থিয়েটারের এই বাদল-ধারা আজও আদর্শগত ভাবে অবশ্যই মহৎ কিন্তু কার্যকারিতার নিরিখে আমার মনে হয় এই ঘোলাটে সময়ে তা নিয়ে আলোচনার অবকাশ আসছে । ‘শতাব্দী’ প্রতিষ্ঠার অর্ধ-শতাব্দী পেরিয়ে গেছে। এই পাঁচ দশক ধরে গ্রাম বা শহরের ধরন-ধারন বদলেছে বুলেট গতিতে। বদল এসেছে শ্রম বা শ্রমিকের ধারনায়, বদল এসেছে নিয়োগ-ছাঁটাই সমীকরণে, বদলে গেছে বিনোদনের চাহিদা, আহত হয়েছে আদর্শের প্রতি আনুগত্য, শিথিল হয়েছে আঁকড়ে থাকার জোর, দুর্ভেদ্য প্রলেপ পড়েছে মানুষের সংবেদনশীলতায়, ক্রমশ ঝাপসা হয়েছে গ্রাম ও শহরের প্রকট সীমান্তরেখা। থিয়েটারের এই তৃতীয় ধারায় আদৌ কি কোনও অ্যামেন্ডমেন্ট দরকার? দরকার কোনও উপধারার?
প্রচ্ছদ শিল্পী: সোমোশ্রী দাস
স্কটিশচার্চ কলেজের হোস্টেলে, দোতলার যে ঘরটিতে আমি থাকতাম, তার জানালা খুললেই পাশের পরপর দুটো বাড়ির ছাদ দেখা যেত। লাগোয়া বাড়িটির ছাদে একজন প্রায় বৃদ্ধ ভদ্রলোক তার অতি বৃদ্ধ অসুস্থ বাবাকে সকালবেলা ছেলে-ভোলানোর মতো এটা-সেটা বলে স্নান করাতেন। গায়ে জল পড়া মাত্র বাবা তুমুল চিৎকার ও গালাগালি করতেন। আমি জানালা খুলে উঁকি দিতাম। চোখ চলে যেত দ্বিতীয় বাড়ির ছাদেও। সেখানেও এক বুড়ো ভদ্রলোক। তিনি নির্বিকারভাবে একা একা ইজিচেয়ারে বসে থাকতেন আর পড়তেন। সকালে খবরের কাগজ, বিকেলে বই। আমি তখন জানতাম না উনি বাদল সরকার। অবশ্য বাদল সরকার কে, তাও জানতাম না।
এর বছর চারেক পর নান্দীপট নাট্যদলের ‘বল্লভপুরের রূপকথা’ নাটকে ‘ভূপতি’ চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পাই। ওঁর নাটক পড়া শুরু হয়েছিল সরাসরি পার্ট মুখস্থ করার তাগিদেই। তারপর একাধিক কারণে প্রায় শতাধিক বার নাটকটি পড়েছি। প্রথমবার নাটকটি পড়ে যে ধবধবে একটা আনন্দ অনুভব করেছিলাম, মঞ্চে সংলাপগুলো বলার সময় এখনও, ৫০টি অভিনয় পেরিয়েও ঠিক সেই আনন্দ টাই অনুভব করি। বানিয়ে তো বলছিই না, বাড়িয়েও বলছি না।
সেই আনন্দ নিয়েই পরের নাটকটি পড়া শুরু করলাম। বাদল সরকারের নাটক পড়তে গিয়ে যদি পরপর প্রথম দুটো হয় ‘বল্লভপুরের রূপকথা’ ও ‘পাগলা ঘোড়া’, তাহলে পাঠক মনে কি অভিঘাত তৈরি হতে পারে, যারা দুটো নাটকই জানেন, তারা বুঝবেন। রূপকথার রাজ্য থেকে সোজা চিতাকাঠের পাশে!
‘ভোমা’, ‘সারারাত্তির’, ‘বল্লভপুরের রূপকথা’– যে একই লোকের লেখা, এটা না জানলে বিশ্বাস করা কঠিন। নাটকের বিষয়বস্তু, তার কাঠামো, তার সংলাপে এতটা বৈচিত্র, এতটা ব্যপ্তি, সারা ভারতে আর কোনও নাট্যকারের নেই বোধ হয়। একই সময়ে সারা দেশ জুড়ে অভিনীত হচ্ছে ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’। কন্নড়ে, ইংরেজিতে, হিন্দিতে, মারাঠিতে– ওই একই নাটক নিয়ে কাজ করছেন বি ভি কারান্থ, গিরিশ কারনাড, সত্যদেব দুবে প্রমুখরা। এই ঘটনা আমাদের দেশে খুব বেশি হয়নি। দিল্লির ‘ন্যাশনাল স্কুল অফ্ ড্রামা’-তে ক্যাম্পাসের ভেতরে যে বই-এর দোকানটি আছে, সেখানে দোকান জুড়ে তার আধিপত্য, বাঙালিদের গর্ব করার দারুণ সুযোগ করে দেয়।
নাটক লেখায় ওঁর দক্ষতা পড়ে বুঝেছি, অভিনয় করে বুঝেছি, আর হাড়ে হাড়ে বুঝেছি ‘বল্লভপুরের রূপকথা’ নাটকটিকে চিত্রনাট্যের রূপ দিতে গিয়ে। আমি ও বন্ধু অনির্বাণ মূল সুদীর্ঘ নাটকটিকে সম্পাদনা করতে বসে, নিতান্ত অসহায়বোধে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে গেছি দিনের পর দিন। বুঝেছি, এক বৃহৎকে কেটে-ছেঁটে নিজেদের সাইজে আনার চেষ্টা করছি আমরা। বুঝেছি, যে নাটকে একটিও সংলাপ নেই যা না বললেও চলে, যে নাটকে একটিও সংলাপ নেই, যা বাকি যেকোনও সংলাপের চেয়ে কম ভালো, সে নাটকে ছুরি চালানোর জন্য পর্যাপ্ত শাণিত নই আমরা। তারপর ওই লেখনীর সঙ্গে মানানসইভাবে নতুন দৃশ্য ও সংলাপ সংযোজন… যাক গে, কেটে গেছে।
………………………………………………………………………………..
বাংলার অনেক স্বনামধন্য নাট্য-ব্যক্তিত্বই যখন অনিয়মিত ও অপর্যাপ্ত সরকারি গ্রান্ট পাওয়া নিয়ে গলা চড়াচ্ছেন, অভাব অভিযোগ ব্যক্ত করছেন, তখন তিনি ঘোষণা করে বসলেন টাকার কোনও দরকারই নেই থিয়েটারের জন্য। ফলত যে বৈমাত্রেয় আচরণ প্রাপ্য ছিল, উনি তা পেয়েছিলেন। অর্থ ও উপকরণ নিয়ে না ভেবে শহর ও গ্রামের মধ্যে সহজ সংযোগের জন্য ‘থার্ড থিয়েটার’ নামে যে সাঁকোটি তিনি বানিয়েছিলেন, তার প্রধান দুটো ভিত– বিশ্বাস ও স্বপ্ন। একটা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি অবিচল বিশ্বাস। আর সেই বিশ্বাসে ভর করেই সুন্দরের স্বপ্ন, বদলের বার্তা। তার জন্য নাটকে দু’দিক থেকে বদল আনলেন। কাদের বলব? কীভাবে বলব? অভিমুখ বদলে গেল শহর থেকে গ্রামে। পোঁছলেন দর্শকদের দৈনন্দিন দরবারে, খুব কাছে আসন পাতলেন তাদের জন্য।
………………………………………………………………………………..
বাংলার অনেক স্বনামধন্য নাট্য-ব্যক্তিত্বই যখন অনিয়মিত ও অপর্যাপ্ত সরকারি গ্রান্ট পাওয়া নিয়ে গলা চড়াচ্ছেন, অভাব অভিযোগ ব্যক্ত করছেন, তখন তিনি ঘোষণা করে বসলেন টাকার কোনও দরকারই নেই থিয়েটারের জন্য। ফলত যে বৈমাত্রেয় আচরণ প্রাপ্য ছিল, উনি তা পেয়েছিলেন। অর্থ ও উপকরণ নিয়ে না ভেবে শহর ও গ্রামের মধ্যে সহজ সংযোগের জন্য ‘থার্ড থিয়েটার’ নামে যে সাঁকোটি তিনি বানিয়েছিলেন, তার প্রধান দুটো ভিত– বিশ্বাস ও স্বপ্ন। একটা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি অবিচল বিশ্বাস। আর সেই বিশ্বাসে ভর করেই সুন্দরের স্বপ্ন, বদলের বার্তা। তার জন্য নাটকে দু’দিক থেকে বদল আনলেন। কাদের বলব? কীভাবে বলব? অভিমুখ বদলে গেল শহর থেকে গ্রামে। পোঁছলেন দর্শকদের দৈনন্দিন দরবারে, খুব কাছে আসন পাতলেন তাদের জন্য।
নাটকের কনটেন্টকে প্রাধান্য দেবার কথা বলেছেন উনি বারবার, কিন্তু আমায় বরাবর আকর্ষণ করেছে ওঁর এক্সপ্রেশন। প্রসেনিয়ামে শহুরে গ্রুপ থিয়েটার, যেটাকে উনি 2nd theatre বলছেন, কনটেন্ট-এর দিক থেকে সেখানে বামপন্থী চিন্তাধারার নাটক কম ছিল না। বেকারত্ব, বিশ্বব্যাপী হিংসা, সরকারের স্বৈরাচারিতা, সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন দুর্দশার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার নাটক বাংলা থিয়েটারে কোনওদিনই বাড়ন্ত নয়। কিন্তু বাদলবাবু সেই কথাগুলোকে এক নতুন ভাষায় ব্যক্ত করতে পারলেন। সংলাপ হয়ে উঠল একইসঙ্গে ধারালো এবং ভারী, সহজ কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত, পরিচিত অথচ চমকপ্রদ। ‘মিছিল’ নাটকে মৃতদেহ (খোকা) উঠে বসে যখন বলে:
‘আমি খুন হয়েছি। আমি। এই যে এখানে। আমি খুন হয়েছি আমি আমি এই যে আমি। আমাকে মেরে ফেলেছে। আমি মরে গেছি। এইমাত্র। এই মাত্র খুন হয়েছি আমি।…’
কিংবা পরিচিত সুরে মিছিল যায় স্লোগান দিতে দিতে–
‘কাকাতুয়ার মাথায় ঝুঁটি/খেঁকশিয়ালি পালায় ছুটি… জিন্দাবাদ! জিন্দবাদ!
গোরু বাছুর দাঁড়িয়ে আছে/ঘুঘুপাখি ডাকছে গাছে… জিন্দাবাদ! জিন্দাবাদ!’
–যেটা ধাক্কা দেয়,যেটা চমক লাগায় সেটা কনটেন্ট নয়, এক্সপ্রেশন। প্রত্যন্ত গ্রামেগঞ্জে, মফস্সলে যেখানেই অভিনীত হোক, যে আঙ্গিকেই হোক, বাদলবাবুর নাটক আমার কাছে খুবই আর্বান। আর এটাই আমাকে সবচেয়ে বেশি অবাক করে, আকৃষ্ট করে।
বুড়ো: ছিল। আছে। ছিল। আছে।
খোকা: আছে। ছিল। আছে। ছিল।…
বুড়ো: ছিল। আছে। ছিল। আছে।
খোকা: আছে। ছিল। আছে। ছিল।…
বুড়ো: কেমন লাগছে?
খোকা: ভাল লাগছে।
বুড়ো: খুঁজে পাবে?
খোকা: জানি না। কি খুঁজছি?
বুড়ো: বাড়ির রাস্তা।
খোকা: ঐ বাড়ি?
বুড়ো: না অন্য বাড়ি। সত্যি বাড়ি। সত্যিকারের বাড়ি।
খোকা: …একই রাস্তা একই রাস্তা একই–
বুড়ো: (হঠাৎ) চুপ্।
……………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন রজত দাস-এর লেখা: বাদল সরকার: একটি বৃত্তের নাম
……………………………………………………………………………………………
বাদল বাবুর নাটক অ্যাবসার্ডধর্মী কি না,বা হলেও কতটা, সে আলোচনা ভিন্ন। কিন্তু মার্টিন এসলিনের বিখ্যাত যে বইটিতে ‘অ্যাবসার্ড থিয়েটার’ কথাটি প্রথম ব্যবহৃত হয়,যেখানে বিভিন্ন দেশের এই নতুন ধারার নাট্যকারদের নাম স্থান পেল, সেখানে বাদল সরকারের নাম না থাকাটা, বইটির অপূর্ণতা। আর কয়েক বছর পর প্রকাশিত হলে বোধহয় সেই অপূর্ণতা থাকতো না।
থিয়েটারের এই বাদল-ধারা আজও আদর্শগত ভাবে অবশ্যই মহৎ কিন্তু কার্যকারিতার নিরিখে আমার মনে হয় এই ঘোলাটে সময়ে তা নিয়ে আলোচনার অবকাশ আছে। ‘শতাব্দী’ প্রতিষ্ঠার অর্ধ-শতাব্দী পেরিয়ে গেছে। এই পাঁচ দশক ধরে গ্রাম বা শহরের ধরন-ধারন বদলেছে বুলেট গতিতে। বদল এসেছে শ্রম বা শ্রমিকের ধারনায়, বদল এসেছে নিয়োগ-ছাঁটাই সমীকরণে, বদলে গেছে বিনোদনের চাহিদা, আহত হয়েছে আদর্শের প্রতি আনুগত্য, শিথিল হয়েছে আঁকড়ে থাকার জোর, দুর্ভেদ্য প্রলেপ পড়েছে মানুষের সংবেদনশীলতায়, ক্রমশ ঝাপসা হয়েছে গ্রাম ও শহরের প্রকট সীমান্তরেখা। থিয়েটারের এই তৃতীয় ধারায় আদৌ কি কোনও অ্যামেন্ডমেন্ট দরকার? দরকার কোনও উপধারার? মুখর হোক থিয়েটারের বাদল-অধিবেশন।
………………………………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………………………………….
শমীক বন্দোপাধ্যায়ের এক বক্তৃতায় শুনেছিলাম, ২০১০ সালে, মৃত্যুর কিছু মাস আগে, বাদলবাবু একান্তে তাঁর শেষ ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন– ‘সারারাত্তির’ নাটকটি করবার। দীর্ঘদিন মুখ ফিরিয়ে রেখে বা উদাসীন থেকে, প্রায় চল্লিশ বছর পর ফিরে আসে একটি প্রসেনিয়াম নাটকের প্রতি দুর্বলতা। কেন? প্রশ্নটা বহুমাত্রিক।