দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝখানের সময়, অভাব, বিদেশি শাসকের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার সংগ্রাম। ইউরোপে কমিউনিজমের উত্থান, নিজের দেশে কমিউনিস্ট আন্দোলন, বেকারত্ব, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, কৃষক আন্দোলন, তেভাগা, স্বাধীনতা প্রাপ্তি, দেশভাগ, রাষ্ট্রের যাত্রাপথ– এক মহাপৃথিবী পাল্টে দিয়েছে বাঙালির মহানগর, মননগর। এই পাল্টে যাওয়া মহানগরের বাসিন্দা কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
১৮৯৯ সালে উনিশ শতকের একেবারে শেষে জীবনানন্দ দাশের জন্ম। ওই সালটায় যেমন একটা শতক শেষ হয়ে এল, তেমনই বাংলা কবিতার একটা নতুন শতাব্দী শুরু হল। মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, ভারতীয় সাহিত্যের শাশ্বত ধারার মন। জীবনানন্দ এক নতুন আকাশ আঁকলেন। জীবনানন্দের এই আকাশে যতটা প্রকৃতি ছিল, ততটাই ছিল এক আধুনিক নাগরিক মন। জীবনানন্দের পরে ওই নাগরিক অভিব্যক্তি নানাভাবে ঘটেছে বাঙালি কবিদের, শিল্পীদের, চলচ্চিত্রকার, উপন্যাসিকদের মধ্যে।
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই নতুন বিশ শতকের এমনই এক জীবনানন্দ পরবর্তী কবি। কোনও কবিই জীবনানন্দ অনুসারী বলে নিজেকে তুলে ধরেননি। কিন্তু তিনের দশক থেকে ছয়-সাতের দশক অবধি যদি বাংলার কবিদের মোটা দাগে ভাগ করি, তাহলে একটা রাবীন্দ্রিক জগৎ আর একটা কমিউনিস্ট জগৎ– এরকম একটা ছায়ারেখা দেখি। দুইয়ের মধ্যে নানা রকম আসা-যাওয়া থেকেছে। এই দুই দলের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ঘরানা জীবনানন্দর নিজের। তিনিই বাংলা কবিতার নতুন ভুবন।
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আমার মনে হয় কমিউনিস্টদের কাছাকাছি, কিন্তু একইসঙ্গে যেন জীবনানন্দ ঘনিষ্ঠ। বীরেন চট্টোপাধ্যায় কি জীবনানন্দকে চিনতেন, হয়তো না। কিন্তু জীবনানন্দ তাঁর মনের গভীরে।
কবিতার নাম দিয়েছেন,‘জীবনানন্দের মহাপৃথিবী’। বাঙালি মনের মহাপৃথিবী পাল্টে গেছে বিশ শতকের দুইয়ের দশক থেকে। দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝখানের সময়, অভাব, বিদেশি শাসকের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার সংগ্রাম। ইউরোপে কমিউনিজমের উত্থান, নিজের দেশে কমিউনিস্ট আন্দোলন, বেকারত্ব, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, কৃষক আন্দোলন, তেভাগা, স্বাধীনতা প্রাপ্তি, দেশভাগ, রাষ্ট্রের যাত্রাপথ। এক মহাপৃথিবী পাল্টে দিয়েছে বাঙালির মহানগর, মননগর।
এই পাল্টে যাওয়া মহানগরের অনেক বাসিন্দা। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁদেরই একজন। তাঁর মতোই মহানাগরিক, প্রায় সমবয়সি মৃণাল সেন। মৃণাল সেন নিজেকে বলতেন ‘প্রাইভেট মার্কসিস্ট’। বীরেন চট্টোপাধ্যায়ের প্রতিবাদী মন ও কবিতা যেন অনেকটাই দলীয় নয়, মানুষের প্রতিবাদ। বাংলায় বিশ শতকে দলগুলি, দল বনাম দল, পথ বনাম বিপথ– এই সংঘাতে কিছুটা হলেও ক্লান্ত। এই ক্লান্তির মধ্যে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যেন এক ব্যতিক্রম।
রাজনীতির দল বাছতে গিয়ে বেছেছিলেন আর. এস. পি-কে। নিকট জনদের কাছে আলাপচারিতায় বলেছেন, আসলে অন্য দলগুলোতে খুব দাদাগিরি দেখেছেন। তুলনায় আর. এস. পি-র মানুষদের মধ্যে পেয়েছেন সহজভাবে বন্ধু হয়ে মেলামেশার পরিবেশ। সে জন্যই ওই দলে গিয়েছিলেন। অকপট কথা। কোনও আদর্শ, ভাবাদর্শ জাতীয় কথা বলেননি, নিজের রাজনৈতিক অবস্থান বোঝানোর তাগিদে। তাঁর জীবনে এবং কবিতায় বীরেন চট্টোপাধ্যায় যেন খোলা মনের প্রতিবাদী কন্ঠস্বর। যে দলদাসত্বে ’৪৭ পরবর্তী বাংলাকে আজ অবধি আচ্ছন্ন করে রেখেছে, তার অন্যতম ব্যতিক্রম এই মানুষটি।
রাজনীতির ভাবনায় মতান্তর ব্যক্ত করতেও পিছপা হননি। তাঁর সমকালীন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের, পূর্ব পাকিস্তানে ঘটে চলা ১৯৭১-এর অত্যাচার ও হত্যার বিষয়ে, একটি লেখার উত্তরে বলেছেন ১৯৭১-এর পশ্চিমবাংলায় ঘটে চলা অবিচারের কথা।
‘সুভাষ যা দেখেছেন’
সুভাষ! যা দেখেছেন যশোহরে, মনিরামপুরে; যে পিশাচ
জল্লাদ মেহের আলী― তার কীর্তি, পাশবিক ধর্ষণ ও নরহত্যা
চোখে কি পড়ে নি, অন্য এক অবাক বাংলায়, যা আপনার স্বদেশ,
সেখানে ওই কালো ছায়া― ওই ভয়ঙ্কর মুখ। মানুষের মাংসপিণ্ডলোলুপ
নরখাদক আমাদের আকরমের মায়েদের ভাতের থালায় লাথি মেরে
নিয়ে যায় আকরমকে থানায়: বেয়নেটে খোঁচানো ইসমাইল পড়ে থাকে
নির্জন খালের ধারে―
‘ক্ষমা? ক্ষমা নেই’― আপনার পবিত্র স্পর্ধা মানুষের সপক্ষে, সুভাষ;
এইতো প্রত্যাশা ছিল! আমাদের দৈনিক পত্রিকাগুলি প্রতিবেশী
পশুদের পাপ কিংবা পুণ্যশ্লোক কবিদের দেশপ্রেম ছাড়া
সংবাদ ছাপে না―
আপনার প্রচন্ড ক্রোধ― দেশান্তরে― তাই আমাদের কেমন তরল বলে মনে হয়!
কবির জীবনের শেষ ক’বছর কেটেছিল ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াইয়ে। ১৯৮৫-তে মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ আগে শেষ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন অধ্যাপক প্রাবন্ধিক সুমিতা চক্রবর্তী, সঙ্গে ছিলেন কবি সুমিত চট্টোপাধ্যায় ও গায়ক কল্লোল দাশগুপ্ত। কল্লোলদার কাছে জানলাম কবির আরও এক অমনি স্বীকারোক্তি। ১৯৫০-এর গোড়ায়। বেকার জীবন। সময়ের তাড়নায় ময়দানের রেসের মাঠে ঘোড়া দৌড়েও বাজি ধরেছিলেন কবি বীরেন চট্টোপাধ্যায়।
সে কথা অনুজদের কাছে বলতে দ্বিধা করেননি। কোনও পোশাকি মধ্যবিত্তসুলভ লজ্জাবোধ তাঁকে দমবন্ধ করে রাখেনি।
আবার আরও মিষ্টিভাবে মিশে যান নাতনির সঙ্গে কবিতার মধ্য দিয়ে। ‘কথোপকথন’ কবিতায় কবি নাতনিকে বলেন,
‘দাদু’।
‘কিরে?’
‘আমার বাড়ির নাম “ঝুমরি”
ইস্কুলের নাম “পৌলমী”―
একটাও তো তুমি দাও নি!
তুমি না কবি?’
‘নাম দিয়ে কি যায় আসে রে?
তিতিন, তুই, তোতাই, রুবাই―
কত আমার নাতি-নাতনি।
আমার কাছে কেউ তো তোদের নাম চায়নি।
আমি তো এখন বুড়ো হয়েছি,
এখন আমার যাবার সময়―
তোদের ভালো থাকতে দেখে, ভালোবেসেই যদি দুচোখ বুজতে পারি
বুঝলি নাতনি, সেও অনেক।
যদিও তোরা বড় হচ্ছিস,দাদু যদি
দোষ করে তো
রাগ করিস না―
তবে মাঝে মধ্যেই একটু বকিস’।
জীবনানন্দ যেমন ছিলেন কবির চেতনে-অবচেতনে, তেমনই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ও বীরেন চট্টোপাধ্যায়ের মনযাত্রী। একটি কবিতা ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়’।
জীবনের মূল্যবান মুহূর্তগুলিকে
মদ, জুয়া, আড্ডা আর খেয়ালখুশিতে
উড়িয়ে, ছড়িয়ে তবু শিল্পীর অমর
সাধনায় ইচ্ছে ছিল তারও ভাগ নিতে
একনিষ্ঠ আত্মদানে। তাই রাজনীতি
পেশা নয়, কিংবা মাতালের উশৃংখল
চিৎকার ছিল না তার; বরং মানুষ
সমস্ত যন্ত্রণা নিয়ে তার চোখে উজ্জ্বল
হয়েছিল। সবচেয়ে বেশি ছিল মনে
মানবতা; তাই তাকে খিদিরপুরের
ঘোড়ারা ছোটাতো কিন্তু পারতো না মন্ত্রীরা
কোনো লোভ দেখিয়েই চোর বানাতে। ঢের
পুরস্কৃত হওয়া যেতো, এমন সুযোগ
উপোসেও নেয় নি সে; সয়েছে দুর্যোগ ।।
এই কবিতায় যিনি নায়ক, তিনি মানিক, না জীবনানন্দ না বীরেন্দ্র!