যে কোনও শিল্পেরই ভালো-মন্দ রয়েছে। দুর্গাপুজোশিল্পও নিষ্কলুষ নয়। সেখানেও এক্সপ্লয়টেশন রয়েছে। কারণ সেখানেও ক্ষমতা ও সাধারণ রয়েছে। কিন্তু তারপরও হয়তো এই পথ বেছে নিয়েছি বেঁচে থাকার একটা উপায় হিসেবেই। এই এক্সপ্লয়টেশনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতেই চলবে শিল্প।
১১.
ছবি আঁকতে গেলে শুধু ছবি আঁকাটাই কি জরুরি? শুধুই রং-তুলি, কী ছবি আঁকব ভাবা, কিংবা লাইভ স্কেচ? সেখানেই কি শিল্পের সমস্ত দরজা-জানলা খুলে যায়? সত্যিই খোলে? নাকি সেই দরজায় বহু বছরের জংধরা, না খোলা তালা? সে বাড়ির ভেতরে হয়তো বাদুর, মাকড়সা দীর্ঘ জাল বিছিয়েছে। আমাদের উচিত ছিল সেই চাবিটির খোঁজ করা, যা হারিয়ে গিয়েছে বাঙালির শিল্পসংস্কৃতি থেকে। কী সেই চাবি? শিল্পসংলগ্ন হওয়া। শিল্পের জন্য ভাবা। বিশ্বের যে শিল্প শাখাপ্রশাখা, তার ডালে-পাতায় খানিক বসে থাকা।
একথা বলছি, কারণ ছবি দেখা, ছবির কথা জানা, বই পড়া, বাকি শিল্পস্রোতের সঙ্গে নিজের ও নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হওয়াও একজন শিল্পশিক্ষার্থীর কাজ। শিক্ষকের কাজ। এবং অতি জরুরি কাজ বিশ্বের শিল্প-ইতিহাস পড়া। এসব আমরা শিখে এসেছি আমাদের মাস্টারমশাইদের থেকেই। আগের পর্বে, অভিযোগ করেছিলাম, কোথায় সেসব মাস্টারমশাই? কেউ কেউ বলছেন, কয়েকজন আছেন। কিন্তু সেই কয়েকজন দিয়ে কি আমাদের শিল্পচর্চার স্রোত জোরালো হবে? কী কারণে ঐতিহ্য থেকে এতটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম আমরা? জন বার্জারের ‘ওয়েজ অফ সিয়িং’-ই হয়তো পড়া নেই ভালো করে, পড়া নেই অনেক শিক্ষকেরই! এ-ও শুনতে পেয়েছি, শিক্ষক অভিযোগ করছেন, তোমার ছবি অমুকের দ্বারা ইনফ্লুয়েন্সড! কিন্তু একবারও তিনি ভাবছেন না যে, সেই শিল্পশিক্ষকের নিজের আঁকা ছবি ছাত্রছাত্রীরা দেখেছে কি না! হয়তো দেখেইনি। তিনি যে পেইন্টার, তা জানতেই পারে না শিক্ষার্থীরা। জানে, তিনি স্রেফ শিক্ষক– এটাই কি হওয়ার কথা ছিল?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ছবি দেখা, ছবির কথা জানা, বই পড়া, বাকি শিল্পস্রোতের সঙ্গে নিজের ও নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হওয়াও একজন শিল্পশিক্ষার্থীর কাজ। শিক্ষকের কাজ। এসব আমরা শিখে এসেছি আমাদের মাস্টারমশাইদের থেকেই। আগের পর্বে, অভিযোগ করেছিলাম, কোথায় সেসব মাস্টারমশাই? কেউ কেউ বলছেন, কয়েকজন আছেন। কিন্তু সেই কয়েকজন দিয়ে কি আমাদের শিল্পচর্চার স্রোত জোরালো হবে?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আজ এই পরিস্থিতিতেই তো আমার রাস্তায় নামা, বিকল্প শিল্প বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা। এখানে তো টাকা দিতে হচ্ছে না। শ্রম দিচ্ছে। বিনিপয়সায় নয়। তারা টাকা পাচ্ছে সেই কাজ করে, কাজ শিখে। এবং পরবর্তীকালে আরও কাজ পাচ্ছে। কলকাতায় এমন কত কোম্পানি রয়েছে, যেখানে ‘ইন্টার্নশিপ’ নামক খুড়োর কলে পড়ে কত কত যুবক-যুবতী যে দিবারাত্র শ্রম দিয়ে চলেছে অহেতুক! সেই বিরাট কোম্পানিগুলো শুধুই খাটিয়ে নেয়, পয়সা দেয় না। তাহলে কি সেই সদ্য কাজ করতে আসা, রোজগার করে বড় হওয়ার যে স্বপ্ন দেখা, সেইসব মিথ্যে হয়ে যাবে? মানুষ শ্রমের বিনিময়ে টাকা পাবে, এই স্বপ্নটাকে আঁস্তাকুড়ে ফেলে দেওয়া হবে কেন? এ নিয়ে তাদের ছাড়া সরব হন না কেন কেউ? মনে করুন, বাদল সরকারের কথা। স্ট্রিট থিয়েটারের কথা। আমিও তো সেই আদলেই শিল্পটাকে চার দেওয়াল থেকে মুক্তি দিয়েছি। প্রাচীর ভেঙেছি। সেই প্রাচীর অচলায়তনের।
দুর্গাপুজোশিল্পে এসে যারা কাজ করে তারা প্রায় কেউই আর্ট কলেজ পাস আউট নয়। তাহলে আর্ট কলেজে পড়ে হলটা কী? শিল্পের কিছু কারিগর কাজ করে যাক, আমি চাই। সে শুধু শিল্পমনস্ক হোক, ডিগ্রির কাগজ আমার লাগবে না। একটি ছেলে ’৯৮ সাল থেকে আমার ন্যাওটা ছিল। সঙ্গে সঙ্গে কাজ করত, শিখত। কালীপুজোর প্যান্ডেল তৈরি করে অন্য জায়গায় সেসবের প্রদর্শনীও করত। একবার হল কী, নলিনী সরকার স্ট্রিটে আমি পুজো করছি, ও পুজোর বরাত পেল উল্টোদিকের পার্কে। দুর্গাপুজো কিন্তু! গর্বে বুক ফুলে ওঠেছিল আমার। আরও বড় প্রাপ্তি হল যখন ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর পুজোর পুরস্কারে আমি সেবার হলাম প্রথম, আর ও দ্বিতীয়। আমার এমনও ছাত্র আছে, পরিমল পাল, যে দুর্গাপুজোয় রীতিমতো ছড়ি ঘোরায়। আরেকজন, মানস রায়– ‘থার্ড আই’-এর অতনু পালের স্টুডেন্ট, সে ফোটোগ্রাফি করত, এখন তো কলকাতার দুর্গাপুজোর বড়সড় নাম। আপনারা হয়তো লক্ষ করবেন, এই নামগুলোর মধ্যে মেয়েদের নাম আমি করিনি। তাহলে কি মেয়েরা আসছে না? আসছে। কিন্তু কম। যৎসামান্যই। আমারই প্রাক্তন স্ত্রী দু’বার পুজোর ঠাকুর গড়েছিল।
যে কোনও শিল্পেরই ভালো-মন্দ রয়েছে। দুর্গাপুজোশিল্পও নিষ্কলুষ নয়। সেখানেও এক্সপ্লয়টেশন রয়েছে। কারণ সেখানেও ক্ষমতা ও সাধারণ রয়েছে। কিন্তু তারপরও হয়তো এই পথ বেছে নিয়েছি বেঁচে থাকার একটা উপায় হিসেবেই। এই এক্সপ্লয়টেশনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতেই চলবে শিল্প। শিল্প তো শেষমেশ লড়াই-ই করতে চায়। শিল্পী, আসলে একজন বিপ্লবী, তার বাইরে কিছুই নয়।
(চলবে)
…আরও পড়ুন ত্রিনয়ন ও ত্রিনয়ন…
পর্ব ১০: যে কারণে এখন দুর্গাপুজো শিল্প করছি না
পর্ব ৯: এদেশে শিল্প সেক্যুলার হবে না
পর্ব ৮: শুধু শিল্প নিয়ে যারা বাঁচতে চায়, তারা যেন বাঁচতে পারে
পর্ব ৭: ক্যালেন্ডারের দেবদেবীর হুবহু নকল আমি করতে চাইনি কখনও
পর্ব ৬: সাধারণ মানুষকে অগ্রাহ্য করে শিল্প হয় না
পর্ব ৫: দেওয়ালে যামিনী রায়ের ছবি টাঙালে শিল্পের উন্নতি হয় না
পর্ব ৪: দেবীঘটও শিল্প, আমরা তা গুরুত্ব দিয়ে দেখি না
পর্ব ৩: জীবনের প্রথম ইনকাম শ্মশানের দেওয়ালে মৃত মানুষের নাম লিখে
পর্ব ২: আমার শরীরে যেদিন নক্ষত্র এসে পড়েছিল
পর্ব ১: ছোট থেকেই মাটি আমার আঙুলের কথা শুনত