অজাতশত্রু অমলদা সবকিছু হাসিমুখে মেনে নেন। মানুষটা যে কতটা সৎ, সেটা অনেকেই জানেন, যাঁরা তাঁর ঘনিষ্ঠ হয়েছেন। আমাকে একবার ওঁর পরিচিত একজনের বইয়ের প্রচ্ছদ করতে বলেছিলেন। কাজটা হয়ে যাওয়ার পর পারিশ্রমিক নিজে আমার পকেটে গুঁজে দিয়েছিলেন।
অমলদার সঙ্গে আমার একটা ফোটোগ্রাফ সোনালি ফ্রেমে বাঁধানো আছে আমার কৃষ্ণনগরের বাড়ির বারান্দায়। ৩২ বছর আগের তোলা। তখন একটা সাপ্তাহিকে আমরা কাজ করতাম। প্রথম আলাপ সেই দপ্তরেই। একদিন অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা ধারাবাহিকে (সংশয়) আমি ইলাস্ট্রেশন করছিলাম। লম্বা, ছিপছিপে এক ভদ্রলোক এলেন। হাফশার্ট পরা, হাতে একটা চামড়ার ফোলিও ব্যাগ। পাশের চেয়ারটিতে বসলেন। পকেট থেকে চারমিনারের প্যাকেট বের করে টেবিলে রাখলেন। মানস ভাণ্ডারী আলাপ করিয়ে দিলেন। অমলদা! অমল চক্রবর্তী! আরে সেই অমলদা! ‘যুগান্তর’-এর রোজনামচার অমল?
সেই প্রথম পরিচয়। ‘কী আঁকছ? বাঃ খুব ভাল।’ এই ছিল তাঁর প্রথম অভিব্যক্তি। আমি মুগ্ধ। এমনিতেই গ্রামের ছেলে। তার ওপর অমল চক্রবর্তীকে সামনে থেকে দেখছি। এত সহজ-সরল একটা মানুষ! অবাক হয়ে গেলাম প্রথম সাক্ষাতেই। সেই শুরু। আমার মতো অর্বাচীনেরও প্রশংসা করতে ছাড়লেন না।
সত্যজিৎ রায়ের চলে যাওয়ার পর সেই সাপ্তাহিকে পাতাজোড়া একটা পোর্ট্রেট করেছিলাম ওয়াটার কালারে। অমলদা বলেছিলেন– ‘তোমার জয় হোক।’ তারপর যখনই কোনও কাজ ভাল লাগত, ফোন করে বলতে এটা। সেই সাপ্তাহিক কিছুদিন পর বন্ধ হয়ে যায়। অমলদার সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়।
তারপর ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এ যাত্রা শুরু। প্রথম দিন থেকেই অমল আলোর বিচ্ছুরণ। যা এখনও সমান উজ্জ্বল। আমিও সেখানে ফ্রিল্যান্স ইলাস্ট্রেটর হিসেবে কাজ করতাম। আবার অমলদার সঙ্গে দেখা, আড্ডা। বেলেঘাটার সেই অফিসে, কখনও চায়ের দোকানের আলোচনায় ডেভিড লো-র কথা, আর. কে. লক্ষণের তুলির ব্যবহারের কথা বারবার বলতেন। আমি শুধু শুনতাম তাঁর প্রিয় শিল্পীদের কাজের ধরণ, যা তাঁকে মুগ্ধ করত।
একবার এক বিকেলে অফিস থেকে বেরিয়ে অমলদা বললেন– ‘চলো, তোমায় একটা এগজিবিশনে নিয়ে যাই। গেলাম হাজরায়। একটা প্রদর্শনী চলছিল বিদেশি কয়েকজন শিল্পীর ইলাস্ট্রেশনের। অনেকগুলো ছবির ডিটেলিং আমাকে ধরে ধরে বুঝিয়েছিলেন। লাইন ড্রয়িং-এ আলোর প্রভাব কীভাবে পরে, সেটা অমলদা সেদিন বুঝিয়েছিলেন। ছবিতে একটা গতি সবসময় রাখার চেষ্টা ক’রো– এটা বলতেন।
শ্যামবাজার বাটার মোড়ের চায়ের দোকানে অমলদা, শ্যামদুলাল কুণ্ডুদা কতদিন বিকেলের পর আড্ডা মেরেছি। সঙ্গে তেলেভাজা। তাঁর স্মৃতির ঝুলি থেকে বেরিয়ে আসত হিরন্ময় সব অভিজ্ঞতার কথা।
ভীষণ স্নেহ পেয়েছি মানুষটার কাছ থেকে। সেই স্নেহের দৌলতে অনেক ব্যক্তিগত আক্ষেপ, অভিমানের কথা আমাকে বলতেন। একটা সময়ে অনেকে কাজ করিয়ে নিয়ে উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেননি। আমাকে বলতেন– শান্তনু, এরা টাকা দিতে চায় না কেন বলো তো? অজাতশত্রু অমলদা সবকিছু হাসিমুখে মেনে নেন। মানুষটা যে কতটা সৎ, সেটা অনেকেই জানেন, যাঁরা তাঁর ঘনিষ্ঠ হয়েছেন। আমাকে একবার ওঁর পরিচিত একজনের বইয়ের প্রচ্ছদ করতে বলেছিলেন। কাজটা হয়ে যাওয়ার পর পারিশ্রমিক নিজে আমার পকেটে গুঁজে দিয়েছিলেন।
আগে থাকতেন শ্যামবাজার ডাফ স্কুলের পাশে। একটা ভাড়া বাড়িতে। কী একটা কাজে যেতে হয়েছিল। চেক লুঙ্গির ওপর টি-শার্ট পরে বেরিয়ে এসেছিলেন। সেবার বলেছিলেন– একদিন এসো, তোমাকে অনেকগুলো পুরনো কার্টুনের বই দেখাব।
গত বছর অমলদার নতুন ঠিকানায় এক সন্ধ্যায় আড্ডা দিতে গিয়েছিলাম। এখন উনি থাকেন বাগবাজারে। ফ্ল্যাটের যে ঘরে অমলদা ভাবেন, আঁকেন, পড়াশোনা করেন এবং এই বয়সে এসে মাঝে মাঝে এমনসব কিছু আমাদের উপহার দেন তাঁর অমন আলোর রেখায়, সেই ঘরে কিছুক্ষণ থাকার বড় সাধ হল। ডোরবেল বাজাতেই ওয়াকিং স্টিক হাতে এসে হাসি মুখে দরজা খুলে বললেন– এসো। দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হতে হতে এতটাই দুর্বল যে দুটো লেন্সের সাহায্য নিয়েও আঁকতে গেলে চোখে জল এসে যায়। আর আঁকতে পারেন না। কিছুক্ষণ দম নিয়ে আবার চেষ্টা। মাথার ভিতর চিন্তাগুলো ভীষণভাবে বেরতে চায় যে! এতদিন পর তাঁকে দেখে অবাক হয়ে গেলাম। শরীর বেশ ভারী হয়েছে। হাসিটা একইরকম। কফি খাওয়ালেন। তাঁর ‘অমল অ্যালবাম’-এর একটা কপিতে একটা কার্টুন এঁকে আমায় উপহার দিলেন। সেদিন এক চরম প্রাপ্তিযোগ ছিল আমার।
একটা সময় ছিল, যখন ‘প্রতিদিন’-এর কার্টুন এঁকে অফিসে এসে সন্ধেবেলা দিয়ে যেতেন। দেখা হত তখন মাঝেমধ্যে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে কষ্ট হত, দোতলায় বসে একটা কফি খেতেন। অতবড় মাপের মানুষটাকে দেখেছি লাজুক মুখে বসে একটা দুটো কথা বলে বাড়ি ফিরে যেতেন। একবার পায়ে বড় একটা অপারেশনের পর দীর্ঘদিন বাড়িতে বসেও কাজ করে গিয়েছেন। অফিস থেকে কেউ একজন বাড়িতে গিয়ে তাঁর ছবি নিয়ে এসেছে। করোনার সময় থেকে অনলাইনে তাঁর প্রতিদিনের ছবিটা পাঠিয়ে দেন তাঁর ছেলে অর্ক। সেই নিয়মই চলছে এখনও।
হঠাৎ দিন দশেক আগে অর্ক জানাল– বাবা হাসপাতালে। ভীষণ অসুস্থ। শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিয়ে নির্লজ্জের মতো জিজ্ঞেস করলাম– কোনও ছবি কি এঁকে রেখে গিয়েছেন? অর্ক বলল– দুটো ছবি এঁকেছেন, তবে ক্যাপশানটা লেখা হয়নি। পরের দিন দুরু দুরু বুকে ফোন করলাম অমলদা ধরলেন। কণ্ঠস্বর দুর্বল। ওরই মধ্যে বললেন, কাল ছবি পাঠিয়ে দেব। নিশ্চিন্ত হলাম।
অমলদার মতো শিল্পীর কাজের মূল্যায়ন করার মতো যোগ্যতা আমার নেই। তবে এতগুলো বছর একসঙ্গে তাঁর কাজ দেখার সুবাদেই অনেক কিছু শিখেছি। অমলদা সুস্থ থাকুন আরও অনেকদিন। আর তাঁর তুলির জোর আরও বাড়ুক– এই কামনা করি। এমন শিক্ষককে তাঁর ৯০তম জন্মদিনে আমার আভূমি প্রণাম।