সুকুমার রায় অসুস্থতার পর্বেই উদ্যোগী হয়েছিলেন ‘আবোল তাবোল’ গ্রন্থটির প্রকাশের জন্য। বইয়ের চেহারায় ‘আবোল তাবোল’-কে সাজাতেই বইয়ের প্রথম ও শেষ কবিতা দু’টি লেখা। দু’টি কবিতার নামই ‘আবোল তাবোল’। সূচনা কবিতায় ভরসা দেওয়া ছিল এই আবোল তাবোল দেশে প্রবেশ করলে সব কিছুই দেখা যাবে ‘বেঠিক-বেতাল’।
১৯২৩, ১০ সেপ্টেম্বর। ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল কলকাতা। ঘরদোর সব নড়ে উঠল। লাল রঙে নীল সুর বাজিয়ে হাসি-হাসি গন্ধ ছড়িয়ে মেঘমুলুক থেকে কারা যেন এসে বলতে থাকলো– “এই তাতা খেলতে যাবি না? ঐ দ্যাখ ‘তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম’ ঝোলায় নিয়ে পক্ষীরাজ চলে এসেছে! আদিম কালের চাঁদিম হিম মাখতে যাবি না!” ঘোরের মধ্যেই তাতা সাড়া দেয়, ‘ঘনিয়ে এলো ঘুমের ঘোর/ গানের পালা সাঙ্গ মোর’। মাত্র ৩৫ বছর ১০ মাস ১০ দিন সুকুমার রায় পাড়ি দিলেন মেঘমুলুকে।
আজ ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৩। আর মাত্র ৯ দিন পর ১৯ সেপ্টেম্বর। ১৯২৩, ১৯ সেপ্টেম্বর বাঙালি ছেলে-বুড়ো পা রেখেছিল অভিনব এক দেশে, সে দেশের নাম ‘আবোল তাবোল’।
পাতাশাখাহীন দুটো গাছের কাণ্ডর মাথায় সরু একটা ডাল আটকানো– দেখতে অনেকটা গেটের মতো। চারজন লোক খুব গম্ভীর মুখে একটা সাইনবোর্ড টাঙাতে ব্যস্ত। ওই গেটে ঢোকার ডানদিকের খুঁটিতে একটা নোটিশ ঝোলানো আছে। ১০০ বছর আগের লেখা তো, তাই একটু ঝাপসা; ওখানে লেখা আছে ‘যাহা আজগুবি, যাহা উদ্ভট, যাহা অসম্ভব তাহাদের লইয়া এই পুস্তকের কারবার। ইহা খেয়ালরসের বই। সুতরাং যাঁহারা এ রস উপভোগ করিতে পারেন না, এ পুস্তক তাঁহাদের জন্য নহে।’ আর ওই সাইনবোর্ডে লেখা ‘আবোল তাবোল’। ছবির বাঁদিকে আঁকা ‘SR’। ১৯২৩, ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে এভাবেই থেমে আছে।
সুকুমার রায় অসুস্থতার পর্বেই উদ্যোগী হয়েছিলেন ‘আবোল তাবোল’ গ্রন্থটির প্রকাশের জন্য। বইয়ের চেহারায় ‘আবোল তাবোল’-কে সাজাতেই বইয়ের প্রথম ও শেষ কবিতা দু’টি লেখা। দু’টি কবিতার নামই ‘আবোল তাবোল’। সূচনা কবিতায় ভরসা দেওয়া ছিল এই আবোল তাবোল দেশে প্রবেশ করলে সব কিছুই দেখা যাবে ‘বেঠিক-বেতাল’। আর যে মত্ত মাদল বাজিয়ে খেয়াল খোলা স্বপনদোলায় চড়ে ওই দেশে পৌঁছবে সে মনের বাঁধন ঘুছে তাধিন্ ধিন্ তালে অসম্ভবের ছন্দে মেতে উঠবে।
ধ্বনি আর দৃশ্যের যুগলবন্দিতে এ দেশের বাসিন্দারা উদ্ভট আজগুবি অসম্ভবের কারবারি। এই দেশের এক্কেবারে প্রান্তিক স্টেশনে এলে অন্ধকারের গন্ধে ঘণ্টার ধ্বনি শোনা যায় । সেখানে আবার সুরের নেশায় ঝরনা ছোটে। ধ্বনি-গন্ধ-সুর-দৃশ্য সব একাকার হয়ে যায়। বিস্ময়-স্ফূর্তি-বেদনার সমস্ত অভিজ্ঞতার নির্যাসটুকু উজাড় করে আবোল তাবোলের আকাশে সহজে আপনি ফুটে উঠে ‘আকাশ কুসুম’। কবিতাটার পাশাপাশি যদি আমরা সুকুমার রায়ের আঁকা মেঘমুলুকের ঝাপসা রাতের ছবিটি খেয়াল করি, তাহলে কবিতাটি আরও গভীরভাবে অনুভব করতে পারব। ছবিতে দেখা যাচ্ছে পৃথিবীর আদলের ঘুরন্ত গোল একটা টেবিলে কলম, স্কেল, কম্পাস ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে কাগজকে স্পর্শ করে দাড়িওয়ালা এক বৃদ্ধ গোল চশমা কপালে তুলে আকাশের খেয়াল স্রোতে মেঘে মেঘে ভেসে থাকা এক বাঁশিওয়ালা বালককে দেখছেন। কালো আকাশে তখন প্রস্ফুটিত সাত রঙের সমাহারে আকাশ কুসুম। ওই বৃদ্ধ ও বালক একই সঙ্গে তবে কি ছোটোদের আর বড়দের খেয়াল আর কল্পনার দুইতলকে ছুঁতে পারা সুকুমার রায়? আবার ওই লেখক মানুষটির দিকে তাকালে যে অবয়ব ভেসে ওঠে, তাঁর সঙ্গে ‘সন্দেশ’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর মিল পাওয়া যায়। বাঁশি হাতের বালক কী তবে মানিক? যে রাজার মেয়ের অসুখ সারিয়ে দিয়েছিল অজানা নদী পেরিয়ে অচেনা দেশ থেকে ঘ্যাঁঘাসুরের পালক নিয়ে এসে। মেঘমুলুকে পাড়ি দেওয়ার আগে সুকুমার রায় সাহিত্য ভাবনার উত্তরাধিকার ‘তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম’-এ ভরে মানিকের জন্য রেখে দিয়ে, মানিককে বলে দিয়ে গেলেন ধ্যানযোগে খ্যাপামি অভ্যাস করতে?
‘আবোল তাবোল’-এর শেষ কবিতায় রেখায়-লেখায় নিজের সঙ্গে মোকাবিলা করে সুকুমার রায় বোধহয় উপলব্ধি করেছিলেন সামনে একটি চিরন্তন সত্য অপেক্ষমাণ, ফেলে আসা প্রিয় জগৎ অতীত। যে জগতে তিনি প্রবেশ করতে চলেছেন সেখানে ‘হেথায় নিষেধ নাইকো দাদা/ নাইরে বাঁধন নাইরে বাঁধা।’ পেছনে ফেলে এসেছেন যাবতীয় প্রত্যাশা মান অভিমান–
আজকে দাদা যাবার আগে
বলব যা মোর চিত্তে লাগে
নাইবা তাহার অর্থ হোক
নাইবা বুঝুক বেবাক লোক।
আত্মর মুখোমুখি হওয়া এতটাও সহজ ছিল না। ভেতরে ভেতরে একটা আলোড়ন চলছিল। সুকুমার-মন অমলের ঠাকুরদাকে কাছে পেতে চাইছিল। বন্ধু প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশকে বললেন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আসতে। রবীন্দ্রনাথ এলেন, রবীন্দ্রনাথকে স্পর্শ করে অমলের মতোই সুকুমার রায় অনুভব করেছিলেন, ‘আমার আর কোনো অসুখ নেই, কোনো বেদনা নেই। আঃ সব খুলে দিয়েছে– সব তারা দেখতে পাচ্ছি– অন্ধকারের ওপরকার সব তারা।’
সুকুমার রায়ের মেঘমুলুকে পাড়ি দেওয়ার তিনদিন পর শান্তিনিকেতনের মন্দিরে উপাসনার পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে ভাষণ দেন তাতে বলেছিলেন “…এই মৃত্যুপথের পথিক আমাকে গান গাইতে বলেছিলেন, পূর্ণতার গান, আনন্দের গান। তাঁকে গান শুনিয়ে ফিরে এসে সে রাত্রে আমি একলা বসে ভাবলুম, মৃত্যু ত জীবনের সব শেষের ছেদ, কিন্তু জীবনেরই মাঝে মাঝেও ত পদে পদে ছেদ আছে। জীবনের গান মরণের কালে এসে থামে বটে, কিন্তু প্রথম থেকে শেষ পর্য্যন্ত তার তাল ত কেবলি মাত্রায় মাত্রায় ছেদ দেখিয়া যায়। সেই ছেদগুলি যদি বেতাল না হয় যদি তা ভিতরে ভিতরে ছন্দোময় সঙ্গীতের দ্বারা পূর্ণ হয় তাহলেই শমে এসে আনন্দের বিচ্ছেদ হয় না।’
‘আবোল তাবোল’– গান সাঙ্গ করে তাতা নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়বেন; তার আগে কলমের অবশিষ্ট যেটুকু কালি ছিল সেটুকুর আর কোনও প্রয়োজন নেই ভেবে, বইয়ের শেষপাতায় ঝেড়ে ফেললেন। কালো কালির ভেতর হাতের লেখায় জ্বল জ্বল ফুটে রইল সাদা রঙে ‘সমাপ্ত’।