কলকাতার এক নামী হোটেলে লেবাননের খাবারের উৎসব হচ্ছিল শুনে হাজির হলাম এই মেগাস্টার খাবারের লোভে। মুখে দিয়ে চমকে গেলাম, ভাবলাম ভুল হচ্ছে না তো? আর একপ্লেট নিয়ে মুখে দিতে বুঝলাম ও হরি, এ তো আমার অতি পরিচিত স্বাদ, ছোটবেলা থেকে আমার দুর্বলতা এর প্রতি। আদি অকৃত্রিম বেগুন সেঁকা!
ঢাকায় তখন রাজীবের বাড়িতে থাকি। রাজীব শহরের বাইরে– ওর দুই কলেজ পড়ুয়া ভাগনের সঙ্গে থাকি, রান্না করে খাই। এক শুক্রবার দুই ভাগনে সারা রাত ‘গ্র্যাভিটি’ নিয়ে ব্যস্ত থেকে দুপুরেও যখন তারা ঘুম থেকে উঠল না, ঠিক করলাম শুধু ভাত বানিয়ে নেব, আর কিছু রান্না করব না। রাজীবের বাড়ি ধানমণ্ডির এক প্রান্তে টালি রোড যে অঞ্চলে, খাবারের ঠেলা সবসময়েই দাঁড়িয়ে থাকে; সেখান থেকে ভর্তা কিনে এনে ভাত দিয়ে খেয়ে নেব। রাস্তায় নেমে ভর্তার বিক্রেতার কাছে ভর্তা চাইতে সে প্রশ্ন করল, কীসের ভর্তা– বলে শাক, বেগুন, রসুন, টমেটো, মাছ, মাংস ইত্যাদির এক লম্বা ফিরিস্তি দিল।
মাছের ভর্তা আগে শুনিনি, তাই চেখে দেখার শখ হল। মাছের ভর্তা চাইতে এবার প্রশ্ন: কী মাছের– টাকি মাছ, আড় মাছ, শুঁটকি মাছ– কীসের ভর্তা নেব। সেই হলুদ বাল্ব জ্বলা শৈশবের শীতের রাত থেকে আমার বেগুন সেঁকা, বেগুনের ভর্তার সঙ্গে বন্ধুত্ব। সেই জমানায় ‘শীতের সবজি’ বলে কিছু ছিল, সারা বছর ধরে ধনেপাতা, টমেটো, কপির দেখা পাওয়া যেত না। শীতের রাতে বাবার প্রিয় খাবার ছিল তোলা উনুনে বেগুন সেঁকা, আর তাতে টমেটো কুচি ধনেপাতা কুচি পেঁয়াজ কুচি দিয়ে মাখা। তাই দিয়ে গরম রুটি খেয়ে শীতের লেপের তলায় ঢুকে পড়া এক সুখস্মৃতি। উদয়পুরে রাতের প্রিয় খাবারও ছিল সেই বেগুনের ভর্তা আর গরম রুটি। তাই স্বাভাবিকভাবেই সব প্রলোভন শেষ পর্যন্ত জয় করে ফেলে প্রিয় বেগুনের ভর্তা কিনে এনে তা দিয়ে ভাত খেয়েছিলাম।
সুস্মিতাকে এই অভিজ্ঞতার কথা বলতে সে অবাক হয়ে বলল, ‘সে কী দাদা! তুমি ইলিশের ল্যাজার ভর্তা খাওনি? তোমার তো তাহলে জীবন বৃথা!’ বউদির গোঁফের কথা পনুর চিঠিতে পড়েছিলাম, কিন্তু তাই বলে ইলিশ ল্যাজার ভর্তা! আমি বিশ্বাস করিনি বলে সুস্মিতার আঁতে লাগল আর কয়েক দিনের মধ্যেই আমাকে মাওয়ায় নিয়ে গেল এই ভর্তা খাওয়ানোর জন্য। পরিচিত দোকানে নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ বাদেই ল্যাজার ভর্তা বানানোর তরিকা দেখার জন্য আমাকে ডাকল। বাকি মাছ ভাজা হয়ে গিয়েছে ততক্ষণে– শুধু ল্যাজাটা পড়ে আছে। দোকানের মালিক ফজলুল ভাজা ল্যাজাটা আড়াআড়ি কেটে ফেলল– মাঝের বড় কাঁটাটা ফেলে দিল। তারপর ল্যাজাটাকে টুকরো টুকরো করে হামানদিস্তেতে ফেলে পিষতে লাগল আর সমানে ছোট ছোট কাঁটা ফেলে দিতে লাগল। খানিক বাদে কুচো পেঁয়াজ, শুকনো লঙ্কা, অল্প ভাজা জিরে, জলপাই আচারের তেল আর সরষের তেল ফেলে দিল হামানদিস্তেতে ফেলে সমানে পিষতে লাগল। খানিক বাদে যেটা বের হল, সেটা দেখে মস্ত জ্ঞানীও ইলিশ ল্যাজা বলতে কয়েক বার ভাববে। একথালা ভাত খেয়েছিলাম সেই ভর্তা দিয়ে সেদিন, কিন্তু বাড়ি ফিরে এসে আবার ভর্তা নিয়ে হোঁচট– আলু আর বেগুনের ভর্তা পেরিয়ে কিছুতেই এগতে পারিনি দীর্ঘদিনের পরিচিতির জন্য।
মধ্যপ্রাচ্যের দুই নামী খাবার হামুস আর বাবাগানুস্-এর নাম অনেক শুনেছি। লেবানিজ খাবার নাকি অতি সুস্বাদু আর তার মধ্যে এই দুই পদ কলকাতা ময়দানের কৃশানু-বিকাশ। বাবাগানুসের নাম এক হাজার বছর আগের আরবের পুঁথিতেও উল্লেখ রয়েছে, আর তার সঙ্গে আছে হরেক কিসিমের গল্প। কেউ বলেছে এক মেয়ে তার দন্তহীন বাবার জন্য এই পদ বানিয়েছিল, তাই নাম বাবাগানুস, আবার কেউ বলে হারেমের সুন্দরীরা বাদশার জন্য আদর করে এই পদ বানিয়েছিল। এই বাবাগানুস্ এতই জনপ্রিয় যে, তুর্কি বা লেবাননের মানুষ আবেগ-তাড়িত হয়ে পড়ে। আমাদের কৃষ্ণের মতো এরও অনেক নাম– আর্মেনিয়াতে মুতাবাল, রোমানিয়াতে সালাতা-দ্য-ভিনেত। ইরাক থেকে মিশর– এই পুরো অঞ্চলের শাসন করে বাবাগানুস্ আর তার দোসর হামুস। কলকাতার এক নামী হোটেলে লেবাননের খাবারের উৎসব হচ্ছিল শুনে হাজির হলাম এই মেগাস্টার খাবারের লোভে। মুখে দিয়ে চমকে গেলাম, ভাবলাম ভুল হচ্ছে না তো? আর একপ্লেট নিয়ে মুখে দিতে বুঝলাম ও হরি, এ তো আমার অতি পরিচিত স্বাদ, ছোটবেলা থেকে আমার দুর্বলতা এর প্রতি। আদি অকৃত্রিম বেগুন সেঁকা! সেই পেঁয়াজ, রসুন, লেবুর রসের কয়েক ফোঁটা সবই আছে এতে– আর তাতে শুধু তিলবাটা যোগ করা হয়েছে। রুটির সঙ্গে তারিয়ে তারিয়ে বাবাগানুস্ খেতে দেখে লেবানিজ শেফ আমাকে এসে একমুখ হেসে জিজ্ঞাসা করল ইংরেজিতে, ‘কেমন লাগছে আমাদের বাবাগানুস্?’ মুখে খাবার নিয়ে চোখ বন্ধ করে উত্তর দিলাম, ‘দুর্দান্ত! আমাদের এক নামী কবি এই নিয়ে গানও লিখেছেন– পান্তা ভাতে টাটকা বেগুনপোড়া!’
আগের সপ্তাহে বলেছিলাম না, নামে অনেক কিছু এসে যায়!