লোহাপট্টির মুখ অবধি আসতে সাহস পেয়েছি, তখন হাতে টানা রিকশায় গিরিশ ঘোষ নাম্বার টু-কে দেখি। তিনি একটু ময়লা কাপড়ে, আদ্যির ধুতি-পাঞ্জাবি। সিটে কাত হয়ে বসা। দু’দিকের হাতল ধরে, পা ছড়িয়ে জমিদারি মেজাজে দেশোদ্ধার করে চলেছেন। ঠোঁটের কোণে সিগারেট জ্বলছে। এখন মনে হয় রিকশাওয়ালাও বোধহয় তাঁর নাটকে আচ্ছন্ন থাকতেন। না হলে দমকলের মতো অবিরাম ঘণ্টি বাজিয়ে, হাসতে হাসতে খালি পায়ে কবল স্টোনের রাস্তা উপেক্ষা করে উড়ে যেতেন কী করে! বাগবাজারে গিরিশবাবুর বাড়ি প্রথম দেখি যখন, নাটক দেখার বয়স হয়নি। ভেবেছিলাম শুধু মদ খেয়ে যদি রাস্তার মাঝখানে এত বড় বাড়ি বানানো যায়, তাহলে বড় হয়ে সেই কর্মই করা উচিত। টালিগঞ্জে নিজের জ্যাঠাকে দেখে আবার উল্টো বুঝলাম। দুঁদে উকিল, বিরাট পসার। প্রাসাদোপম বাড়ি, তিনতলা। বৈঠকখানায় বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে ফরাসের ওপর বসে আছেন, তাসের আড্ডা চলছে। জ্যাঠার সামনে একটা লম্বা কালো কাচের বোতল, সামনে গেলাস। তাতে চিরতার জলের রঙের পানীয়। পরে জেনেছিলাম ওর নাম ‘বিয়ার’। ইতিউতি চার-পাঁচটা অন্য বোতলও ছিল। উনি আমাকে দেখেও দেখতে পেলেন না। দোতলায় উঠে গেলাম। এর কয়েক বছরের মধ্যেই জ্যাঠাইমা গত হলেন, জ্যাঠা বাড়ি বিক্রি করে আরও দক্ষিণে মেয়ের বাড়িতে চলে গেলেন। আমরা সপরিবার দেখা করতে গেলাম। একটা ছোট্ট ঘরে টিমটিমে আলো জ্বালিয়ে উনি বসেছিলেন, একা। বোতল থেকে বিয়ার ঢালার চেষ্টা করছেন, কিন্তু হাত কাঁপছে বলে চলকে মেঝেতে পড়ে যাচ্ছে। হাত তুলে আমায় ডাকলেন, গেলাম না। এই প্রথম গিরিশ ঘোষ-কে দেখে ভয় পেলাম।
তবু বিয়ার দিয়েই শুরু হল মদিরাবরণ উৎসব। বোধহয় সতেরো-আঠারো। শনিবার, সন্ধে হব হব। কলেজ ফাঁকা। অভিজিৎ আর আমি উল্টোদিকের দোকানে গিয়েছিলাম নিরীহ কোল্ড ড্রিঙ্ক পান করতে। অভিজিতের বাজপাখির চোখ ঠিক দেখে নিয়েছে তাকের কোণে লুকনো ইম্পোর্টেড বিয়ারের ক্যান। সে আবদার করে। দোকানদার দাদাস্থানীয়। মুখে আঙুল দিয়ে চুপ থাকার ইশারা করেন। খবরের কাগজে মোড়া ক্যান আমাদের হস্তগত হয়। অবশ্যই ধারে কেনা। কলেজের বাথরুমে গিয়ে দেখি ভেসে যাচ্ছে দুয়ার-দালান। আর তেমনই গন্ধ অ্যামোনিয়ার। বোধহয় পাইপ ফেটেছে। ছোট বাইরে করার পোজে দু’জনে পাশাপাশি দাঁড়াই, তারপর আধাআধি করে নিই উষ্ণ তরল, যার ক্যানের গায়ে লেখা– ‘সার্ভ চিল্ড’। কী আশ্চর্য, তাতেও ঠান্ডা স্রোত নামে গলা দিয়ে, ঢেকুর ওঠে। প্রথম আলকোহলি ঢেকুর।
পুত্র, স্ত্রী ও আমি একসঙ্গে বসে মদ খাওয়ার প্ল্যান করি যখন ছেলের বয়স কুড়ির কাছাকাছি। হিমাচলে বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান। ওখানকার আইন মোতাবেক ওই বয়সে মদ্যপানের অধিকার আছে। লকডাউন হয়ে গেল। যাত্রা বাতিল। এরপর ছেলের একুশ পূর্তিতে দিল্লি। রেস্তোরাঁয় বিয়ার অর্ডার দিচ্ছি, ছেলে বলল খাবে না। কারণ ওখানে তখনও পঁচিশ বছর। অগত্যা ডিসেম্বেরের ছুটিতে কলকাতায়, বাড়িতে। গিরিশ ঘোষের শহরেই উদ্যাপন। নীল বোতল থেকে স্বচ্ছ মদ নেমে এল তিনটি কাঁচের পাত্রে। মনে পড়ল, ছোটবেলায় বাবাকে দেখিছি আলো ফোটার আগেই চা বানাতে। জল ফোটার শব্দে আমার ঘুম ভাঙত। অনেকবার ভেবেছি উঠে গিয়ে ওঁর পাশে বসে এক কাপ চাই। সাহস হয়নি। উনিও ডাকেননি।