আমি যে দুর্গা বানাই, লক্ষ করবেন সেই দুর্গার মুখ মোটেই ‘মেয়েলি’ নয়। আপনারা বলতেই পারেন সে কী! এরকম তো হওয়ার কথা নয়। এতকাল ধরে এত শিল্পীর গড়া দুর্গাপ্রতিমা দেখে এলাম, কই, সেখানে তো সবসময়ই ওই আলতো নরম মুখই ধরা পড়েছে। তাহলে? আমি সে পুরনো পথ অনুসরণ করিনি। দুর্গা তো যুদ্ধে যাচ্ছেন, তাহলে তাঁর মুখ তখনও কেন ওই ‘মেয়েলি’ রূপে আবদ্ধ থাকবে? কেন চোয়াল শক্ত থাকবে না? যাকে সমাজ ‘পুরুষালী’ বলেই হয়তো দেগে দেবে।
১৩.
কৃচ্ছ্রসাধনের কথা বলছিলাম। জীবনে যা দরকার রয়েছে বলেই মনে করি আমি। ত্যাগ, শিল্পের জন্য ত্যাগ। ত্যাগ কিন্তু, উপেক্ষা নয়। উপেক্ষার মধ্যে আত্ম-অহংকার মিশে থাকে। নিরহং শিল্পী হতে হবে। শিল্পের পথে একে একে ফেলে যেতে হবে যাবতীয় এ-আমির অকারণ আবরণকে।
আমি কেন দুর্গাপুজো শিল্প করে বিরাট টাকা রোজগার করি না? কারণ আমার রোজগার করার ক্ষেত্রটা আলাদা। আমি তো সারা পৃথিবীতে ওয়ার্কশপ করে বেড়াই। বডি পেইন্টিং, স্কাল্পচার– নানা জায়গা থেকে টাকা পাই। সে টাকা এখানে কাজে লাগাই। হ্যাঁ, দুর্গাপুজো শিল্পে। কিছুটা আমার বেঁচে থাকায়। আপনারা বলতেই পারেন, আরে মশাই এ তো আপনার লসের ওপর লস, ডাহা লস! কিন্তু এই তো আমার বেঁচে থাকার রসদ। আমার সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছনোর রসদ। সেই পথে নামতে গেলে, এইটুকু তো করতেই হবে।
আমি কখনও ভাবিনি গজদন্ত মিনারে বসে ছবি আঁকব। আমার ছবির বিষয়ও সেরকম নয়। আমার বিষয় সবসময়ই সাধারণ মানুষ। তাদের সাধারণত্বের উদযাপন করাটাই আমার শিল্প। আমার রং-তুলির আনন্দ হয় তাতেই। ওরাই আমার ছবিতে ঘুরে-ফিরে আসে। একা একাও।
নরনারী নিয়ে প্রচুর কাজ করেছি আমি। প্রচুর ছবি এঁকেছি তাদের। নানা সময়। নানা আলোছায়ায়। কিছু কিছু কাজে আমি মিশিয়ে দিতে পেরেছি সংকেত। আমি পুরুষ। আমার যৌনতা আছে। আমি নারীর ভালোবাসা, প্রেম পেতে ভালোবাসি। কিন্তু অনেক দিন আমি সেই ছবিই, মানে শুধু নরনারীদের প্রেমের ছবিই এঁকে চলেছিলাম। একদিন মনে হল, জীবনানন্দর সেই কবিতার পঙ্ক্তির মতোই: ‘বয়স বেড়েছে ঢের নরনারীদের’। আমি সেই নরনারীদের প্রেম-যৌনতা থেকে সরে তৃতীয় লিঙ্গের ছবির দিকে হাত বাড়িয়েছি। তাদের প্রেম, তাদের বন্ধুত্ব, যৌনতা, জীবন– এই সমস্ত কিছুর কথাই আমি বলতে চাই আমার ছবিতে! রাস্তায় গাড়ি থেমে গেলে সে অনেকসময় ভিক্ষে করছে, কিন্তু সে-ও অনেকসময়ই হয়ে উঠতে পারে আমাদেরই দেবী। মনের মধ্যে সেই লুকিয়ে থাকা আলো-অন্ধকার আমি টেনে আনতে চাই আমার ছবিতে। তা আনতে সফল হব না ব্যর্থ, তা পরের কথা। কিন্তু আরেকরকমের প্রতি আমাদের কেন অনীহা থাকবে? সবথেকে বড় কথা, শিল্পের অনীহা থাকবে কেন?
প্রসঙ্গত, আমি যে দুর্গা বানাই, লক্ষ করবেন সেই দুর্গার মুখ মোটেই ‘মেয়েলি’ নয়। আপনারা বলতেই পারেন সে কী! এরকম তো হওয়ার কথা নয়। এতকাল ধরে এত শিল্পীর গড়া দুর্গাপ্রতিমা দেখে এলাম, কই, সেখানে তো সবসময়ই ওই আলতো নরম মুখই ধরা পড়েছে। তাহলে? আমি সে পুরনো পথ অনুসরণ করিনি। দুর্গা তো যুদ্ধে যাচ্ছেন, তাহলে তাঁর মুখ তখনও কেন ওই ‘মেয়েলি’ রূপে আবদ্ধ থাকবে? কেন চোয়াল শক্ত থাকবে না? যাকে সমাজ ‘পুরুষালী’ বলেই হয়তো দেগে দেবে।
এবার তৃতীয় লিঙ্গের প্রসঙ্গটা আরেকবার পড়ে দেখুন। ভেবে দেখুন। তৃতীয়কে তৃতীয় করে রাখার রাজনীতিটা বুঝুন। পুরুষের মধ্যেও কি নেই নারীর উদারত্ব? কোমল স্বভাব? নারীর মধ্যেও কি নেই কাঠিন্য, অপরিমেয় সাহস? যে কোনও পুরুষ, যে কোনও নারী কখনও কখনও ওই তৃতীয় লিঙ্গের মনে পৌঁছয়।
তৃতীয় নয়ন দিয়ে আসুন, তৃতীয় লিঙ্গকে দেখা যাক।
(চলবে)
…আরও পড়ুন ত্রিনয়ন ও ত্রিনয়ন…
পর্ব ১২: লাখ লাখ টাকা কামানোর জন্য দুর্গাপুজো করিনি, করব না
পর্ব ১১: বাদল সরকারের থিয়েটার পথে নেমেছিল, আমার শিল্পও তাই
পর্ব ১০: যে কারণে এখন দুর্গাপুজো শিল্প করছি না
পর্ব ৯: এদেশে শিল্প সেক্যুলার হবে না
পর্ব ৮: শুধু শিল্প নিয়ে যারা বাঁচতে চায়, তারা যেন বাঁচতে পারে
পর্ব ৭: ক্যালেন্ডারের দেবদেবীর হুবহু নকল আমি করতে চাইনি কখনও
পর্ব ৬: সাধারণ মানুষকে অগ্রাহ্য করে শিল্প হয় না
পর্ব ৫: দেওয়ালে যামিনী রায়ের ছবি টাঙালে শিল্পের উন্নতি হয় না
পর্ব ৪: দেবীঘটও শিল্প, আমরা তা গুরুত্ব দিয়ে দেখি না
পর্ব ৩: জীবনের প্রথম ইনকাম শ্মশানের দেওয়ালে মৃত মানুষের নাম লিখে
পর্ব ২: আমার শরীরে যেদিন নক্ষত্র এসে পড়েছিল
পর্ব ১: ছোট থেকেই মাটি আমার আঙুলের কথা শুনত