পাশের বাড়ির ঝনঝন করে বাসন পড়ার আওয়াজে, বাবা-মার ঝগড়ার মাঝেও আমি ভেবে গেছি আমার একার পৃথিবীর কথা। অথচ কী অদ্ভুত– যে পাড়া, যে মাঠ, পার্থেনিয়ামের জঙ্গল ছেড়ে আমি বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলাম বরাবর, আজকাল সবথেকে বেশি মনে পড়ে সেসবের কথাই।
২.
আমার যেটুকু কুড়িয়ে-কাড়িয়ে গুছিয়ে রাখা, তা যেন আমার বড় নিজের। খরচ করতে মায়া। আমার ফ্রিজ ম্যাগনেট, আমার রংবেরঙের মুখোশ, আমার কফি মাগ, লাল টাইলসের রান্নাঘর, আমার রাস্তার ধুলো, জানলা দিয়ে উঠে আসা মাধবীলতা, জুঁই ফুলের গাছ, আর সবার প্রবেশ নিষেধ। সারা দিন কাজ সেরে বাড়ি ফিরে এসে নিঃশব্দে তালা খুলে আমার শ্বাসে ফ্ল্যাটের নিস্তব্ধতা কাটাব, সুইচ অন করব এক নিশানায়, অল্প আলোয় পছন্দের কোনও এক কোণে দেওয়ালে পিঠ লাগিয়ে শুয়ে থাকব যতক্ষণ ইচ্ছে, বালিশের পাশে, পোড়া সিগারেট স্তূপাকৃত করব, কারও অভিযোগের তাড়া নেই যেখানে।
আমার খড়দহর বাড়িতে আমার ছোট্ট পড়ার ঘরে, মুখের সামনে পড়ার বই খুলে, শচীন, সৌরভ, জাদেজা, আফ্রিদির পোস্টারের মাঝে, পাশের বাড়ির ঝনঝন করে বাসন পড়ার আওয়াজে, বাবা-মার ঝগড়ার মাঝেও আমি ভেবে গেছি আমার একার পৃথিবীর কথা। কোনও এক জাদুবলে আমার স্বপ্নে দেখা পৃথিবী সত্যি করে ধরা দিল একদিন আমার হাতের মুঠোয়। অথচ কী অদ্ভুত– যে পাড়া, যে মাঠ, পার্থেনিয়ামের জঙ্গল ছেড়ে আমি বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলাম বরাবর, আজকাল সবথেকে বেশি মনে পড়ে সেসবের কথাই। চোখ বন্ধ না করেও দেখতে পাই সেই সময়ের মানুষের মুখ, পাড়ার দোকান, অলিগলি সমস্ত কিছু। ওদিকে যখন যাই মাঝে মাঝে, গাড়ি থেকে মুখ বাড়িয়ে আমার মস্তিষ্ক খোঁজার চেষ্টা করে কিছু মুখ। কিন্তু সব বড্ড অচেনা, সারা পাড়া জুড়ে শুধু ফ্ল্যাট আর ফ্ল্যাট, জারুল গাছটা কেটে দিয়ে মোবাইল রিপেয়ারিং সেন্টার হয়েছে। পাড়ার লাইব্রেরিটা আলিপুর চিড়িয়াখানার সিংহর থেকেও বেশি অসুস্থ। পাড়ার মাঠটাকে এখন আর অত বড় বলে মনে হয় না।
আমাদের বাড়িতে বহু মানুষের আনাগোনা ছিল, যত বুড়ো হচ্ছি, ছোটবেলার আদরের মানুষগুলোর কথা বেশি করে মনে পড়ছে। জীবন মামা প্রায়দিনই আসত আমাদের বাড়িতে। মা রান্নাঘরের সামনে মোড়ায় বসে গল্প করত। আমার সঙ্গে খুব ভাব, জীবন মামার কোলে চড়ি, পিঠে চড়ি, টুকটাক আবদার করি। ইদের সময় একবার আমাকে নিয়ে গিয়েছিল নিজের বাড়িতে। জীবন মামার ভাল নাম আজগর আলি। একবার আমায় কুকুরে কামড়াল, বনধের দিন আজগর আলি সাইকেলে বসিয়ে ইঞ্জেকশন দিতে নিয়ে গিয়েছিল হাসপাতালে।
আসত ভাইয়া, মাসে একবার করে দুপুরবেলায় জুতো সেলাই করতে, বিহারের মানুষ। আমরা ‘ভাইয়া’ বলেই ডাকতাম। মা-বম্মা বলত, ভাইয়াকে নাকি অনিল কাপুরের মতো দেখতে। ভাইয়া জুতো, ব্যাগ সারাই করতে করতে দেশের গল্প শোনাত আমাদের।
এলআইসি করতে আসত নির্মলদা। আসত বউদিমাইমা। মার কাছে সংসারের অভাবের গল্প করত। দুঃখ ছিল অনেক, কিন্তু সুখেরও অভাব ছিল না। হাসি মুখেই থাকতে দেখেছি সবসময়। পাপন, অরুন্ধতীদির মা, নিবেদিতার মা– আরও কত মায়ায় ঘেরা সব মানুষ। বাড়িতে আসার কোনও নিয়মবিধি ছিল না সেই সময়। জানিয়ে আসার দরকার পড়ত না কারও। বাড়ির পাশ দিয়ে গেলেও একবার ঢুঁ মেরে যাওয়াটাই ছিল রেওয়াজ, অধিকার ছিল ভালবাসার। শনিবার ১২টা নাগাদ আসত এক বুড়িদিদা পাড়ায় ভিক্ষা করতে। কোনও এক শনিবার না এলেই মার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ত। দিদার জন্য বরাদ্দ ছিল একটা টাকা, কিংবা এক কৌটো চাল আর দুটো আলু। বাড়িতে যে-ই আসুক, গল্প চলত অনেকক্ষণ, সঙ্গে চা, কখনও কখনও বড়জোড় মামলেট ভাজা।
আমি একা থাকি, খুব কম লোকই আসে বাড়িতে। আমার সুন্দর সাজানো ছোট ফ্ল্যাট, কেউ আমাকে না জানিয়ে চলে এলে বিরক্তই হই। ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিই, ফোন না করে আসায় আমি অসন্তুষ্ট। বাড়ি ভর্তি জামাকাপড়, অফুরন্ত জিনিসপত্রের মাঝে খুঁজে পাই না অর্ধেক জিনিসই। যত্ন কমে গিয়েছে সবকিছুর ওপর থেকেই। আগে কম ছিল, অভাব ছিল, যত্নের দায় ছিল অনেক বেশি। রাত্রিবেলায় কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এলে ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত, আলু সেদ্ধ, আর ঘিয়ের গন্ধ পাই এখনও।