ভিড় কেটে ফাঁকফোকর গলে সামনে গিয়ে দেখলেন, ইয়া বড় একটা চোঙের ভেতর থেকে পাতলা গলায় ভেসে আসছে গান। সবিস্ময়ে এই প্রথম তাঁদের গ্রামোফোন দেখা। দুই বালিকা কিছুতেই ভেবে পেলেন না, কীভাবে একটা মানুষ ঢুকে ওর ভেতর বসে থাকে আর গান গায়। ইশকুল যেতে দেরি হচ্ছে। বেগতিক দেখে শেষে বোন কোনওমতে একটা গোঁজামিল সমাধান দিলেন, ‘মনে হয় হাত পা কেটে কাউকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।’ সরল বালিকা তাই বিশ্বাস করে নিলেন।
গ্রীষ্মের পড়ন্ত বিকেল। ছাদময় ছুটে বেড়াচ্ছে হাওয়া। সেখানে দাঁড়িয়ে ছোট্ট একরত্তি দু’টি মেয়ে, নিভু নিভু আলোয় আকাশের তারা গোনা খেলছিল। ওরা দুই বোন, একে অপরের আজীবনের ন্যাওটা। একসঙ্গে ইশকুল যায়, একসঙ্গেই ছাদেও আসা চাই।
শ্যামপুকুরে তাদের এই বাড়িটায় বিরাট ছাদ। সমস্ত আকাশটাকে যেন সেখানে বেঁধে ফেলা সম্ভব। মাথা উঁচু করে তাই প্রায়ই এখানে তারা দেখে ওরা। বিরাট মহাকাশটাকে হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চায়। সেদিন তারা গোনা শেষ হলে, ছোট বোন জানাল সে সা–-ত’টা তারা গুনতে পেরেছে। কিন্তু দিদি পেয়েছে মাত্র পাঁচটা। বাকি দুটো তো সে পায়নি! পুনরায় গুনতে বসল সে। অঙ্কের হিসেব মেলাতে না পারা জিজ্ঞাসু চোখ দু’টি কিন্তু বারবার খুঁজেও অন্য দুটো তারা পেল না। শেষে নতমুখে বোনের হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে নামতে যাবে, ততক্ষণে সিঁড়িতে প্রদীপ হাতে মা আসছেন। হঠাৎ হিসেব মিলের আনন্দে ভরে গেল মেয়েটির মন। মায়ের দু’টি চোখের দিকে তাকিয়ে ওর মনে হল, এই বুঝি তার হারিয়ে যাওয়া তারা দু’খানি। মা-কে তার সব বলা চাই৷ তৎক্ষণাৎ জড়িয়ে ধরে মায়ের কাছে সমস্তটা বর্ণনা করা হল। খুশি হয়ে তিনি আদর করে দিলেন। বললেন, ‘দূর পাগলি, বড় হয়ে তুই দেখছি কবি হবি।’
মায়ের কথা মেলেনি৷ বড় হয়ে এই মেয়ে কবি হয়নি। কিন্তু যা হয়েছেন, তার সম্মান কবির চেয়ে কিছু কম নয়৷ মেয়েটির জন্ম ১৯০০ সালে কলকাতার কাশীপুরে। মা নাম দিয়েছিলেন, প্রভাবতী৷ মেয়ের মুখে নিশ্চয়ই ভবিষ্যতের দ্যুতি দেখতে পেয়েছিলেন। ছন্দ মিলিয়ে পিঠোপিঠি বোনের নাম হল ইন্দুমতী৷ ছোটটির বেলায় মাতৃপ্রদত্ত নামই আজীবন বহাল থাকলেও বড়টির বেলায় তা হয়নি৷ হয়তো ভাগ্যদেবীর ইচ্ছা অন্যরকম ছিল। প্রভাবতীর সংগীত প্রতিভায় মজেছিল প্রায় সারা ভারতবর্ষ, কিন্তু ভিন্ন একটি নামে। সে নাম তার প্রিয় ললিতকাকার (ললিতমোহন গোস্বামী) দেওয়া৷ আঙুরের মতো মিষ্টি কণ্ঠসুধা, তাই ‘আঙ্গুরবালা’। প্রভাবতী দেবী এই নামই আমৃত্যু বইলেন হাসিমুখে, সগর্বে।
ছোটবেলা থেকেই সংগীতে একাগ্রতা ছিল। ভিক্ষুকদের ধরাধরি করে ডেকে আনতেন ঘরে। বলতেন, গান শোনাও। বদলে মুষ্টি ভরে যা উঠত, তা দিতে কার্পণ্য করতেন না। মা-কে ধরেবেঁধে তাদের বেশি পয়সাও দিয়েছেন, এক গান একাধিক বার গাওয়াবেন বলে। বারবার শুনতেন আর নবীন মাথায় চলত সেই সুরকে যতখানি পারা যায় কুড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা। আত্মস্থ হয়েও যেতেন বড় তাড়াতাড়ি। পরে মায়ের সঙ্গে স্নানের ঘাটে গিয়ে ভিক্ষুকদের কাছ থেকে শেখা গানগুলি শুনিয়ে সবার হৃদয় জয় করে নিতেন। অশ্রুসিক্ত স্নানার্থীরা বলে যেতেন, এই গলা যেন কলের গানের। গ্রামোফোনকে তখন মানুষ ‘কলের গান’ বলেই চেনে। একটা চোঙের ভিতর থেকে মানুষের গলার আওয়াজ কীভাবে বেরতে পারে, এই নিয়ে তখন শিশুমহলেও একটা বিরাট কৌতূহল ছিল। আঙ্গুরবালারও তার অন্যথা নয়। একদিন ইশকুল যাচ্ছেন আঙ্গুর, পিছন পিছন ছায়াসঙ্গিনী ইন্দুবালা ওরফে বিজু। হঠাৎ বাতাসে ক্ষীণ কণ্ঠের গান ভেসে আসায় দু’জনেই দাঁড়িয়ে পড়লেন।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
বহু বছর আগে একবার আঙ্গুরের ললিতকাকা তাঁকে নিয়ে গেছেন কুসুমকুমারী দেবীর সঙ্গে দেখা করাতে৷ ওঁর নাম তখন মানুষের মুখে মুখে ঘোরে৷ গ্রিনরুমে ঢুকে আঙ্গুর দেখলেন, ঝলমলে পোশাকে বসে মুখের মেক-আপ তুলছেন তিনি। ছোট্ট আঙ্গুর আশীর্বাদ নেবে বলে তাঁর পায়ে হাত দিয়েছেন। উত্তরে কুসুমকুমারী দেবী কেবল তাকালেন। মুখে কোনও শব্দ নেই। একবার শূন্যদৃষ্টি মেলেই পুনরায় নিজের কাজ করতে লাগলেন। আকস্মিক এই প্রত্যাখ্যানে অপমানিত হয়েছিলেন আঙ্গুর।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
বোনের চেয়ে দিদির আগ্রহ বেশি৷ ভিড় কেটে ফাঁকফোকর গলে সামনে গিয়ে দেখলেন, ইয়া বড় একটা চোঙের ভেতর থেকে পাতলা গলায় ভেসে আসছে গান। সবিস্ময়ে এই প্রথম তাঁদের গ্রামোফোন দেখা। দুই বালিকা কিছুতেই ভেবে পেলেন না, কীভাবে একটা মানুষ ঢুকে ওর ভেতর বসে থাকে আর গান গায়। ইশকুল যেতে দেরি হচ্ছে। বেগতিক দেখে শেষে বোন কোনওমতে একটা গোঁজামিল সমাধান দিলেন, ‘মনে হয় হাত পা কেটে কাউকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।’ সরল বালিকা তাই বিশ্বাস করে নিলেন। সে বিশ্বাস অবশ্য ছিল বহুদিন, বেশ কিছুটা বড়বেলা অবধিই। সেইজন্যই বাবার বন্ধুরা যখন সেধে গান রেকর্ড করার আর্জি জানালেন, বছর তেরোর আঙ্গুরবালা কেঁদে উঠেছিলেন শিশুর মতো৷ বাবা, মা, বোন কারও কথাতেই কাজ হল না৷ ফিরিয়েই দিতে হল তাঁদের। পরে অবশ্য অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজি করালে ভীত পাখিটির মতো মাইক্রোফোনের সামনে গিয়ে বসেছিলেন, ধরেছিলেন ‘বাঁধ না তরিখানি আমার এ নদীকূলে’।
প্রথমবারের অতর্কিত গাওয়াই রেকর্ড হয়ে গেল চিরতরে। এই গানই আঙ্গুরবালার প্রথম রেকর্ড। এরপর কত শত গান তাঁর কণ্ঠে রেকর্ড হয়েছে, তার হিসেব তিনি নিজেও জানতেন না৷
জানতেন কেবল কাজ করে যাওয়া। সে সময় থিয়েটারে গান গাওয়া ভদ্র সমাজের মেয়েদের জন্য প্রায় ব্রাত্যই ছিল। অথচ ‘বেঙ্গলি থিয়েট্রিকাল কোম্পানি’ থেকে প্রস্তাব পেয়ে আঙ্গুর তৎক্ষণাৎ নাটকে গান গাইতে সম্মত হলেন। অবশ্য এর পিছনের কাহিনি ছিল অন্য।
বহু বছর আগে একবার আঙ্গুরের ললিতকাকা তাঁকে নিয়ে গেছেন কুসুমকুমারী দেবীর সঙ্গে দেখা করাতে৷ ওঁর নাম তখন মানুষের মুখে মুখে ঘোরে৷ গ্রিনরুমে ঢুকে আঙ্গুর দেখলেন, ঝলমলে পোশাকে বসে মুখের মেক-আপ তুলছেন তিনি। ছোট্ট আঙ্গুর আশীর্বাদ নেবে বলে তাঁর পায়ে হাত দিয়েছেন। উত্তরে কুসুমকুমারী দেবী কেবল তাকালেন। মুখে কোনও শব্দ নেই। একবার শূন্যদৃষ্টি মেলেই পুনরায় নিজের কাজ করতে লাগলেন। আকস্মিক এই প্রত্যাখ্যানে অপমানিত হয়েছিলেন আঙ্গুর। প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, একদিন নিজের কাজ দিয়ে নিজের জায়গা তৈরি করবেন। তার বহুদিন পর ‘বেঙ্গলি থিয়েট্রিকাল কোম্পানি’ থেকে যখন গাওয়ার অনুরোধ এল, বিষয়টিকে একটি সুবর্ণ সুযোগ হিসেবেই দেখলেন আঙ্গুর। একবাক্যে রাজিও হলেন। কারণ, সেই কুসুমকুমারী অভিনীত নাটকেই টিকিট বিক্রি বাড়ানোর জন্য তাঁর গানের ডাক পড়েছে৷ সবচেয়ে বড় কথা, আমন্ত্রণে কুসুমকুমারী নিজেও ছিলেন। আমন্ত্রণ রক্ষা হল। আঙ্গুরবালা সেই নাটকে গাইলেন। নাটক হিটও হল। কিন্তু সেই যে থিয়েটারের সঙ্গে জড়িয়ে গেলেন, আর সেভাবে বেরতে চাইলেন না। গান তো গাইলেনই। ‘সীতা’, ‘যোগাযোগ’, ‘সরমা’-র মতো নাটকে অভিনয়ও করলেন। পরে ‘মাতৃস্নেহ’, ‘পাপের পরিণাম’, ‘বিষবৃক্ষ’ এই তিনটি ছবিতেও অভিনয় করেন আঙ্গুর। অথচ মজার ব্যাপার, যে কুসুমকুমারী দেবীকে নিজের জায়গা দেখানোর জন্য থিয়েটারের জমিতে পা রেখেছিলেন, তাঁকে পরবর্তীতে ‘কুসুম মা’ বলে ডাকতেন। ভয়ংকর সম্মান করতেন তাঁকে। বলতেন ‘একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম সেদিনের কথা৷ উনি বললেন, বড় অভিনেত্রী হতে গেলে ওরকম একটা গাম্ভীর্যের মুখোশ পরে থাকতে হয়। তুই যেন আমার সেসব কথা মনে এনে কাঁদতে বসিসনে বাপু।’
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের জন্য রোডম্যাপ রইল, কিন্তু বাকিদের?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সেদিন আঙ্গুর কাঁদেননি। কুসুম মা-কে জড়িয়ে ধরেছিলেন আনন্দে৷ তবে কাঁদতে তিনি বসেছিলেন, অন্য একদিন। কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন তাঁর অন্যতম গুরু। বারবার বলতেন ‘কাজীদার গান গাইতে আমার সবচাইতে বেশি ভালো লাগে।’ সেই কাজীদা মাঝেমাঝেই আসতেন আঙ্গুরের বাড়ি। তেমনই একদিন এসেছেন৷ কীসের যেন তাড়া খাওয়া চোখ, শোকে ক্লান্ত মুখ। বিষয়টা আঙ্গুরের ভালো ঠেকল না৷ এসেই কাজীদা শুয়ে পড়লেন বিছানায়। হাউহাউ করে কাঁদতে লাগলেন৷ আঙ্গুর তখনও জানেন না, তাঁর প্রিয় কাজীদার প্রথম পুত্র ক’দিন আগেই চলে গেছে না ফেরার দেশে। যখন জানলেন, গুরুর এমন অসহায় বেদনামাখা মুখ দেখে নিজেও আর চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না।
অপ্রকাশিত আনন্দ কিংবা দুঃখকেই সুরের ভেতর দিয়ে বাতাসে ছড়িয়ে দিতেন। সে বাতাস ছুঁয়ে ছুঁয়ে যেত সারা ভারত। না হলে তাঁর গাওয়া হিন্দি, উর্দু ও বিশেষত বাংলা গান দেশের বিভিন্ন রাজা মহারাজাদের দরবারে কেমন করে পৌঁছবে! কেমন করে তাঁর মাথায় উঠবে ‘কলকত্তে কি কোয়েল’ কিংবা ‘বাংলার বুলবুল’-এর খেতাব। আর এই বাংলাই বা কম কী! আঙ্গুরবালার জীবদ্দশায় মানুষ তাঁর নাম লেখা শাড়ি পরত। বাজারে চড়া দামে বিক্রি হত ‘আঙ্গুরবালা পান’। ‘কলের গান’-কে ভয় পাওয়া সেই ছোট্ট আঙ্গুর বড় হয়ে এও দেখে গেছেন।
শেষবেলায় থাকতেন দুর্গাচরণ মিত্র স্ট্রিটের একটি বাড়িতে। ঘরময় বাহারি ফ্রেমে আঁটা অভিনন্দনপত্র, পুরনো হারমোনিয়াম, পঞ্চাশ বছর আগের কলের গান, গোছাগোছা বই, আর দেওয়ালে মালা চন্দনে সাজানো ‘কাজীদা’র বিরাট প্রতিকৃতি। সেই ঘরে তখন সুরের মাদকতা তলানিতে। নিঃশেষিত সুরাপাত্রের মতন রঙিন স্মৃতিরা চারিদিকে এলোমেলো ছড়ানো। তারই মাঝে ঘরের আলো আঁধারিতে সোনার গয়না পরা গোল্ডেন ফ্রেমের চশমায় বয়স্কা এক কারিগর, যাঁর কণ্ঠ ছেড়ে উড়ে গেছে সুরের বুলবুল, একসময় যে পাখি অবিরাম সুরের মধু সৃজন করতে পারত। সে সৃজনে মনোনিবেশ করতে করতে কখনও আর বিয়ে হল না জিজ্ঞেস করলে বলতেন, ‘সময় পেলাম কই!’
প্রেমও কি তবে হয়নি? এর উত্তর আঙ্গুরবালা দেননি। তবে আমরা জানি যাঁর কণ্ঠ শুনলে চরম অভাগার জীবনেও ‘পরমোৎসব রাতি’ নেমে আসে, তাঁর কাছে প্রেম আসেনি, এ প্রায় অসম্ভব। যাঁর কণ্ঠে এত আলো, এত মজলিশ আবার একইসঙ্গে এত অভিমান, যাঁর সুরে সুরে নিত্য ফুটেছে বেদনার ফুল, প্রেম কি তিনিও করেননি? করেছিলেন বইকি। তবে তা কোনও রক্তমাংসের মানুষ, নাকি সুরে সুরে দেহ পাওয়া কোনও মহামানব? তা যাঁর গল্প, তাঁর পিছু পিছুই হারিয়ে গেছে। হয়তো যাঁরা আঙ্গুরবালার কাছে শেষ পর্যন্ত ছিলেন তারা কেউ কেউ কেবল শুনে থাকবেন, এক অশীতিপর বৃদ্ধার সুরহারা কণ্ঠে অনিয়মিত হাহাকার… ‘শূন্য এ বুকে পাখি মোর আয়, ফিরে আয় ফিরে আয়’…