বাদল সরকার, তাঁর চর্চা, চিন্তা, দর্শনকে কেন্দ্রে রেখে বৃত্ত বানিয়ে তোলা। এ বৃত্ত বানাতে লাগবে না কোনও এজেন্ট। লাগবে না ফুল-চন্দন-উপঢৌকন। চাই কেবল সতত গতিশীল চলমানতা। চাই হাত ধরার আশ্বাস, চোখ বন্ধ করে এনার্জি ‘পাস’ করে দিতে পারার ও ক্রমশ সেই এনার্জিকে বড় ও বৃহৎ করার প্রতিজ্ঞা। আর চাই ছয় মানুষের ১২ হাত। কেন-না মাটিতে ভেঙে পড়ার আগে ওই ১২ হাতে দুলে উঠবে জীবনের উড়াল। কেন-না, বাদল সরকার একটি বৃত্তের নাম, যিনি যেকোনও মুহূর্তে আপনার পাশটিতে এসে ফিসফিস করে বলে যাবেন, ‘আমি ফিরে আসব, লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি হয়ে ফিরে আসব।’
১.
বাদল সরকারের সঙ্গে আমার পরিচয় গড়িয়াহাটার মোড়ে। সাল ১৯৯৫। ফ্লাইওভার তখন সুদূর ভবিষ্যৎ। আমার সঙ্গে কাঁচরাপাড়া থেকে আরও চারজন গিয়েছেন। আমিই কনিষ্ঠতম এবং সবচেয়ে অর্বাচীন। সাউথ পয়েন্ট স্কুলে বাদল সরকারের পরিচালনায় কর্মশালা চলবে আগামী সাতদিন। আমরা চলেছি সেখানে। বলাই বাহুল্য, ‘ওয়ার্কশপ’ শব্দটি তখন অতি ব্যবহারে জীর্ণ হয়ে যায়নি। বাদল সরকার ‘কে’, তা-ও জানা ছিল না আমার। থিয়েটারও দেখা ছিল না।
সাউথ পয়েন্ট স্কুলের একটা বড় হল ঘরে ২১ জনের ওয়ার্কশপ শুরু হল। বাদল সরকার কে– তা না জানলেও, তিনি যে ‘কেউকেটা’, তা ঠারেঠোরে বেশ ভালোই বুঝতে পারছিলাম। কাজ শুরু হল যখন, আমরা বাদল সরকার-সহ গোল হয়ে দাঁড়ালাম। হাতে হাত সকলের। বৃত্ত।
২.
বৃত্ত। চোখ বন্ধ সকলের। হাতে হাত ধরা। একটা চাপ এ-হাত থেকে বাহিত হয়ে চলে যাচ্ছে পাশের হাতে। এক মানুষের হাত থেকে চলে যাচ্ছে অন্য মানুষের হাতে। চোখ বন্ধ করেও বুঝলাম চাপটা এবার আমার এক হাতে এলে। শ্বাস বন্ধ হল খানিকক্ষণ। চাপটা বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ করছে। পাশের জনের হাতে ‘পাস’ করে দিলাম আমি। বন্ধ চোখের অন্ধকারে চুপচাপ সব। কিছুক্ষণ পরে আবার আমার হাতে ওই চাপ। এ কী? এটা কি আগের চাপটাই? নাকি নতুন? কিন্তু নতুন করে চাপ তৈরি হওয়ার তো কথা নয়। কারণ ‘এক হাতে চাপ না পেলে তুমি পাশের জনকে চাপটা দেবে না’– এমনই হওয়ার কথা। এর একটাই অর্থ– আগের চাপ– যা আমি পাশের জনকে ‘পাস’ করে দিয়েছিলাম সেটাই হাত সুরে, হাত ঘুরে ঘুরে ফিরে এল আমার কাছে।
এর একটাই অর্থ হয়– চাপটা সকলের হাত ছুঁয়ে ফিরে এসেছে। আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।
পাঠিকা পাঠক-একটা অনুরোধ রাখবেন? একবারটি চোখ বন্ধ করবেন কয়েক সেকেন্ড? কল্পনা করবেন– আপনি একটা বড় বৃত্তের মধ্যে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছেন হাত ধরে। একটা চাপ, একটা এনার্জি… হয়ে বয়ে যাচ্ছে মানুষের হাতে গড়া বৃত্তের মধ্যে দিয়ে? বন্ধ করেছিলেন চোখ? ধরেছিলেন অন্তত পাশের দু’জনের হাত? আপনার স্পর্শের ছোঁয়াটি তাঁদের রাঙিয়ে আপনার কাছে এসে দুলে উঠল? আমার প্রাণে রং লেগেছিল সেদিন। আমি দুলে উঠেছিলাম।
৩.
একটা আড়াই ফুট উঁচু টেবিলের ওপরে দাঁড়িয়ে দুলে উঠলাম আমি। দুলতে দুলতে সটান ঝাঁপ দিলাম ভূমি বরাবর। পড়ে গেলাম আমি। ‘মাটি ছোঁয়ার আগে যেটুকু উড়াল, জীবন তো ওইটুকুই।’
আমি পড়ে যাচ্ছি। জীবনের উড়ালটুকু শেষ, এইবার মাটিতে ভেঙে পড়ব আমি। গুঁড়িয়ে যাব। অথচ তা হল না। অন্তত ছ’জন দু’হাত পেতে আমাকে লুফে নিল। ছ’জনের ১২টা হাত একযোগে একটা পূর্ণবয়স্ক মানুষকে এটুকু উচ্চতা থেকে পতন ধারণ করতে পারে। ফলে মাটিতে ভেঙে পড়লাম না আমি। আমি দুলতে থাকলাম ১২ হাতের ভেলায়। আমার উড়াল বেঁচে রইল অন্য মানুষের জোরে। এরা সেই মানুষ যারা বৃত্তে এসে হাত ধরে দাঁড়িয়েছিল। এরা সেই মানুষ যাদের অন্তর্গত রক্তের মধ্যে দিয়ে একটা স্পর্শের চাপ অনন্তকাল বয়ে যেতে পারে।
পরে জেনেছিলাম, অন্যের হাতে সঁপে দিয়ে ঝাঁপ দিয়ে মাটিতে পড়তে পারার আশ্বাসটুকুর নাম– ‘ট্রাস্ট গেম’। জীবনের উড়ালটুকুর জন্য অন্যের হাত– সে চেনা হলেও অচেনা লাগে, লাগেই। ‘অন্যের হাতে প্রাণমন সঁপি দিয়া বিছানা’ পাতার ভরসা এসেছিল যার থেকে তার নাম– বৃত্ত।
৪.
বৃত্ত– বৃত্তের আর এক নাম বাদল সরকার। দাস স্পার্টাকাসের বিদ্রোহ দমন করেছিল রোম। রোম থেকে আপ্পিয়ান সড়কে ছ’হাজার চারশো বাহাত্তরটা ক্রুশে ঝোলানো হয়েছিল স্পার্টাকুসদের। তবু মরার আগে তাঁরা বলেছিলেন, ‘আমি ফিরে আসব, লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি হয়ে ফিরে আসব।’
ফিরে এসেছেন কি তাঁরা? জানা যাবে যদি ক্রুশে পাওয়া যায় সত্যিকারের কোনও বৃত্ত। বাদল সরকারের নাটকে তাই দর্শকমন বৃত্তাকার। বাদল সরকারের ‘মিছিল’-এ তাই অভিনেতাদের সঙ্গে এসে যোগ দেন দর্শকেরা। ‘মিছিল’ চলতে থাকে। দর্শকদের অলক্ষ্যে এক সময় অভিনেতারা বেরিয়ে যান। দর্শকের ‘মিছিল’ তখনও চলতেই থাকে। এবং আশ্চর্য– সেই মিছিলের আকার হয়ে ওঠে একটি সম্পূর্ণ বৃত্ত। বৃত্তের মিছিল। দর্শকের মিছিল। অভিনেতার মিছিল। বাদল সরকারের মিছিল।
বাদল সরকার একটি বৃত্তের নাম।
……………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন প্রতীক দত্ত-র লেখা: মুখর হোক থিয়েটারের বাদল-অধিবেশন
……………………………………………………………………………………………….
৫.
অনেকে বলছেন, ‘শতবর্ষে বাদল পুজো শুরু হয়ে গেছে।’ কথাটা হয় তো খানিকটা সত্যি। তবু ওই আর কী– বাদল সরকারকে কিঞ্চিৎ কাছ থেকে দেখার সুবাদে অন্তত তাঁকে চিনতে পারার সামান্য সুযোগ আমার হয়েছে। গ্রামবাংলা ঘুরে দেখলে পুজো দেখা যায় সহজে। দেখলে দেখা যায়, দু’রকমভাবে পুজোর প্রচলন আছে। এক, দেবতার মূর্তি বা বিগ্রহকে সামনে রেখে মুখোমুখি বসে বা দাঁড়িয়ে বা শুয়ে পুজো করা। আর দুই, আরাধ্যকে কেন্দ্রে রেখে বৃত্তাকারে প্রদক্ষিণ করতে করতে আরাধনা করা। খেয়াল করে দেখবেন, বৃত্তের কেন্দ্রে যিনি আরাধ্যা, তিনি সাধারণত একমুখী নন। উদাহরণ শিবলিঙ্গ, ছলনের ঘোড়া, বিশেষ কোনও গাছ বা কবরে শায়িত পীর।
প্রথম ধরনের পুজোয় একজন উচ্চবর্ণীয় পুরোহিত যথা– ‘ব্রাহ্মণ’ বা ‘ইমাম’ ঈশ্বরের এজেন্ট হিসেবে কাজ করেন। ভক্ত এখানে এজেন্টকে রেমুনারেশন প্রদান করে নিশ্চিত থাকে। দ্বিতীয় ধরনের পুজোয় এজেন্ট থাকে না। ভক্তেরা বসে, শুয়ে বা দাঁড়িয়েও থাকে না। তারা সতত গতিশীল, ধাবমান। ফলত কর্মরত।
‘বাদল পুজো’ কেমন হবে? বিশেষত এই শতবর্ষ কালে? তাঁর মূর্তি বানিয়ে তাঁকে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করে ফুল বেলপাতা সহযোগে পুজো করা যাবে? ভক্তসংখ্যা নেহাত কম নয়। ঈশ্বর বাদল সরকারের জলজ্যান্ত এজেন্টও বাজারে বিদ্যমান– এটাও এক ধরনের পুজো।
দ্বিতীয় পুজোপদ্ধতিও হাতে রইল। বাদল সরকার, তাঁর চর্চা, চিন্তা, দর্শনকে কেন্দ্রে রেখে বৃত্ত বানিয়ে তোলা। এ বৃত্ত বানাতে লাগবে না কোনও এজেন্ট। লাগবে না ফুল-চন্দন-উপঢৌকন। চাই কেবল সতত গতিশীল চলমানতা। চাই হাত ধরার আশ্বাস, চোখ বন্ধ করে এনার্জি ‘পাস’ করে দিতে পারার ও ক্রমশ সেই এনার্জিকে বড় ও বৃহৎ করার প্রতিজ্ঞা। আর চাই ছয় মানুষের ১২ হাত। কেন-না মাটিতে ভেঙে পড়ার আগে ওই ১২ হাতে দুলে উঠবে জীবনের উড়াল। কেন-না, বাদল সরকার একটি বৃত্তের নাম, যিনি যেকোনও মুহূর্তে আপনার পাশটিতে এসে ফিসফিস করে বলে যাবেন, ‘আমি ফিরে আসব, লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি হয়ে ফিরে আসব।’