ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বাঁশ বস্তুত দুই প্রকার– ছোলা এবং আছোলা। যদিও ছোলা বাঁশ প্রধানত ভদ্রজনের ব্যবহার্য, ইহজীবনে বড়-একটা পরখ করে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। নিজ কাজকর্মে ওই আছোলাটিই মাঝেমধ্যে ইস্তেমাল করতে হয়েছে। দেখেছি, ভারি কাজের জিনিস!
বাঙালি কি তাহলে সত্যিই বদলে গেল? আগে ছেলেপিলের দল ‘দেওয়া’ বলতে বুঝত, বাঁশ দেওয়া। এখন দেখি, অন্য কিছু বোঝে। এই দেওয়া-দিয়ির কেসটা সময়ের সঙ্গেই বদলে গিয়ে থাকবে হয়তো। দ্যাখো, আমি বাড়ছি মামি! কবি ‘…বাঁশ ঝাড় যেন’-র সঙ্গে মাত্রা মিলিয়েছিলেন, অন্ত্যমিলও দিয়েছিলেন, ‘…আত্মীয় হেন’। আমরা টুকুস করে বদলে নিয়েছি; ‘বাঁশ কেন ঝাড়ে’-র সঙ্গে যথাযথ মাত্রা মিলিয়েছি, মিলও দিয়েছি ওই অন্ত্যেই!
আজ ১৮ সেপ্টেম্বর, বিশ্ব বংশ দিবস। এর উদ্দেশ্য হল, মানুষকে বাঁশের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তোলা। কিন্তু দিনটি তামাম বাঙালির কাছে নেহাতই অপ্রাসঙ্গিক। ‘বংশ দিবস’ মানে চালু কথায়, ‘বাঁশ দিন’। তো, দিন। কে বারণ করেছে? আর, বাঁশ দেওয়া নিয়ে তো আমরা জন্মাবধিই সচেতন! একেবারে ছেলেবেলাতেই সবচেয়ে বড় বাঁশ-দেওয়া বৃত্তান্তটি কেশববাবুর দাক্ষিণ্যে আমাদের জেনে ফেলতে হয়—কীভাবে ‘ব্যাম্বু-ভর্তি তৈল স্লিপ-স্লিপারি হইল’। আমরা ড্যাবডেবে চোখে দেখি– ‘তেলমাখা বাঁশে উল্লাসে উঠেছে মাঙ্কি’। দুরু দুরু আশঙ্কা তৈরি হয়, ‘সে ব্যাটা চড়ছে তেরো সেমি তো পড়ছে চোদ্দো কিমি, ভাঙবে ঠ্যাং কি!’ শেষমেশ ভাঙে বটে; তবে তা মাঙ্কির ঠ্যাং নয়। স্যরের বেত, পিঠে।
শুধু কি অঙ্ক শেখা? ‘বাংলা লিখতে ও পড়তে শেখার নতুন বই’ হাতড়েও দেখছি বাঁশ নিয়ে একেবারে গোটা একটা চ্যাপ্টার। সেটা অবশ্য সাতের দশক, কিন্তু তৃণমূল স্তর থেকেই বাঁশকে ধরতে চাওয়া হয়েছে, ‘ঘাসের দাদা বাঁশ’! নামকরণের সার্থকতা নিয়ে প্রশ্ন সেকালে আসত কি না, জানা নেই।
আমাদের বাঁশপ্রীতি এতটাই যে, বড়বেলায় এসেও ‘বংশদণ্ড’ বলতে ঘুণাক্ষরে বংশ বিস্তারের অত্যাবশ্যকীয় দণ্ডটির কথা বুঝি না; তার বদলে বুঝি– বাঁশের লাঠি! অবশ্য এই বঙ্গেরই উত্তরে, বিশেষত কোচবিহারে গেলে দেখতে পাওয়া যাবে ‘বাঁশ উৎসব’। বস্তুত, তা মদনকামপূজা। চৈত্র মাসের মদন চতুর্দশী তিথি উপলক্ষে মাটিতে শালু-জড়ানো বাঁশ পুঁতে এই পুজো করা হয়। কোথাও কামদেবের পুজোর সঙ্গে বাঁশ খেলার প্রচলনও আছে। কোথাও-বা এরই সঙ্গে চলে জাগ গান।
মোদ্দা কথা, বাঙালির শৈশব থেকে বার্ধক্য তো বটেই, মায় জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জুড়ে আছে বাঁশ আর বাঁশ। ‘বাংলার জীবন ও জীবিকা’-য় আব্দুল জব্বার যে-কথা লিখেছিলেন, “কথায় বলে, ‘হলে বাঁশ, ম’লে বাঁশ’। তার মানে বাচ্চা হলেই বাঁশের চ্যারাটি দিয়ে তার নাড়ী কাটা হত আগে। আর মরলে চাই বাঁশের খাটুলি। আবার মুসলমান হলে তো কবরের ভেতর পর্যন্ত ধাওয়া করবে বাঁশ। বাঁশের ‘পাড়ন’, ‘এড়ো’ দিতে হবে কবরের মুখে। বেশি নেক্কার বান্দা হলে মৃতের বুকের ওপরে বাঁশের ঝাড় গজিয়ে গ্রাম সমাজের ‘ষোল আনা’র সেবায় লাগাতেও পারে।” তাহলে বলুন, এমন বাঁশান্তঃপ্রাণ বাঙালির কাছে বংশ দিবসের কী আর গুরুত্ব থাকতে পারে!
তবে, আছে। একটা জিনিস এখনও আমাদের ভাল করে বুঝে নেওয়া বাকি আছে। তা হল, বাঁশের প্রকারভেদ। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বাঁশ বস্তুত দুই প্রকার– ছোলা এবং আছোলা। যদিও ছোলা বাঁশ প্রধানত ভদ্রজনের ব্যবহার্য, ইহজীবনে বড়-একটা পরখ করে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। নিজ কাজকর্মে ওই আছোলাটিই মাঝে-মধ্যে ইস্তেমাল করতে হয়েছে। দেখেছি, ভারি কাজের জিনিস! তবে কি না, সম্প্রতি সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের পুরনো লেখাপত্র ঘাঁটতে গিয়ে দেখলাম, বাঁশের ভ্যারাইটি এরও ঢের বেশি। ‘সাত টাকা বারো আনা’ বইয়ের এক জায়গায় তিনি খোলসা করে দিচ্ছেন, ‘বাঁশ যে কত রকমের হতে পারে ধারণা ছিল না। কেতাবে পড়েছিলাম, মুংলি, তলতা আর গেঁটে। সে সব হল কাজের বাঁশ। উপকারী বাঁশ। যে বাঁশ আমরা পরস্পর পরস্পরকে দিয়ে থাকি সে বাঁশ অদৃশ্য এবং তার ধরন বহু। সংস্পর্শে না এলে জাত বোঝা যায় না। যেমন আমি এখন চারটে বাঁশের পাল্লায় পড়েছি। চারটেই আছোলা এবং নগদ মূল্যে কেনা।’ বোঝাই যায়, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা যতক্ষণ না হচ্ছে, বাঁশবনে ডোম কানা হয়ে থাকাই ভবিতব্য।
শুরুতে যা বলছিলাম, সময়ের সঙ্গে বাঙালি বদলেছে; কিন্তু তার জীবনে বাঁশের ভূমিকা বিশেষ বদলায়নি। একদা সে বাঁশের কেল্লা বানিয়েছিল। কালক্রমে ব্যাপারটা বাঁশের প্যান্ডেলে এসে ঠেকেছে, বদল বলতে এটুকুই। আমাদের কাছে বংশ দিবস ফংশ দিবসের এইসব সচেতনতা বৃদ্ধি অভিযানের তাই আদৌ কোনও প্রাসঙ্গিকতা নেই। তা ছাড়া বাঙালির গুরুদেবও তো সেই কবে বলে গিয়েছেন, ‘বাঁশ কহে, ভেদ তাই ছোটোতে বড়োতে, / নত হই, ছোটো নাহি হই কোনোমতে।’ সে-কথাও আমাদের কঞ্চিবৎ এঁড়ে জীবনে মনে রাখার মোটে প্রয়োজন পড়েনি। আরে ভাই, বাঁশ না হয়ে উঠতে পারি, বাঁশের গাঁটটুকু তো হয়েছি! তাই-বা কম কী?