‘ধন্যি মেয়ে’ ছবিতে উত্তমকুমারের বউ, কিংবা গিন্নি বললে বোধহয় আরও সঠিক হবে। নিজের জীবনেও সাবিত্রী হয়তো এটাই হতে চেয়েছিলেন। উত্তমের ছবিতে সুচিত্রা সেনকে কখনও কখনও তার বউ হিসেবেও পেয়েছি আমরা। কিন্তু সাবিত্রীর মধ্যে কোনও অভিনয়, বা সাজানো ব্যাপার নেই উত্তমের গিন্নি হয়ে ওঠার মধ্যে। ছবির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি উত্তমের বিয়ে করা বউ।
সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, এই নামের উচ্চারণ মুহূর্তে মনে আনে কানায়-কানায় ভর্তি টলটলে সরোবর। দীঘল আঁখিপাতে সরোবর! এলোচুলে সরোবর! সাবলীল সহজ স্নিগ্ধতায় সরোবর! এমনকী, ছবির পর ছবিতে, উত্তমকুমারের সঙ্গে মিষ্টি খুনসুটিতেও সরোবর! তবে সাবিত্রী সবথেকে বেশি সরোবরময়ী বাঙালি মেয়ের অবিকল্প আর্দ্রতায়! এমনটি আর হয়নি কখনও। হবেও না। ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ ছবিতে এইটে বোঝা গেল আগাগোড়া। যত বেড়েছে মরুভূমির রুক্ষতা, উত্তাপ, অনন্ত বালির জলহীন যন্ত্রণা আর যাত্রীদের তৃষ্ণা, সাবিত্রী ততই যে হয়ে উঠেছেন আর্দ্রতার অলীক আহ্বান। এই আর্দ্রতা তার শরীরে ফুটিয়ে তোলা, মরুভূমির প্রতত তৃষ্ণার্ত ক্ষমতার মধ্যে, শুধুমাত্র বাঙালি মেয়ের লাবণ্যের পক্ষেই সম্ভব– কোনও সাজগোজহীন, প্রলেপবর্জিত নিজস্ব স্বভাব ও শরীরের লাবণ্যময় বহতা। এই হল ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’-এর সাবিত্রী।
সুচিত্রা-সুপ্রিয়া-অপর্ণা: এঁদের সৌন্দর্য ও আবেদন অন্য জাতের। সাবিত্রী সত্যিই বাংলা দেশের ঘাট-বাঁধানো টলমলে স্নিগ্ধ ডুব দেওয়ার সরোবর। ডুব দিয়েছিলেন বাংলার দুই শ্রেষ্ঠ নায়ক। উত্তম ও সৌমিত্র। এবং দু’জনেই বলে গেছেন, এমন আর হয় না। দু’জনেই ভিন্নার্থে প্রশংসা করেছিলেন, মুগ্ধ হয়েছিলেন, সাবিত্রীর তারল্যে। দু’জনেই নিজেদের ভাবে, ভাষায় ভঙ্গিতে স্বীকার করেছেন একটি অন্তরকথা। সাবিত্রীর তারল্যই তাঁকে মানানসই করে প্রবাহিত করেছে একটির পর একটি বাংলা ছবির নায়িকা-চরিত্রে। সাবিত্রীর তারল্যই তাঁকে বিশ্বস্ত করে তোলে যে কোনও চরিত্রে। সাবিত্রী ‘অভিনয়’ করেন না। তিনি ‘হয়ে ওঠেন’ সেই চরিত্র, যে চরিত্রে তাঁর অভিনয় করার কথা। যে দ্রবতা সাবিত্রীর সৌন্দর্য ও আবেদনের অঙ্গ, সেই দ্রবতাই তাঁর অভিনয়ে বয়ে আনে বাস্তবের স্পর্শময়তা– তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালির নিত্যদিনের পাশের বাড়ির মেয়ে, চেনা প্রেমিকা, ভালোবাসার বউদি, আটপৌরে গৃহবধূ, মানে-অভিমানে, সংসারের দুঃখে-কষ্টে, আবার আমোদে-আহ্লাদে এতটাই বাস্তব ও বিশ্বাস্য– তাঁকে দূরের মনে হয় না কখনও, কেমন যেন তাঁর কাছেই বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে! এই যে সাবিত্রীকে আমরা পাশের বাড়ির মেয়ে হিসেবে পাই, তাঁকে নায়িকা-গ্ল্যামারের দূরত্বে সরিয়ে রাখতে চাই না– সেটা কিন্তু একেবারে তাঁর অভিনয় জীবনের শুরু থেকেই, তাঁর প্রথম হিট ছবি সম্ভবত ‘পাশের বাড়ি’! সেই যে আমাদের পাশের বাড়ির বাসিন্দা হলেন তিনি, হলেন একই সঙ্গে চেনা ডাক ও সাড়া, আজও কিন্তু তিনি তাই। তাঁর খ্যাতি ও সাফল্য তাঁকে সরিয়ে নিয়ে যায়নি আমাদের থেকে ঢিল-ছোড়া দূরত্বের বাস্তব থেকে এতটুকুও দূরে! আবার এই নৈকট্য কিন্তু নষ্ট করল না কোনওদিনই সাবিত্রীর কুহক।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এক সময়ে স্টার থিয়েটারে ‘শ্যামলী’ নাটকে দিনের পর দিন অভিনয় করেছেন উত্তমকুমার এবং বোবা মেয়ের চরিত্রে সংলাপহীন নায়িকা সাবিত্রী। হাতিবাগান অঞ্চলে স্টার থিয়েটারের সামনে সাবিত্রী-উত্তমের সেই যুগলবন্দি মঞ্চে দেখতে বাঙালির ভিড় সামলাতে হিমশিম খেয়েছে পুলিশ– বাঙালি সংস্কৃতিতে সেই যুগ আর কোনও দিন ফিরে আসবে না!
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
উত্তমকুমারের সঙ্গে সাবিত্রীর একটি হিট ছবির নামও কিন্তু ‘কুহক’– মনে এল সেই কথাটা। যে-ছবিতে উত্তমকুমার ঘুরে বেড়ায় যাত্রা দলের সঙ্গে গান গেয়ে। আর সাবিত্রী ঘরবন্দি বাঙালি মেয়ে। আশ্চর্য, সেই ছবির রোমান্টিক কুহক কিন্তু আজও মরে যায়নি। এবং তার একটা বড় কারণ, সাবিত্রীর টান। যে-টানে সাড়া দিলেন উত্তম! এবং মজল বাঙালি।
এক সময়ে স্টার থিয়েটারে ‘শ্যামলী’ নাটকে দিনের পর দিন অভিনয় করেছেন উত্তমকুমার এবং বোবা মেয়ের চরিত্রে সংলাপহীন নায়িকা সাবিত্রী। হাতিবাগান অঞ্চলে স্টার থিয়েটারের সামনে সাবিত্রী-উত্তমের সেই যুগলবন্দি মঞ্চে দেখতে বাঙালির ভিড় সামলাতে হিমশিম খেয়েছে পুলিশ– বাঙালি সংস্কৃতিতে সেই যুগ আর কোনও দিন ফিরে আসবে না! সাবিত্রী কথা বলতে পারেন না। কী অনন্য অসাধারণ সেই সংলাপহীন অভিনয়! এবং কী সুন্দর সেই সাবিত্রী! যাঁরা দেখেছেন সেই সাবিত্রীকে ভুলতে পারেননি। তাঁদের কেউ কেউ বলেন আজও, সেই বাক্যহীন সুন্দরী বাঙালি মেয়েকে দেখেও আমরা হয়ে গিয়েছিলাম বাক্যহীন মুগ্ধ!
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: মাতৃভাষা, মানে মায়ের বুলি, মানে মায়ের ডায়লগ
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
‘ভ্রান্তিবিলাস’, ‘কাল তুমি আলেয়া’, ‘নিশীপদ্ম’, ‘ধন্যি মেয়ে’, ‘গলি থেকে রাজপথ’– পিছন ফিরে তাকালে সাবিত্রীময় হতে হয়। ‘ধন্যি মেয়ে’ ছবিতে উত্তমকুমারের বউ, কিংবা গিন্নি বললে বোধহয় আরও সঠিক হবে। নিজের জীবনেও সাবিত্রী হয়তো এটাই হতে চেয়েছিলেন। উত্তমের ছবিতে সুচিত্রা সেনকে কখনও কখনও তার বউ হিসেবেও পেয়েছি আমরা। কিন্তু সাবিত্রীর মধ্যে কোনও অভিনয়, বা সাজানো ব্যাপার নেই উত্তমের গিন্নি হয়ে ওঠার মধ্যে। ছবির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি উত্তমের বিয়ে করা বউ। গুলি মারো অভিনয়ে! এ-ছবির দৃশ্যের পর দৃশ্যে কর্তা-গিন্নি উত্তম-সাবিত্রীর ঝগড়ার মধ্যে গভীর ভালোবাসার অন্তর স্রোতটি কী অছিলায়, কিংবা কী অবিশ্বাস্য স্বাভাবিকতায় ধরে রেখেছেন। কে বলবে তিনি উত্তমের বহু বছরের গিন্নি নন! কোনও দিন কি বাঙালি তুলবে সে দৃশ্য, যে দৃশ্য, যে-দৃশ্যে উত্তম স্বপ্নের মধ্যে গভীর রাতে ফুটবল খেলছেন। এবং পাশে শুয়ে থাকা সাবিত্রীর কোমরে মারছেন মোক্ষম লাথি। আর লাথির ধাক্কায় খাট থেকে গিন্নি সাবিত্রী ছিটকে যাচ্ছেন! স্বামীকে কত ভালোবাসলে এমন একটি স্বাভাবিক বাস্তব গিন্নি হওয়া যায়! এই প্রশ্নের মেনে নিয়ে সহজ সত্যি উত্তর দিয়ে গেছেন উত্তম তাঁর কোনও এক সাক্ষাৎকারে: সাবিত্রীর মতো ভালোবাসলে!
রিয়েঙ্কা ইউক্রেনের স্থানীয় ফুটবল দল নাইভা-র হয়ে গলা ফাটাত মাঠে গিয়ে। যুদ্ধের সময় চার মাস রুশ সেনার অধীনে বন্দিত্ব এবং ছাড়া পেয়ে ফ্রন্টলাইনে রাইফেল নিয়ে থাকা। গত ২১ মে মাত্র ২১ ছোঁয়া রিয়েঙ্কা চলে যায় গানশটে! গ্যালারিতে সেই মুখ, টিফো– লেখা– ‘পিস হ্যাজ আ প্রাইস’।