একলা দার্জিলিং। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ছিলাম। দার্জিলিংয়ের ছোট ছোট বাঁকে। অচেনা ঢালু রাস্তায়। কুকুরের ঘুমে। হঠাৎ পাহাড় মেঘ সরিয়ে মাথা দেখাল। ইশকুল থেকে ফেরা বাচ্চাদের হইচই। বন্ধ হয়ে যাওয়া হোটেল। দুম করে ওঠা একটা সিঁড়ি। দেওয়ালে হেলান দেওয়া প্রেমিক প্রেমিকা। মোমোর দোকান থেকে উঠে আসা ধোঁয়া। আস্তাবল। ডাল্লে লঙ্কার বাজার।
ছোটবেলা থেকেই ঘুরে বেড়ানোয় আমার কোনও লাগাম নেই। কিন্তু তখন, বাধ্যত, বাড়ির সঙ্গেই। প্রচুর ফ্যামিলি ট্রিপ হত। প্রথম যখন ‘সোলো’ বেড়ানোর কথা ভাবলাম, খুব প্ল্যান-ট্যান করিনি। আসলে ভেবেছিলাম, কয়েকজন মিলে গেলেই হয়। কিন্তু কাউকেই পাইনি। কেউ ফাঁকা ছিল না। এদিকে ইচ্ছে একশোভাগ। জীবনের অনেক হুট করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতোই, এই সোলো ট্রিপের ব্যাপারটাও দুম করেই হয়েছিল! প্রথমেই টিকিট কেটে ফেলেছিলাম। দার্জিলিংয়ের। দার্জিলিং, কারণ চেনা পরিসর। ছোটবেলা থেকেই জায়গাটা আমার খুব কাছের, নিজের একটা জায়গা। ফলে একটা কনফিডেন্স ছিল। তাছাড়া, ছোটবেলা থেকেই আমার সাহসের থেকে দুঃসাহসটাই বেশি– ফলে বেরিয়ে পড়ি, দেখা যাবে কী হয়!
যে কোনও জায়গায় বেড়াতে গেলেই, লোকজনকে আগে একটা লিস্ট করে ফেলতে হয়, কী কী নেব, ওষুধপত্র, জামাকাপড়, আরও হাবিজাবি বস্তু। আমাকে যেহেতু শুটিংয়ের জন্য প্রায়শই এদিক-সেদিক যেতে হয়, তাই এ ব্যাপারে আমি পোক্ত। ছোট ছোট জিনিসও ভুলি না। যে ব্যাপারে আমি চিন্তিত ছিলাম, সত্যি বলতে সেটা নিরাপত্তা। একা একটা মেয়ে বেরিয়ে পড়েছে বাড়ি থেকে, কীরকম লোকজন সহযাত্রী হিসেবে পাব, এই সমস্ত আর কী। ট্রেনেই গেছিলাম, কারণ ট্রেন জার্নিটা আমার দিব্যি লাগে।
ছিলাম পাইনরিজে। টাইট বাজেট ট্রিপ। বন্ধুরা বলেছিল, বেছে বেছে হন্টেড হোটেলেই! বলেছিলাম, সে থাক, কেউ কাউকে বিরক্ত না করলেই হল। বিরক্ত করেওনি।
নভেম্বরের শেষের দিক। শীত আসছে আসছে। চোখের সামনে এই আশ্চর্য পুরনো শহর। সমস্ত বাঙালিরই খুব প্রিয়। পাহাড় বেছে নিয়েছিলাম, কারণ আমার মনে হয় সমুদ্রের ধারে যতক্ষণ বেশি একলা বসে থাকতে পারব, তার চেয়ে পাহাড়ের সামনে চুপচাপ বসে থাকতে পারব আরও বেশি। ওই একলা, স্তব্ধ ব্যাপারটা পাহাড়ে আছে। সমুদ্র তো নিজেই চঞ্চল, পাহাড় চুপচাপ।
খুব ছোটবেলায় চেপেছিলাম টয় ট্রেন। পরেও অনেকে মিলে যখন দার্জিলিং গিয়েছিলাম তখন টয় ট্রেনে চাপা হয়নি। কিন্তু মনের মধ্যে রয়ে গিয়েছিল, দু’পাশে অনেক সবুজ, তার মাঝ দিয়ে শিস দিতে দিতে এগিয়ে চলেছে ছোট ট্রেন। পাহাড় কাটা রাস্তা। রঙিন বেঁটেখাটো ঘরবাড়ি। আমি এই একলা চলো রে ট্রিপটায় হাঁটতে বেরিয়েছিলাম বিকেলে, উদ্দেশ্যহীনভাবেই। শেষ ট্রেন ছাড়ছে তখন। কী একটা মনে হল, ভাবলাম উঠে পড়ি, আর উঠেও পড়লাম। ঘুমে পৌঁছে নামলাম। আশপাশ বদলে গিয়েছে অনেকটা, কিন্তু টয় ট্রেন শুধু ঘুম পর্যন্ত যায়নি, আমাকে নিয়ে গিয়েছিল আমার ছোটবেলার সেই সবুজ দার্জিলিংয়ে, মনের ভেতর ভেতর। ‘জয়িস পাব’-এর পুরনো জায়গাটায় গিয়েছিলাম। সেখানের কিছু স্পেশাল খাবারদাবারও খেয়েছিলাম বলে মনে পড়ছে।
মজার ব্যাপার, একলা গিয়েছিলাম। একলা ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। কিন্তু একাকিত্ব ছিল না কোথাও। মনে আছে, গ্লেনারিজে একটা টেবিলে বসে, বই পড়ছিলাম। একটা মেয়ে এসে বলল, ‘তুমি কি একা? তাহলে একটু বসি তোমার সঙ্গে?’ জানতে পারলাম, মেয়েটি মুম্বইয়ে থাকে। সিনেমাটোগ্রাফার। এবং হাতে কোনও কাজ নেই– বেকার। আমিও বললাম, আমি অভিনেত্রী, হাতে কোনও কাজ নেই, আপাতত আমিও বেকার! পাশের টেবিলে একদল ছেলেমেয়ে গানবাজনা করছিল। তাদের সঙ্গেও আস্তে আস্তে বন্ধুত্ব হল। রাত প্রায় সাড়ে ১১টার সময়, গ্লেনারিজ থেকে আমাদের গোটা ১২ জনকে বলা হয়েছিল, সময় শেষ, এবার আপনারা আসুন। এই একলা টেবিল থেকে, ১২জন বন্ধু বাগিয়ে বেরনো– এটা একলাটি একলাট্রিপ না হলে হত!
হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ছিলাম। দার্জিলিংয়ের ছোট ছোট বাঁকে। অচেনা ঢালু রাস্তায়। কুকুরের ঘুমে। হঠাৎ পাহাড় মেঘ সরিয়ে মাথা দেখাল। ইশকুল থেকে ফেরা বাচ্চাদের হইচই। বন্ধ হয়ে যাওয়া হোটেল। দুম করে ওঠা একটা সিঁড়ি। দেওয়ালে হেলান দেওয়া প্রেমিক প্রেমিকা। মোমোর দোকান থেকে উঠে আসা ধোঁয়া। আস্তাবল। ডাল্লে লঙ্কার বাজার।
গ্লেনারিজ বা কেভেন্টার্স তো নিয়মের মতো। যেতেই হবে দার্জিলিং গেলে। এছাড়া, হিমালয়ান ক্যাফে নামে একটা ক্যাফে এক্সপ্লোর করেছিলাম। দারুণ সব খাবার সেখানে। রাস্তার ধারে, একটা নেপালি ছাউনি দেওয়া ছোট্ট দোকানে, অসামান্য থালি খেয়েছিলাম খুব আরাম করে।
একা বেড়াতে যাওয়া মানে তো শুধুই একা বেড়াতে যাওয়া নয়। নিজে নিজের দায়িত্ব নিতে শেখা। নিজের সঙ্গে কথা বলা। নিজেকে সময় দেওয়া। আমার মনে হয় পাহাড় যত উঁচুই হোক না কেন, সে আমাদের ঝুঁকতে বলে, ‘হাম্বল্’ হতে বলে। বিশাল পাহাড়ের সামনে দাঁড়িয়ে মানুষের যে শ্লাঘা, তা ঝরে যায়।
প্রথম সেই সোলো ট্রিপে নিজের জন্য কী আর কিনব? বেশি কিছু না। সামান্য চাদর একটা। একটা দার্জিলিং, যা জড়িয়ে রাখা যায় গায়ে, যে কোনও শীতে। একলা লাগলেই।