চন্দ্রনাথ ভৌমিক নামের এক তীর্থপর্যটক কামরূপ দর্শনে গিয়ে যে অভিজ্ঞতার কথা লেখেন সেটি সত্যিই বেশ আকর্ষণীয়। তাঁর সেই কাহিনি লিপিবদ্ধ হয়েছে ‘তীর্থকাহিনী’ নামে এক বইতে, যেটি প্রকাশিত হয় কলকাতা থেকে ১৩২০ বঙ্গাব্দে তার নিজের উদ্যোগেই। একটা অদ্ভুত কথা জানা যায় সেই বই থেকে, ওই অঞ্চলে ভূমিকম্পে অনেক স্থান লুপ্ত হয়ে গেছে। তবু মিথ্যা বলে পান্ডারা নানা তীর্থদর্শন করিয়ে পয়সা আদায় করে। এছাড়া আছে তান্ত্রিক বেশধারীদের অত্যাচার।
৯.
দক্ষকন্যা সতী অনাহুতের মতো গিয়ে দাঁড়ালেন দক্ষের আয়োজিত যজ্ঞস্থলে। দক্ষ বেশ খানিক ভেবেচিন্তেই মেয়ে-জামাইকে নিমন্ত্রণ করেননি। শ্মশান-মশানে ঘুরে বেড়ায়, সদাই নেশায় চুর, এমন জামাই ভদ্দরলোকের আসরে একদম বেমানান। পরিচয় দিতেই লজ্জা লাগে। সতী যে এমন করে সভায় এসে দাঁড়াবে ভাবতেই পারেননি দক্ষরাজ। তাই মাথায় আগুন জ্বলে উঠল তাকে দেখে। শিবের নামে অকথা-কুকথার বন্যা বইয়ে দিলেন। পতিব্রতা সতী ভরা সভায় শিবের নিন্দা শুনে দেহত্যাগ করলেন, তৎক্ষণাৎ। শিবের কানে খবর যেতেই শিব তাঁর অনুচরদের পাঠিয়ে দিলেন যজ্ঞস্থলে। নিমেষে সব লন্ডভন্ড করে, দক্ষের মুন্ডু কেটে হুলুস্থুল লাগিয়ে দিল শিব বাহিনী। এরপর শিব নিজে এসে সতীর মৃতদেহ কাঁধে তুলে ত্রিলোকে তাণ্ডব লাগিয়ে ঘুরতে লাগলেন। দেবতারা দেখলেন সৃষ্টি ধ্বংস হতে যায়, যতক্ষণ সতীর দেহ কাঁধে থাকবে, ততক্ষণ শিবকে শান্ত করা যাবে না। তাই বিষ্ণু তাঁর সুদর্শন চক্র দিয়ে টুকরো টুকরো করে সতীর দেহ কাটা শুরু করলেন। আর সেই সব দেহাংশ যেখানে যেখানে পড়ল, সেখানেই পরবর্তী কালে গড়ে ওঠে ‘সতীপীঠ’। কিন্তু কতগুলি খণ্ড হয়েছিল? এই নিয়েই বহুজনের বহু মত, এমনকী ঠিক কোথায় কী পড়েছিল, তা নিয়েও দ্বন্দ্বের শেষ নেই। তবে কয়েকটি পীঠ ও তার দেহাংশ নিয়ে সব পণ্ডিতেরই একমত। যার অন্যতম যোনিপীঠ বা ‘মহামুদ্রাপীঠ’– কামরূপ কামাখ্যা।
কামরূপের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অসংখ্য কাহিনি। কোনটি ঐতিহাসিক, কোনটি আবার মিথ। যেমন কামরূপ নাম কেন হল? শিবঠাকুর বসেছেন তপস্যায়, ধ্যান আর ভাঙে না, সৃষ্টি রসাতলে যায়, দেবতারা মিলে পাঠালেন কামদেবকে তাঁর মদন বাণ হানতে, যাতে শিব চঞ্চল হয়ে ধ্যান ভাঙেন। কামদেব তাই করলেন, শিবের ধ্যানভঙ্গ হলে শিবের তৃতীয় নয়ন জ্বলে উঠল, ভষ্মীভূত হলেন কামদেব। শিবের পায়ে লুটিয়ে কামদেবের স্ত্রী রতি স্বামীর প্রাণভিক্ষা চাইলেন। আশুতোষ শিব প্রাণ ফিরিয়ে দিলেন বটে, কিন্তু ভষ্মীভূত কামদেবের দেহের কান্তি ফিরল না। এবার কামদেব শিবের তপস্যা করতে তুষ্ট হয়ে শিব বললেন নীল পর্বতে সতীর গোপনাঙ্গ লুকিয়ে আছে, তাকে উদ্ধার করে মন্দির প্রতিষ্ঠা ও পূজা প্রচলন করলে তবেই কাম তাঁর আগের দেহের শ্রী ফিরে পাবেন। কামদেব তাই করে পূর্বরূপ ফিরে পেলেন। যে তীর্থে কাম তাঁর পূর্বরূপ ফিরে পান সেই তীর্থই– কামরূপ।
কামাখ্যাকে ‘সৃষ্টিতীর্থ’ বলে উল্লেখ করেন কেউ কেউ। বৌদ্ধ তান্ত্রিকেরা আবার দেহস্থ চারটি চক্রের কথা বলেন, তাদের নামগুলি হল, উড্ডীয়ান, পূর্ণগিরি, শ্রীহট্ট ও কামরূপ। এগুলিকে তাঁরা আবার ‘পীঠ’ও বলেন। আবার অনেকের মতে কামাখ্যা দেবী অনার্যদের ফসলের দেবী। যে অম্বুবাচীকে নিয়ে কামাখ্যা জুড়ে এত মাতামাতি, ভক্ত সমাবেশ, এর উৎসে নাকি আদিবাসীদের কৃষিকাজের উৎসব। নববর্ষায় ধান পোঁতার কাজ শুরু করার আগে মাটিকে খানিক ভিজে উঠতে দিতে ভূমিকে কোনওভাবে উত্যক্ত করা নাকি ছিল তাদের রীতিবিরুদ্ধ। কেমন করে সেই দেবীর মন্দির গড়ে উঠল, কেমন করেই বা হিন্দুদের অন্যতম তীর্থে পরিণত হল এই কামরূপ– সেও এক গপ্পো।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
কামরূপের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অসংখ্য কাহিনি। কোনটি ঐতিহাসিক, কোনটি আবার মিথ। যেমন কামরূপ নাম কেন হল? শিবঠাকুর বসেছেন তপস্যায়, ধ্যান আর ভাঙে না, সৃষ্টি রসাতলে যায়, দেবতারা মিলে পাঠালেন কামদেবকে তাঁর মদন বাণ হানতে, যাতে শিব চঞ্চল হয়ে ধ্যান ভাঙেন। কামদেব তাই করলেন, শিবের ধ্যানভঙ্গ হলে শিবের তৃতীয় নয়ন জ্বলে উঠল, ভষ্মীভূত হলেন কামদেব। শিবের পায়ে লুটিয়ে কামদেবের স্ত্রী রতি স্বামীর প্রাণভিক্ষা চাইলেন। আশুতোষ শিব প্রাণ ফিরিয়ে দিলেন বটে, কিন্তু ভষ্মীভূত কামদেবের দেহের কান্তি ফিরল না।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আগে ওই অঞ্চলে ছিল বর্মণ রাজাদের রাজত্ব (৩৫০ থেকে ৬৫০ খ্রিস্টাব্দ )। সপ্তম খ্রিস্টাব্দে সেখানে এসেছিলেন চিনের পর্যটক হিউ-এন সাঙ। তাঁর বিবরণ অনুযায়ী, কামাখ্যা অনার্য কিরাতদের দেবী। এরপর তেজপুরের বনমাল বর্মাদেবের এক শিলালিপি থেকে জানা যায়, অষ্টম-নবম শতকে এখানে এক বিরাট মন্দির ছিল। ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে খেন রাজবংশের পতনের পর ১৫১৫ সাল নাগাদ কোচ রাজারা এক শক্তিশালী শাসকরূপে আত্মপ্রকাশ করেন। প্রথম রাজা বিশ্ব সিংহ আশপাশের অনেক ছোট ছোট রাজাদের তাঁর অধীনে আনেন। তিনি নাকি কামাখ্যায় দেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেন, কাজ শেষ করেন তাঁর পুত্র তথা পরবর্তী কোচ রাজা নরনারায়ণ। সেই নরনারায়ণ শুনতে পেলেন দেবী নাকি প্রত্যহ সন্ধেবেলায় পুরোহিতকে দর্শন দেন। রাজার ইচ্ছে হল তিনিও দেবীকে দেখবেন। ধরে পড়লেন পুরোহিত মশাইকে। নাছোড় রাজাকে এড়াতে না পেরে শেষে পুরোহিত এক কৌশলের কথা জানালেন, সন্ধ্যারতির সময় রাজা ভোগমণ্ডপের গবাক্ষ দিয়ে দেবীর দিকে তাকাবেন, ঘরের বাইরে থেকে। যথাকালে রাজা তাই করলেন, দেখলেন আকস্মিক এক তীব্র জ্যোতি জাগ্রত হল, দেবী পুরোহিতের মুন্ডুখানি ছিঁড়ে নিলেন, রাজা শুনলেন এখনই তিনি যেন মন্দির চত্বর ছেড়ে চলে যান এবং তিনি তো বটেই তাঁর বংশের কেউ কোনওদিন যেন আর কামাখ্যা নীলপর্বতে পদার্পণ না করেন, তেমন হলে কোচ রাজাদের বংশ নির্বংশ হয়ে যাবে।
অম্বুবাচীর দিনে কামাখ্যার বিশেষত্ব হল, দেবীর প্রস্তুরীভূত যোনিপীঠ থেকে শোণিত ধারা লক্ষ করা যায় বলে কথিত। তিনদিন দেবীর মূল মন্দির বন্ধ থাকে, ভক্তেরা সমবেতভাবে দেবীর নামগান ও যজ্ঞের আয়োজন করেন। তার সঙ্গেও এক গপ্পো জুড়ে আছে। কোনও এক সময় মন্দিরটি নানা কারণে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যায়। আশপাশের অঞ্চল হয়ে ওঠে ঘন অরণ্য, সেখানে নানা বন্য জন্তু জানোয়ারের বাস। একদিন এক রাজা এলেন শিকার করতে, বনের মধ্যে রাজার হাতি কাদায় অর্থাৎ পাঁকের দহে আটকে পড়ে। বহু চেষ্টাতেও হাতি উদ্ধার সম্ভব হল না। সারা রাত ওইভাবে কেটে গেল, ভোরবেলায় এক কাঠুরে সব দেখে রাজাকে পরামর্শ দিলেন বনের মধ্যে এক দেবীর বাস। তাঁকে সন্তুষ্ট করলেই মিলতে পারে অভীষ্ট সব কিছু। রাজা তাই করলেন, আর হাতিও উদ্ধার পেল। সেই পূজার দিনটি ছিল অম্বুবাচীর প্রথম দিন। পুজো চলে তিনদিন, সেই থেকে নাকি আষাঢ় মাসে অম্ববাচী কালে দেবী কামাখ্যা রজঃস্বলা হন, ওই সময়ে মন্দিরে প্রবেশ অনুচিত, দেবীকে বিব্রত যাতে না করা হয়, তাই পূজাপাঠ সব গর্ভগৃহের বাইরে করা হয়ে থাকে।
চন্দ্রনাথ ভৌমিক নামের এক তীর্থপর্যটক কামরূপ দর্শনে গিয়ে যে অভিজ্ঞতার কথা লেখেন সেটি সত্যিই বেশ আকর্ষণীয়। তাঁর সেই কাহিনি লিপিবদ্ধ হয়েছে ‘তীর্থকাহিনী’ নামে এক বইতে, যেটি প্রকাশিত হয় কলকাতা থেকে ১৩২০ বঙ্গাব্দে তার নিজের উদ্যোগেই। একটা অদ্ভুত কথা জানা যায় সেই বই থেকে, ওই অঞ্চলে ভূমিকম্পে অনেক স্থান লুপ্ত হয়ে গেছে। তবু মিথ্যা বলে পান্ডারা নানা তীর্থদর্শন করিয়ে পয়সা আদায় করে। এছাড়া আছে তান্ত্রিক বেশধারীদের অত্যাচার। আগে লোক মুখে প্রচলিত ছিল কামরূপে গেলে সেখানকার মেয়েরা পুরুষদের ভেড়া বানিয়ে রাখে, এমনই তাদের জাদুর শিক্ষা। বাস্তব প্রমাণ না পেলেও নানা তান্ত্রিক বাবাদের বশীকরণ, মারণ, উচাটন ক্রিয়ার কথা ফলাও করে বিজ্ঞাপিত হতে দেখেছি। তবে সাম্প্রতিককালে বলিপ্রথা অনেকটা স্তিমিত। নীল পর্বতের পাথুরে রাস্তায় যতই মন্দিরের কাছাকাছি পৌঁছানো যায়, নানা রঙের পায়রা সৌধের খাঁজে খাঁজে লক্ষ করা যায়। এগুলি দেবীর উদ্দেশে নিবেদন করে ছেড়ে দেওয়া হয়, হত্যা করা হয় না।
কামরূপ পাহাড় থেকে নেমে ব্রহ্মপুত্র নদী বরাবর উমানন্দ দর্শনে পুণ্যার্থীদের পুণ্যের হাতছানির পাশাপাশি এক অপূর্ব যাত্রার অভিজ্ঞতা হয়। বিশেষ করে ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর থেকে সূর্যাস্তের দৃশ্য অতীব মনোরম।
পূর্ব ভারতে তো বটেই, সারা ভারতেও তন্ত্র চর্চার এত বড় কেন্দ্র আর আছে কি না সন্দেহ।
…পড়ুন তীর্থের ঝাঁক-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৮। শতবর্ষ আগে বাংলার প্রথম সত্যাগ্রহ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তারকেশ্বর মন্দিরকে ঘিরে
পর্ব ৭। বামাক্ষ্যাপার টানে তারাপীঠে এসেছিলেন বিবেকানন্দ, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ
পর্ব ৬। তান্ত্রিক, কাপালিক এবং ডাকাতদের থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কালীঘাটে পুজো দিতেন যাত্রীরা
পর্ব ৫। কপিলমুনির আশ্রম খুঁজে না পেয়ে ‘শতমুখী’ হয়েছিল গঙ্গা
পর্ব ৪। কোন উপায়ে লুপ্ত বৃন্দাবনকে ভরিয়ে তুললেন রূপ-সনাতন?
পর্ব ৩। পুত্র রাম-লক্ষ্মণ বিদ্যমান থাকতেও পুত্রবধূ সীতা দশরথের পিণ্ডদান করেছিলেন গয়ায়
পর্ব ২। এককালে শবররা ছিল ওড়িশার রাজা, তাদের নিয়ন্ত্রণেই পুজো পেতেন জগন্নাথদেব
পর্ব ১। ছোটবেলায় ছবি দেখেই কাশীধামে যাওয়ার কথা ভেবেছিলেন ম্যাক্সমুলার সাহেব