পাড়ার বখাটে ছেলে হয়ে যাব, এরকম একটা ভয় ছিল বাড়ির পক্ষ থেকে। কিন্তু ওঁরা দেখলেন মাটি ঘাঁটছি, রং করছি। মাটির সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছে। ফলে তাঁরা নিশ্চিন্ত। এখনও আমি টের পাই, বোতামবিহীন প্যান্ট পরে একহাতে একদলা মাটি, আর এক হাতে বাঁশের চেয়ারী (ভাস্কর্যের একরকম টুল) নিয়ে আমি হেঁটে বেড়াচ্ছি কুমোরটুলির এ-গলি, সে-গলি। মাটি থেকে অনেকক্ষণ নিয়ে দলার পর দেখছি তেল বেরচ্ছে। মাটি আমার আঙুলের কথা শুনছে। শুরু হল সনাতন দিন্দার কলাম ‘ত্রিনয়ন ও ত্রিনয়ন’। আজ প্রথম পর্ব।
১.
কুমোরটুলি। কলকাতার প্রতিমা পাড়া। সেখানেই আমি জন্মেছিলাম। উত্তাল সত্তর চলছে তখন। বাড়ির আশপাশে প্রতিমা গড়া হচ্ছে। দুরন্ত প্রতিমা শিল্পীরা গড়ে তুলছেন মায়াবী প্রতিমা। এরই মাঝে, কুমোরটুলির একটা ছোট্ট ঘরে, অনেক প্রতিমার মধ্যে, বাবা-মা আর পাঁচ বোনের সংসারে, সাত বাই আট ফুটের ছোট এক ঘরে আস্ত রক্তমাংসের আমি জন্মালাম সেই সত্তরে– যে সত্তরে এদিক-সেদিক লাশ পড়ছে, তরুণরা সমাজবদলের স্বপ্ন দেখছে, রক্তক্ষয় হচ্ছে অহরহ– বাড়ির এক বিপুলায়তন ট্রাঙ্কে লুকিয়ে পড়ল দুই নকশাল– একজন গৌরাঙ্গ চক্রবর্তী এবং আরেকজন তাঁরই বন্ধু। গৌরাঙ্গ চক্রবর্তীই যে মিঠুন চক্রবর্তী, তা আপনারা হয়তো প্রত্যেকেই জানেন। আমার পিসি পাগলি সেজে, নগ্ন ঊর্ধাঙ্গে গামছা জড়িয়ে, লাঠিয়ে নিয়ে তাড়া করেছিল পুলিশকে। আশপাশ থেকে লোকজন বলেছিল, ‘পালিয়ে যান, মেরে দেবে পাগলিটা।’
আমি একথা শুনেছি, মায়ের মুখে। সেই ঝঞ্ঝাময় কলকাতায় আমি বড় হয়ে উঠছিলাম। পাড়ার বখাটে ছেলে হয়ে যাব, এরকম একটা ভয় ছিল বাড়ির পক্ষ থেকে। কিন্তু ওঁরা দেখলেন মাটি ঘাঁটছি, রং করছি। মাটির সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছে। ফলে তাঁরা নিশ্চিন্ত। এখনও আমি টের পাই, বোতামবিহীন প্যান্ট পরে একহাতে একদলা মাটি, আর এক হাতে বাঁশের চেয়ারী (ভাস্কর্যের একরকম টুল) নিয়ে আমি হেঁটে বেড়াচ্ছি কুমোরটুলির এ-গলি, সে-গলি। মাটি থেকে অনেকক্ষণ নিয়ে দলার পর দেখছি তেল বেরচ্ছে। মাটি আমার আঙুলের কথা শুনছে।
এরও আগে, যখন আমি নাকি দাঁড়াতাম টলোমলো পায়ে, মা বলেছেন, তখন থেকেই আঁচড় কাটতাম দেওয়ালে। আমাদের বাড়িওয়ালা, আমার প্রথম গুরু, বাদলচন্দ্র পাল মাটির নানা ধরনের জিনিস বানাতেন ও বেচতেন। খড়িমাটি, টেরাকোটার জিনিসপত্র ছিল সেইসব। তৈরি করতেন ছাঁচের পুতুলও। আমি ওঁর শিল্পকে বিক্রি হতে দেখেছিলাম বাড়ির সামনেই। ভাঙা খড়ি ছিল এই শিশুশিল্পীটির জন্য বরাদ্দ। আমি ওই ভাঙা খড়ি দিয়ে ছবি আঁকতাম দেওয়ালে। এটা ’৭৪ সালের কথা। আমি জানতাম না কী করছি আমি। শুধু চোখের সামনে দেখছি মাটি কীভাবে হয়ে উঠছে ভাস্কর্য। মাটি কীভাবে হয়ে উঠছে প্রতিমা। ভঙ্গিমা আমার দীর্ঘদিন ধরে দেখার ফলে মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। কাজে নেমে পড়ার আগে তাই আমার দেখার পূর্ব ইতিহাস, আমাকে সাহায্য করেছে। সে অর্থে এখনও আমি দেখছি, দেখছি বলেই শিখছি।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
কুমোরটুলির একটা ছোট্ট ঘরে, অনেক প্রতিমার মধ্যে, বাবা-মা আর পাঁচ বোনের সংসারে, সাত বাই আট ফুটের ছোট ঘরে একটা আস্ত রক্তমাংসের আমি জন্মালাম সেই সত্তরে– যে সত্তরে এদিক-সেদিক লাশ পড়ছে, তরুণরা সমাজবদলের স্বপ্ন দেখছে, রক্তক্ষয় হচ্ছে অহরহ– বাড়ির এক বিপুলায়তন ট্রাঙ্কে লুকিয়ে পড়ল দুই নকশাল– একজন গৌরাঙ্গ চক্রবর্তী এবং আরেকজন তাঁরই বন্ধু। গৌরাঙ্গ চক্রবর্তীই যে মিঠুন চক্রবর্তী, তা আপনারা হয়তো প্রত্যেকেই জানেন। আমার পিসি পাগলি সেজে, নগ্ন ঊর্ধাঙ্গে গামছা জড়িয়ে, লাঠিয়ে নিয়ে তাড়া করেছিল পুলিশকে। আশপাশ থেকে লোকজন বলেছিল, ‘পালিয়ে যান, মেরে দেবে পাগলিটা।’
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
ছেলেবেলার ওই শিল্পগুরুর পাশে বসে বসেই দেখতাম আমি, কী করছেন। বলতেন, ‘খোকা, রংটা একটু মেরে দে তো!’ রং ‘মেরে দেওয়া’ মানে রং করে দেওয়া। বা বলতেন, ‘আঙুল দিয়ে গুলে দে তো’ বা ‘মাটিটা একটু চটকে দে।’ ওঁর কাজ এগিয়ে দিতে দিতেই আমার কাজ শেখা। এখন আমি ছাঁদের পুতুলের সমস্ত কিছু বলে দিতে পারব। দেবীঘটের পেইন্টিংও করতাম। মনে আছে, বিশ্বকর্মা পুজোর সময় এরকম প্রচুর আঁকতাম। টেরাকোটার ওপর রঙের প্রলেপ লাগানো কতটা কষ্টকর ও কতটা সহজাত, তাও আমি দেখেছিলাম তখনই। এখনও আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায় সেই ছবি আঁকার পদ্ধতি।
বাবার ছিল মুড়ি-মুড়কি-চিঁড়ের দোকান। খাটের তলার হ্যারিকেন বা লম্ফ জ্বালিয়ে অনেক সময় আমি নিজের মতো করে নানা জিনিস বানাতাম। বাবা মাটি তুলে নিয়ে আসতেন গঙ্গা থেকে। ফেটে যাওয়া দেওয়ালে একবার ছোট করে লিখেছিলাম ‘শ্রী শ্রী দুর্গাপুজো’। দেখালাম, সে লেখা ক্রমে বড় হয়ে গিয়েছে। ছোট থেকেই জানতাম, পুতুল তৈরি করলে বিক্রি করতে পারব। যে কারণে ছোটবেলায় ঝুলনের পুতুল তৈরি করতাম। কালীপুজোয় রাক্ষসী তৈরি করতাম। বিক্রি করতাম সেসব। সেখান থেকে পয়সা পাওয়া যায়। এটা ওই ক্লাস ৪-৫। আমার শাগরেদ ভোলা, এখনও কুমোরটুলিতে থাকে, ও আর আমি, গোপনে এসব কাণ্ড ঘটাতাম। বাবা জানতে পারলে কী হবে, ভয় পেতাম, যদিও বাবা কখনও মারেননি, বকেননি। বরং আমার শিল্পচর্চাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন চিরকাল।
প্রিয় পাঠক, এই আমার ছোটবেলা। এই আমার ছেলেবেলার আবহাওয়া। এই ঝুলনের পুতুল, এই প্রতিমার মাটি, রঙের প্রলেপ এইসব আমার শরীরে ও মনে আজও রয়ে গিয়েছে। শিল্প আমার মধ্যে ঢুকে পড়েছে আমার চারপাশের আটপৌরে হাওয়াবাতাস থেকে। আমি চেয়েছি, এই প্রথম পর্বের লেখায়, সেই হাওয়া আপনাদেরও গায়ে এসে লাগুক। সেই মাটির গন্ধ আপনারা পাচ্ছেন তো?
(চলবে)