লঙ্কার রাজা রাবণের খুব ইচ্ছে, শিবকে কৈলাস থেকে লঙ্কায় এনে প্রতিষ্ঠা করেন। অনেক সাধ্যসাধনা করেও শিবকে রাজি করানো গেল না। শেষে শিব রাবণকে দিলেন তাঁর দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের একখানি। গুজরাতের সোমনাথ, গুজরাতেরই জামনগরে নাগেশ্বর, তামিলনাড়ুতে রামেশ্বর, অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীশৈল পর্বতে মল্লিকার্জুন, মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়নীতে মহাকাল, মধ্যপ্রদেশেই মান্ধাতা পর্বতে ওঁকারেশ্বর, কেদারনাথ, মহারাষ্ট্রের পুণেতে ভীমাশঙ্কর, বেনারসে বিশ্বনাথ, ঝাড়খণ্ডে বৈদ্যনাথ, নাসিকে ত্রম্বকেশ্বর, মহারাষ্ট্রে ঘৃষ্ণেশ্বর– এই ১২টি শিবলিঙ্গকে জ্যোতির্লিঙ্গ বলা হয়।
১১.
একবার হল কি ব্রহ্মা আর বিষ্ণুর মধ্যে ঘোর ঝগড়া– দু’জনেই প্রমাণ করতে ব্যস্ত যে তিনিই বড়, তিনিই শ্রেষ্ঠ। বাকবিতণ্ডা ক্রমে তীব্রতর হচ্ছে, একে অপরের দিকে আক্রমণে উদ্যত, এমতাবস্থায় তাঁদের পৃথক করতে দু’জনের মাঝে সৃষ্টি হল এক অন্তরালের। জ্যোতির্ময় সেই অন্তরাল, উভয়ের দ্বন্দ্ব মেটাতে মহাদেব আবির্ভূত হলেন লিঙ্গশরীর ধারণ করে। সেই থেকেই জ্যোতির্লিঙ্গের উদ্ভব।
ভারতে এমন ১২টি জ্যোতির্লিঙ্গের কথা জানা যায়। তার মধ্যে একটি অবস্থান অধুনা ঝাড়খণ্ডের বৈদ্যনাথ ধাম বা দেওঘরে। ওদিকে আবার বিষ্ণুচক্রে ছিন্ন ভিন্ন সতীর দেহ থেকে হৃদয়খানি পড়েছিল এই বৈদ্যনাথ ধামে। সতীপীঠ হয়েও বৈদ্যনাথধাম কিন্তু বিখ্যাত হল শৈবতীর্থরূপে। আদিতে সতীপীঠ হয়েও কাশীধাম যেমন বিশ্বনাথের নামেই প্রসিদ্ধ তেমনই বৈদ্যনাথধামের তাবত খ্যাতির মূলে শিব। তার মূলে আছে এক চমকপ্রদ গল্প।
লঙ্কার রাজা রাবণের খুব ইচ্ছে, শিবকে কৈলাস থেকে লঙ্কায় এনে প্রতিষ্ঠা করেন। অনেক সাধ্যসাধনা করেও শিবকে রাজি করানো গেল না। শেষে শিব রাবণকে দিলেন তাঁর দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের একখানি। গুজরাতের সোমনাথ, গুজরাতেরই জামনগরে নাগেশ্বর, তামিলনাড়ুতে রামেশ্বর, অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীশৈল পর্বতে মল্লিকার্জুন, মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়নীতে মহাকাল, মধ্যপ্রদেশেই মান্ধাতা পর্বতে ওঁকারেশ্বর, কেদারনাথ, মহারাষ্ট্রের পুণেতে ভীমাশঙ্কর, বেনারসে বিশ্বনাথ, ঝাড়খণ্ডে বৈদ্যনাথ, নাসিকে ত্রম্বকেশ্বর, মহারাষ্ট্রে ঘৃষ্ণেশ্বর– এই ১২টি শিবলিঙ্গকে জ্যোতির্লিঙ্গ বলা হয়। ওইসব লিঙ্গ দর্শন করে আদি শঙ্করাচার্যের বিশেষ আধ্যাত্মিক অনুভূতি ও উপলব্ধির কারণেই তিনি সেগুলিকে জ্যোতির্লিঙ্গ রূপে আখ্যায়িত করেন।
তা সে যাই হোক, রাবণ তো ঘাড়ে করে সেই জ্যোতির্লিঙ্গখানি নিয়ে চললেন। শিব শর্ত দিলেন, পথে কোথাও শিবলিঙ্গকে ভূমিতে রাখা যাবে না, শিব যদি মাটিতে বসেন তো সেখানেই থিতু হয়ে থাকবেন, আর নড়বেন না। লম্বা লম্বা পা ফেলে রাবণ চললেন লঙ্কার পথে, দেবতারা পড়লেন ঘোর চিন্তায়। একবার যদি রাবণ শিবকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে পারেন তবে তিনি হবেন অজেয়। কিন্তু ওদিকে রাম যে রাবণকে মেরে সীতাকে উদ্ধার করবেন, সে তো রাম জন্মের আগে থেকেই স্থির হয়ে আছে, তার কী হবে! শেষে কৌশল স্থির হল, জলের দেবতা বরুণ রাবণের পেটে ঢুকে বসবেন। রাবণ যখন ঠিক সতীপীঠের কাছে এসে গিয়েছেন তখনই প্রস্রাবের তীব্র বেগ চেপে বসল। রাবণ আর পারছেন না, এমন সময় এক ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে বিষ্ণু এসে দাঁড়ালেন তাঁর সামনে। রাবণ তাঁর হাতে শিবকে দিয়ে গেলেন আড়ালে জলত্যাগ করতে। আর সেই সুযোগে বিষ্ণু শিবকে মাটিতে নামিয়ে রাখলেন, সেইখানেই ছিল সতীর হৃদয়। রাবণ ফিরে এসে দেখলেন শিব মাটিতে আর সেই ব্রাহ্মণ উধাও। গায়ের সব জোর দিয়ে টানাটানি শুরু করলেন, কিন্তু শিব আর নড়েন না, উলটে দৈববাণী হল– ওমন করায় রাবণ নির্বংশ হবেন। অগত্যা রাবণ হাল ছেড়ে ঘরে ফিরলেন। সেই দেখে বিষ্ণু ফিরে এসে বৈজু নামের এক ভীল, মতান্তরে এক গোয়ালার হাতে শিবের পূজা অর্চনার ভার দিলেন।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
রাবণকে জলের অভাব দূর করতে স্বপ্নাদেশ দিলেন শিব। রাবণ খনন করলেন বিরাট এক দিঘি। ক্রমে গড়ে উঠল মন্দির, ব্রাহ্মণেরা তার দখল নিলেন, বৈজুকে তারা তাড়িয়ে দিলেন। রাগে, অপমানে বৈজু রোজ শিবের লিঙ্গের মাথায় একবার করে লাঠির বাড়ি মেরে তবে অন্ন জল গ্রহণ করতে শুরু করল। একদিন কাজের তাড়ায় ভোর বেলায় মন্দিরে যাওয়া হয়নি, লাঠির বাড়িও মারা হয়নি। দুপুরে খেতে বসে মনে পড়ে গেল বৈজুর। ওমনি সে লাঠি হাতে মন্দিরে গিয়ে শিবের মাথায় দিল জোরসে এক ঘা। আঘাতের চিহ্ন আজও দেখা যায়, তবে আগে শুনেছি সে চিহ্ন রাবণের আঘাতের, ইদানীং দোষ চেপেছে বৈজুর ঘাড়ে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
জঙ্গলের মধ্যে বিজন সেইখানে জলের বড় অভাব, বৈজু নাকি শিবের মাথায় জল দিতে পাত্র না পেয়ে মুখে করে জল এনে ঢালতেন। বৈজুকে বিষ্ণু দায়িত্ব দিয়েছেন, তাই শিব অসন্তুষ্ট হলেও তাকে কোন শাস্তি দিতে পারছিলেন না। তাই রাবণকে জলের অভাব দূর করতে স্বপ্নাদেশ দিলেন। রাবণ খনন করলেন বিরাট এক দিঘি। ক্রমে গড়ে উঠল মন্দির, ব্রাহ্মণেরা তার দখল নিলেন, বৈজুকে তারা তাড়িয়ে দিলেন। রাগে, অপমানে বৈজু রোজ শিবের লিঙ্গের মাথায় একবার করে লাঠির বাড়ি মেরে তবে অন্ন জল গ্রহণ করতে শুরু করল। একদিন কাজের তাড়ায় ভোর বেলায় মন্দিরে যাওয়া হয়নি, লাঠির বাড়িও মারা হয়নি। দুপুরে খেতে বসে মনে পড়ে গেল বৈজুর। ওমনি সে লাঠি হাতে মন্দিরে গিয়ে শিবের মাথায় দিল জোরসে এক ঘা। আঘাতের চিহ্ন আজও দেখা যায়, তবে আগে শুনেছি সে চিহ্ন রাবণের আঘাতের, ইদানীং দোষ চেপেছে বৈজুর ঘাড়ে। ব্রাহ্মণেরা ছুটে এসে বৈজুকে মারধর করে তাড়িয়ে দিল।
বৈজু ঘরে ফিরে শিবের উদ্দেশে কুকথার বন্যা বইয়ে দিতে রইল। সেই রাতে শিব এসে মূল পান্ডাকে স্বপ্নে জানালেন বৈজু তাঁর বহু জন্মের ভক্ত, ব্রাহ্মণেরা যদিও বা পূজা কর্মে কোন ভুল করেন তাও বৈজু কিন্তু অতি নিষ্ঠার সঙ্গে লগুড়াঘাত না করে অন্নগ্রহণ করেননি একদিনও। বৈজুকেও তিনি দর্শন দিলেন সেই রাতে। বৈজু অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে ক্ষমা চাইতে রইলেন বারবার। শিব তাঁকে আশ্বস্ত করে বললেন ‘বর’ চাইতে। বৈজু বর চাইল যেন চিরদিন শিবের সঙ্গে তার নিজের নামও উচ্চারিত হয়। তাই থেকেই বৈদ্যনাথের নাম বৈজুনাথ হয়েছিল বলে শোনা যায়।
সতীর হৃদয় পতিত হয়েছিল বলে বৈদ্যনাথ ধামের অপর নাম হার্দ্যপীঠ। সেই হৃদয়কে স্মরণ করে, সতীর অমর প্রেমের কথা মনে করে শিব নাকি এই পীঠকে জাগিয়ে তোলেন। তাই এই পীঠের বেলায় শিবই প্রধান, সতী সেখানে নিদ্রিতা। ‘বৈদ্যনাথ মাহাত্ম্য’ নামের সংস্কৃত রচনায় এই তীর্থের নানা মাহাত্ম্যের কথা লেখা আছে। যার অন্যতম হল ভক্তিযুক্ত একাগ্র চিত্তে বৈদ্যনাথ ধামে বৈদ্যনাথের আরাধনা করলে সকল মনস্কামনা পূর্ণ হয়, এবং নিরোগ শরীর ও দীর্ঘায়ু লাভ করা যায়। তিনি বৈদ্যদের নাথ অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক এমনটাই বলা আছে।
ভোলানাথ চন্দ্র কলকাতার এক পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে লিখে প্রকাশ করেন ‘ট্রাভেল অফ এ হিন্দু’। নৌকা যোগে যে যে তীর্থ তিনি দর্শন করেছিলেন তার সুন্দর বর্ণনা সেই রচনায় পাওয়া যায়। বৈদ্যনাথ ধাম সম্পর্কে তাঁর লেখার খানিক অংশ তুলে ধরি তাঁর ভাষাতেই। ‘In the heart of this desolate region is a romantic spot, wherein the Suivaite Brahmins have planted the Linga of Byjanath dogging in the steps of Buddhists to oust them from even their mountain fastness. The God was being brought from Cailasa by Ravana on his shoulder’.
বঙ্গের রেনেসাঁস যুগের অন্যতম বুদ্ধিজীবী তথা লেখক রাজনারায়ণ বসু প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে শরীর ফেরাতে ১৮৭৯ সালে দেওঘরে বাস করতে শুরু করেন। সেই সময় নিয়ম করে দিনিলিপি লেখার চেষ্টা করতেন। ‘দেবগৃহে দৈনন্দিন লিপি’ নামে সেই বই প্রকাশিত হয়। সেই লিপির শুরুটা খুবই প্রাসঙ্গিক। দেওঘরের আধ্যাত্মিক আকর্ষণ ছাড়াও এক অন্যদিক সেখানে ফুটে উঠেছে। তিনি লিখেছেন, ‘১২৮৬ বঙ্গাব্দ, ইংরেজি ১৮৭৯, ২০ আশ্বিন। অদ্য এই স্থানে (দেওঘর) অতি প্রত্যুষে পৌঁছি। বৈকালে এই স্থানের অনেকগুলি ভদ্র ব্যক্তি আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে আইসেন। দেবগৃহ পর্ব্বত ও বনাকীর্ণ স্থান কিন্তু এখান কতকগুলি ভদ্রলোক বিষয় কর্ম্মানুরোধে বাস করেন এবং তীর্থযাত্রা উপলক্ষে অথবা জলবায়ু পরিবর্ত্তন জন্যও অনেক ভদ্রলোকের সমাগম হয়’। বস্তুত উনিশ শতকে জল হাওয়া বদল, বা স্বাস্থ্যোদ্ধারের প্রয়োজনে বহু বাঙালির গন্তব্য ছিল এই দেওঘর। অনেকে তো জায়গা-জমি কিনে বিশাল বাগান ও অট্টালিকাও তৈরি করিয়ে ফি-বছর এখানে স্বাস্থ্য ফেরাতে আসতেন। একই সাথে তীর্থ ও পর্যটন, সেইসঙ্গে স্বাস্থ্যোদ্ধার সব লক্ষ্যই পূরণ হত।
(চলবে)
…পড়ুন তীর্থের ঝাঁক-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১০। নবদ্বীপ বরাবর সর্বধর্মের মিলনক্ষেত্র, সেই সমাহার আজও বর্তমান
পর্ব ৯। দেবী কামাখ্যার পুজোর নেপথ্যে রয়েছে আদিবাসীদের কৃষিকাজের উৎসব
পর্ব ৮। শতবর্ষ আগে বাংলার প্রথম সত্যাগ্রহ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তারকেশ্বর মন্দিরকে ঘিরে
পর্ব ৭। বামাক্ষ্যাপার টানে তারাপীঠে এসেছিলেন বিবেকানন্দ, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ
পর্ব ৬। তান্ত্রিক, কাপালিক এবং ডাকাতদের থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কালীঘাটে পুজো দিতেন যাত্রীরা
পর্ব ৫। কপিলমুনির আশ্রম খুঁজে না পেয়ে ‘শতমুখী’ হয়েছিল গঙ্গা
পর্ব ৪। কোন উপায়ে লুপ্ত বৃন্দাবনকে ভরিয়ে তুললেন রূপ-সনাতন?
পর্ব ৩। পুত্র রাম-লক্ষ্মণ বিদ্যমান থাকতেও পুত্রবধূ সীতা দশরথের পিণ্ডদান করেছিলেন গয়ায়
পর্ব ২। এককালে শবররা ছিল ওড়িশার রাজা, তাদের নিয়ন্ত্রণেই পুজো পেতেন জগন্নাথদেব
পর্ব ১। ছোটবেলায় ছবি দেখেই কাশীধামে যাওয়ার কথা ভেবেছিলেন ম্যাক্সমুলার সাহেব