আমাদের শিল্পের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন শৈবরাজারা, মোগল সম্রাটরা, বৌদ্ধরাজারা– তাঁরা যা যা নির্মাণ করেছেন, মন্দির, মসজিদ, ভাস্কর্য এই সবই তো শিল্প। কিন্তু এ-ও সত্যি যে, আজ যদি মিকেলাঞ্জেলোর সিক্সটিনথ চ্যাপেল দেখি, তাহলে কি আমরা ওল্ড টেস্টামেন্টের গল্প খুঁজতে যাই? আসলে খুঁজি মিকেলাঞ্জেলোকেই। সব ধর্মকে ছাপিয়ে গিয়ে মহাগুরু মহাঈশ্বর মিকেলাঞ্জেলোর কাজের কাছে পৌঁছতে হয়। আমাদের কাজও তাই, ধর্মকে ছাপিয়ে কীভাবে শিল্পটা করব? কিন্তু প্রাথমিকভাবে তা সেক্যুলার না-ই হতে পারে।
৯.
আমি দুর্গাপুজো শিল্প শুরু করেছিলাম ’৯৮ সালে। ২৫ বছর কেটে ২৬ বছরে পা দিল। বোঝাই যাচ্ছে, এই শিল্প সাফল্য পাচ্ছে। নানারকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। পরে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাবে এই শিল্প। রসদ আছে। আছে বলেই তো এই শহরটা ওই তিনমাস রঙিন শিল্পনগরী হয়ে উঠেছে। যে কোনও শিল্পেরই একটা পলিটিক্স থাকে। দুর্গাপুজো শিল্পেরও আছে। ব্রাজিলের রিও ফেস্টিভ্যালের কথা ভাবুন। না, তুলনা করছি না। কারণ দুর্গাপুজো আর রিও ফেস্টিভ্যাল এক নয়। দুর্গাপুজো শিল্প এখনও আনঅরগানাইজড সেক্টর। কিন্তু রিও তা নয়। অবশ্য এ-ও ঠিক যে, দুর্গাপুজো শিল্প যদি অরগানাইজড হত, হয়তো সমস্যাই হত। থোড়-বড়ি-খাড়া খাড়া-বড়ি-থোড়ে রূপান্তরিত হত। আমি চাই এই শিল্পপরম্পরা অন্তত ৫০ বছর চলুক। পৃথিবীর ইতিহাসের যে শিল্প-আন্দোলনগুলো দেখা গিয়েছে, একটু লক্ষ করলে দেখা যাবে– তা বেশিদিন টেকেনি। কিন্তু একটা ছাপ, কোনও একটা চিন্তাসূত্র ঢুকিয়ে দিয়ে গিয়েছে। বিতর্ক হয়েছে, কিন্তু দাগ কেটে গিয়েছে। পাতার পর পাতা লেখালিখি হয়েছে। তৈরি হয়েছে সমর্থক ও বিরোধী দল। সে জায়গা থেকে দুর্গাপুজো শিল্প ২৫ বছর কাটিয়ে ফেলেছে। নিশ্চয়ই এ ব্যাপারটা কারও সমর্থন পেয়েছে, কারও পায়নি। কিন্তু আরও ২৫ বছর চললে এই শিল্প আমার মনে হয়, ইতিহাসের পাতায় একটা আন্দোলন হিসেবেই স্থান পাবে। সেই আন্দোলন সামান্য ছাপ ফেলে যাওয়া নয়, গভীরতর কোনও দাগ। কোনও জোরালো মতবাদ। চিন্তার বিস্ফোরণ।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আমাদের দুটো মহাকাব্য, বেদ, উপনিষদ– কত রসদ রয়েছে তাতে। তাতে কি ঈশ্বরের কথা আছে? আছে চিন্তার কথা। দর্শনের কথা। জীবনবোধের কথা। আমাদের নিজস্ব রসদের, নিজের মৃত্তিকার উপাদানের কাছে ফিরতে হবে। হাতে ইন্টারনেট রয়েছে বলে, নানা জিনিস সহজলভ্য বলে, আমরা শুধুই ‘নকল’ করে যেতে পারি না। এ এক ধরনের চালাকি।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
কিন্তু এই শিল্প আন্দোলন কাকে কেন্দ্র করে? ধর্ম। দেশ-বিদেশের নানা তাত্ত্বিকেরা বলে থাকেন, শিল্প হবে সেক্যুলার। আমি জোর গলায় বলছি, ভারতবর্ষে শিল্প সেক্যুলার হবে না। হওয়া সম্ভব না। কারণ ভারতবর্ষ বহু ধর্মের দেশ। বহ ভাষাভাষীর দেশ। এখানে শিল্প সেক্যুলার হতে পারে না। খ্রিস্টধর্ম, ইসলাম– এইরকম কিছু ধর্ম নিশ্চয়ই আছে, যারা একেশ্বরবাদী। কিন্তু হিন্দুরা সকালে শিবপুজো করলে রাতে কালীপুজো করছে। বিভিন্ন রকম মতবাদ নিয়ে চলছি। ক’দিন আগেই তো ইদ গেল। তখন তো আমি নিজেই আমার মুসলমান বন্ধুটির বাড়ি গিয়েছি। হইহই করেছি, খেয়েছি, আনন্দ করেছি। ধর্মের অনুসঙ্গ আমাদের নানা কাজে ঢুকে গিয়েছে, সেখানে শিল্প সেক্যুলার হতে গেলে ‘আমি’র বোধ বাদ পড়বে। সেক্যুলার হতে গেলে মিথ্যে তৈরি করতে হবে শিল্প।
আমাদের শিল্পের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন শৈবরাজারা, মোগল সম্রাটরা, বৌদ্ধরাজারা– তাঁরা যা যা নির্মাণ করেছেন, মন্দির, মসজিদ, ভাস্কর্য এই সবই তো শিল্প। কিন্তু এ-ও সত্যি যে, আজ যদি মিকেলাঞ্জেলোর সিস্টাইন চ্যাপেল দেখি, তাহলে কি আমরা ওল্ড টেস্টামেন্টের গল্প খুঁজতে যাই? আসলে খুঁজি মিকেলাঞ্জেলোকেই। সব ধর্মকে ছাপিয়ে গিয়ে মহাগুরু মহাঈশ্বর মিকেলাঞ্জেলোর কাজের কাছে পৌঁছতে হয়। আমাদের কাজও তাই, ধর্মকে ছাপিয়ে কীভাবে শিল্পটা করব? কিন্তু প্রাথমিকভাবে তা সেক্যুলার না-ই হতে পারে।
আমাদের দুটো মহাকাব্য, বেদ, উপনিষদ– কত রসদ রয়েছে তাতে। তাতে কি ঈশ্বরের কথা আছে? আছে চিন্তার কথা। দর্শনের কথা। জীবনবোধের কথা। আমাদের নিজস্ব রসদের, নিজের মৃত্তিকার উপাদানের কাছে ফিরতে হবে। হাতে ইন্টারনেট রয়েছে বলে, নানা জিনিস সহজলভ্য বলে, আমরা শুধুই ‘নকল’ করে যেতে পারি না। এ এক ধরনের চালাকি। সেই চালাকি দিয়ে বেশিদিন শিল্পের পথে টিকে থাকা যায় না। নিজেদের ভাঙা-গড়ার জন্য জানতে হবে, আত্তীকরণ করতে হবে শিল্পের ইতিহাস। টেনে নিতে হবে সাধারণ মানুষকে। না শুধুই সেই শিল্পের দর্শক হিসেবে নয়, শিল্প নির্মাতা হিসেবেও। এ আমাদের যৌথ নির্মাণের কাজ। দুর্গাপুজো শিল্প একধরনের যৌথতার বোধ, এই কথাটা মনে করিয়ে দিতে হবে আমাদের, বারবার।
(চলবে)
…আরও পড়ুন ত্রিনয়ন ও ত্রিনয়ন…
পর্ব ৮: শুধু শিল্প নিয়ে যারা বাঁচতে চায়, তারা যেন বাঁচতে পারে
পর্ব ৭: ক্যালেন্ডারের দেবদেবীর হুবহু নকল আমি করতে চাইনি কখনও
পর্ব ৬: সাধারণ মানুষকে অগ্রাহ্য করে শিল্প হয় না
পর্ব ৫: দেওয়ালে যামিনী রায়ের ছবি টাঙালে শিল্পের উন্নতি হয় না
পর্ব ৪: দেবীঘটও শিল্প, আমরা তা গুরুত্ব দিয়ে দেখি না
পর্ব ৩: জীবনের প্রথম ইনকাম শ্মশানের দেওয়ালে মৃত মানুষের নাম লিখে
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved