শান্তিনিকেতনের উপাসনাগৃহে পাঠের অংশ সাধারণত নির্বাচিত হয়ে থাকে রবীন্দ্রনাথের ‘মন্দির-ভাষণ’ তথা ‘ধর্ম্ম ব্যাখ্যান’ সংকলন-গ্রন্থ ‘শান্তিনিকেতন’ থেকে। কৈশোরে যে পাঠ সম্পূর্ণ দুর্বোধ্য ছিল, পরে বোধ্য হয়েছে তারা। ব্যক্তিবিশেষের পাঠ লেখাটিকে সুবোধ্য অথবা দুর্বোধ্যতর করে তোলে। সেটা পাঠকের উচ্চারণ-কণ্ঠস্বরে নয়, তাঁর নিজের বোধের গভীরতার ওপর নির্ভরশীল বেশি। ‘রোববার.ইন’-এর সম্পাদক মণ্ডলী রবীন্দ্রনাথের উপাসনাচিন্তাকে লিখিতভাবে কিছুদিন ব্যাখ্যা করতে বলেছেন প্রতি সপ্তাহে। শুরু হল নতুন কলাম ‘উপাসনাগৃহ’, আজ প্রথম পর্ব।
১.
বিশ্বভারতীর উপাসনাগৃহের সাপ্তাহিক উপাসনা, শিশু-কিশোরদের পক্ষে, অন্তত আমাদের পক্ষে খুব সুখকর ছিল না। প্রথম কথা, ছুটির দিনেও বেশিক্ষণ ঘুমনোর সুযোগ কেড়ে নিত এই উপাসনা। রোজ খুব সকালে ঘুম থেকে উঠতেই হত ক্লাসে যাওয়ার জন্য। দ্বিতীয়ত, উপাসনার মূল অংশই ছিল একটি দীর্ঘ দুর্বোধ্য পাঠ। নিদ্রা সংবরণে সফল হওয়া খুব কঠিন ছিল, কারণ নিজেদের মধ্যে কথা বলাও যেত না, চুপ করে বসে থাকতে হত। পাঠ শেষে একটি মন্ত্র পড়তেন পাঠক-পাঠিকা, তথা আচার্য। মন্ত্রের প্রথম লাইন ‘ওঁ অসতো মা সদ্গময়; তমসো মা জ্যোতির্গময়।’ অর্থ বোঝার প্রয়োজন হয়নি, কী প্রিয় যে ছিল সবার, শব্দগুলো। ‘অসতো মা’ শুনলেই নড়েচড়ে বসতাম সকলে। যাক শেষ! তারপর শেষ গানটি, সে যে গানই হোক, কী মধুর যে লাগত!
মাঝে উচ্চশিক্ষার একটি অংশ আর কর্মজীবনের সূচনাপর্ব কলকাতায় কাটিয়ে আবার ফিরে এসেছিলাম শান্তিনিকেতনে, আটের দশকের শেষদিকে। নিজের সুচিন্তিত সিদ্ধান্তে। শান্তিনিকেতনের ‘নেশা’ লেগে গিয়েছিল অবচেতনে। তবে, রবি ঠাকুরকে ‘গুরুদেব’ বলাটা পেরে উঠিনি আজও।
বিশ্বভারতীর কাজে আমার প্রধান দায়িত্ব ছিল পাঠভবনের আবাসিক কিশোরদের অধ্যয়ন আর সামগ্রিক জীবনযাপনে সঙ্গী হয়ে কাছে থাকার। গুরুদায়িত্ব। যেমন কঠিন, তেমন মধুর। আমার নির্ধারিত বাসগৃহটি ছিল ছাত্রাবাস-প্রাঙ্গণ সংলগ্ন। শান্তিনিকেতন আশ্রমের প্রায় প্রাণকেন্দ্রে। এমন সৌভাগ্যের কর্মজীবনে ‘বাধ্যতামূলক’ রয়ে গেল নিজের কৈশোরের দিনলিপি। এবং অবশ্যই বুধবারের সাপ্তাহিক উপাসনা।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
গানের দায়িত্ব সংগীতভবনের শুধু নয়, পাঠভবন, শিক্ষাসত্র, বিনয়ভবনের মতো অন্যান্য ভবনেরও থাকে ঘুরে-ফিরে নির্ধারিত ছন্দে। পাঠের তথা পৌরহিত্যের দায়িত্ব নির্দিষ্ট করেন একটি সমিতি। প্রতি পর্যায়ের জন্য একবার করে সদস্যরা মিলিত হয়ে পরবর্তী পর্যায়ের তালিকা তৈরি করেন। গ্রীষ্মের ছুটি থেকে শরতের ছুটি– যেমন একটি পর্যায়। লম্বা ছুটিগুলিতে সাপ্তাহিক উপাসনা বন্ধ থাকে। সমিতি-নির্ধারিত তালিকা অনুসারে নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের দায়িত্বের কথা জানানোর কাজটি করেন বিশ্বভারতীর জনসংযোগ আধিকারিক।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
পরিণত বয়সে নিজের কৈশোরকে সশরীরে কাছে ফিরে পেয়ে, সমস্ত পরিচিত অভ্যাসে উল্টো দিক থেকে আলো এসে পড়তেই, অর্ধেক দেখা অনেক কিছুর সম্পূর্ণতর রূপ স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল নিজের উপলব্ধিতে। বুধবার সাপ্তাহিক উপাসনা আয়োজনের ব্যবস্থাপনাটি চিনলাম। প্রার্থনার কাঠামো নির্ধারিত। প্রথম গানের পর সকলে উঠে দাঁড়িয়ে সমবেত মন্ত্রোচ্চারণ, তারপর দ্বিতীয় গান। দ্বিতীয় গানের পর পাঠ, শেষ হবে, ‘অসতো মা সদ্গময়’ মন্ত্রে। পাঠের পর তৃতীয় এবং শেষ গান।
গানের দায়িত্ব সংগীতভবনের শুধু নয়, পাঠভবন, শিক্ষাসত্র, বিনয়ভবনের মতো অন্যান্য ভবনেরও থাকে ঘুরে-ফিরে নির্ধারিত ছন্দে। পাঠের তথা পৌরহিত্যের দায়িত্ব নির্দিষ্ট করেন একটি সমিতি। প্রতি পর্যায়ের জন্য একবার করে সদস্যরা মিলিত হয়ে পরবর্তী পর্যায়ের তালিকা তৈরি করেন। গ্রীষ্মের ছুটি থেকে শরতের ছুটি– যেমন একটি পর্যায়। লম্বা ছুটিগুলিতে সাপ্তাহিক উপাসনা বন্ধ থাকে। সমিতি-নির্ধারিত তালিকা অনুসারে নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের দায়িত্বের কথা জানানোর কাজটি করেন বিশ্বভারতীর জনসংযোগ আধিকারিক। চিঠির বয়ানে উল্লেখ থাকে– পাঠ ‘মহর্ষিদেব অথবা গুরুদেবের রচনা থেকে নির্বাচিত অংশ (সাত থেকে দশ মিনিট)’। অংশ নির্বাচনের দায়িত্ব দায়িত্বপ্রাপ্তের। পাঠের সঙ্গে মানানসই তিনটি গান নির্বাচনের সুযোগও থাকে। পাঠের অংশ সাধারণত নির্বাচিত হয়ে থাকে ‘শান্তিনিকেতন’ থেকে। রবীন্দ্রনাথের ‘মন্দির-ভাষণ’ তথা ‘ধর্ম্ম ব্যাখ্যান’ সংকলন-গ্রন্থ।
কৈশোরে যে পাঠগুলি সম্পূর্ণ দুর্বোধ্য ছিল, বুঝলাম বোধ্য হয়েছে তারা। আর বুঝলাম, ব্যক্তিবিশেষের পাঠ লেখাটিকে সুবোধ্য অথবা দুর্বোধ্যতর করে তোলে। সেটা পাঠকের উচ্চারণ-কণ্ঠস্বরে নয়, তাঁর নিজের বোধের গভীরতার ওপর নির্ভরশীল বেশি।
উপাসনার শেষে ছাত্রাবাসে ফেরার পথে সহযাত্রী কিশোরদের সঙ্গে ‘আজ কী বুঝলি’ উত্থাপন করে নিজের কাছে পাঠের অংশটি ঝালিয়ে নেওয়ার প্রয়াস করতাম।
‘রোববার.ইন’-এর সম্পাদক মণ্ডলী সেই খেলাটি লিখিতভাবে কিছুদিন করতে বলেছেন প্রতি সপ্তাহে। ব্যাখ্যানের ব্যাখ্যা, মানে দুধে জল মেশানো। বিদগ্ধ পাঠকেরা আমার ধৃষ্টতা মার্জনা করবেন। আপনাদের প্রয়োজনীয় আপত্তি আশা করি সম্পাদক মণ্ডলীকে বিরত করবে। অন্যথায়, আপনারাও আমার পাপের ভাগী হবেন।