কলকাতার বাংলা আকাডেমির জীবনানন্দ সভাঘরের এক আলোচনাসভায় এই বহুরূপী-বৃত্তিকে বাঁচিয়ে রাখার ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছিলাম বলে ভীষণ হইচই বেধে গিয়েছিল। আমার বক্তব্য ছিল, চলমান জীবনের সঙ্গে সঙ্গে লোকসংস্কৃতিও রূপ বদলাবে। সেটাই স্বাভাবিক। লোকায়ত জীবনসংগ্রামের সঙ্গে লোকসংস্কৃতির প্রত্যক্ষ যোগ। যে লোককলা যুগপরিবর্তনের কারণে আর লোক-মানুষকে দুটো ভাত বা রুটি দিতে পারে না, তাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা লোকজীবনের সঙ্গে প্রতারণা।
‘বহুরূপী’ শব্দটা উচ্চারিত হলেই আবালবৃদ্ধ বাঙালির মনে ‘ছিনাথ বউরূপী’-র নামটাই ছলকে ওঠে। শরৎচন্দ্র তাঁর কলমের গুণে ছিনাথকে এক ঝলকেই জীবন্ত করে তুলেছিলেন। সাজ দেখাতে এসে ভীষণ বিপদে পড়ে গিয়েছিল ছিনাথ। দুটো হাত জোড়া করে মিনতি করে বলেছিল, ‘না বাবুমশাই, না। আমি বাঘ-ভলুক নই– ছিনাথ বউরূপী।’ কিন্তু সে মিনতিতে কাজ হয়নি। পিসেমশাই ছিনাথের খড়ের ওপর কালো-হলুদের ডোরা-দেওয়া কাপড় জড়ানো ল্যাজটি কেটে দেবার হুকুম দিয়েছিলেন। ছিনাথের সেই ল্যাজকাটা মূর্তি আর হেনস্থার রকম দেখে আমরা বেদম হেসেছি। কিন্তু কেউ ভেবে দেখিনি, সাধের ল্যাজটি নষ্ট হবার জন্যে ছিনাথের বাঘ সেজে সামান্য উপার্জনের কতখানি ক্ষতি হয়ে গেল! শরৎচন্দ্রের কাছে আমরা কেবল এটুকু জেনেই সন্তুষ্ট হয়েছি, তার বাড়ি বারাসতে। ছিনাথ সম্পর্কে আর কিছু জানার ইচ্ছেও কি হয়েছে আমাদের? হলে তারপরেও এতগুলো বছরে বাংলার লোকসংস্কৃতি নিয়ে এতরকম খোঁজখবর হলেও বহুরূপীদের নিয়ে কেউ তেমন মাথা ঘামালেন না কেন! অথচ অন্তত আজ যাদের পাঁচের কোঠাতেও বয়েস, তারা তো সবাই কোনও-না-কোনও দিন বহুরূপী দেখেছি দোরগোড়ায় বা পথে-ঘাটে মেলায়-মোচ্ছবে। দেখে মজা পেয়েছি, কিন্তু একবারের জন্যেও জানতে ইচ্ছে হয়নি ওরা কোথায় থাকে, আর কী করে, লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ ওদের দুয়ার পর্যন্ত পৌঁছয় কি না। এমনকী সাজের আড়ালে সেই বহুরূপীটির আসলে নামটা কি, তাও কোনওদিন জিজ্ঞেস করেছি আমরা?
১৯৮৬-’৮৭ সাল নাগাদ যখন এই বহুরূপীদের নিয়ে খোঁজখবর করতে শুরু করি, তখনই লক্ষ করেছিলাম ওদের নিয়ে তথ্যের কি ভীষণ অভাব! ওই শরৎচন্দ্রের মতো বাংলা সাহিত্যের আরও দু’-একজনের লেখায় বুদবুদের মতো ওদের কথা যেন ভেসে উঠেই মিলিয়ে গেছে! জাতিগোষ্ঠী সম্পর্কিত গবেষণাগ্রন্থগুলিতেও ওদের পেশা সম্পর্কে এইটুকু মাত্র উল্লেখ আছে যে, ওরা নানারকম বেশ ধারণে দক্ষ। কিন্তু পৃথিবীতে এত রকমের পেশা থাকতে এই বিশেষ মানুষগুলোকে এইরকম একটা উপার্জনের রাস্তা বেছে নিতে হল কেন, আসলে ওরা কারা, স্ত্রী-পুত্রপরিবার নিয়ে ওরা কিরকমভাবে বেঁচে থাকে, সেসব আমরা কেউ ভেবেও দেখিনি!
বহুরূপীদের সম্পর্কে আমার প্রথম অভিজ্ঞতাটি প্রকাশিত হয়েছিল বহরমপুরের শারদীয় ‘জনমন জনমত’ পত্রিকায় ১৯৮৮ সালে ‘প্রসঙ্গ বহুরূপী’ নামে। এর প্রায় পরে-পরেই বহরমপুরের রবীন্দ্রসদনে ১৯৮৮-র ৯ ও ১০ অক্টোবর আয়োজন করেছিলাম ‘প্রথম বহুরূপী রাজ্য-সম্মেলন’। এই গবেষণা ও সম্মেলনের আয়োজন সম্ভব হয়েছিল বহরমপুরের স্বনামধন্য শিক্ষক নির্মল সরকার, মুর্শিদাবাদের তৎকালীন তথ্যসংস্কৃতি আধিকারিক উৎপল ঝা, বাউল-ফকির বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শক্তিনাথ ঝা এবং স্থানীয় বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি। এই সম্মেলন-অনুষ্ঠানে কলকাতা দূরদর্শনের ‘সাহিত্য-সংস্কৃতি’ বিভাগ যে সাক্ষাৎকার ও সম্মেলনের চিত্রমালা সংগ্রহ করেছিল, তা সভাষ্য সম্প্রচারিত হয় ১৮ নভেম্বর ১৯৮৮-তে। বলতে গেলে বহুরূপীদের সম্পর্কে সমগ্র বাংলায় কৌতূহল সঞ্চারিত হয়েছিল কলকাতা দূরদর্শনের কল্যাণেই। এরপর আমার আরও একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় ১৯৮৯-এর ১৫ জানুয়ারি ‘গণশক্তি’ পত্রিকায়। বহুরূপীদের সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থান বিষয়ে আমার একটি দীর্ঘ রচনা ওই বছরেই প্রকাশিত হয় শারদীয় ‘নন্দন’ পত্রিকায়। অবশেষে ১৯৯০-তে আমার মূল গবেষণাগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ‘বাংলার বহুরূপী প্রসঙ্গ’ শিরোনামে। বহুরূপী সংক্রান্ত সন্ধানের ইতিহাস হিসেবে এগুলি ভবিষ্যৎ গবেষকেদের কাজে লাগলেও লাগতে পারে হয়তো-বা।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
১৯৮৬-’৮৭ সাল নাগাদ যখন এই বহুরূপীদের নিয়ে খোঁজখবর করতে শুরু করি, তখনই লক্ষ করেছিলাম ওদের নিয়ে তথ্যের কি ভীষণ অভাব! ওই শরৎচন্দ্রের মতো বাংলা সাহিত্যের আরও দু’-একজনের লেখায় বুদবুদের মতো ওদের কথা যেন ভেসে উঠেই মিলিয়ে গেছে! জাতিগোষ্ঠী সম্পর্কিত গবেষণাগ্রন্থগুলিতেও ওদের পেশা সম্পর্কে এইটুকু মাত্র উল্লেখ আছে যে, ওরা নানারকম বেশ ধারণে দক্ষ। কিন্তু পৃথিবীতে এত রকমের পেশা থাকতে এই বিশেষ মানুষগুলোকে এইরকম একটা উপার্জনের রাস্তা বেছে নিতে হল কেন, আসলে ওরা কারা, স্ত্রী-পুত্রপরিবার নিয়ে ওরা কিরকমভাবে বেঁচে থাকে, সেসব আমরা কেউ ভেবেও দেখিনি!
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
বহুরূপীদের সন্ধানে একসময় ছুটে বেড়িয়েছি মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান, বীরভূমের মাঠেঘাটে। কখনও রাধারঘাট, কখনও বিষয়পুর, কখনও বা দাঁইহাট বা জামুড়িয়ায়। এই জামুড়িয়াতেই দেখেছি ব্যাধ কালকেতুর সংসারের অভাবী ছবি– ‘আমানি খাবার গর্ত’!
নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ে ওরা ব্যাধ– ওদের উচ্চারণে ‘বেদ’, অথবা বলে ‘পাখমারা’। জাল কিংবা আটাকাঠি অথবা সাতনলি দিয়ে পাখি মারা ওদের আর একটা সমান্তরাল পেশা। সঙ্গে আছে মৌচাক ভেঙে মধুসংগ্রহ। পাখিশিকার এখন নিষিদ্ধ। ধরা পড়লে জরিমানা। জঙ্গল উজাড় করে নগরের বিস্তারে মৌচাকও এখন দুর্লভ। তাহলে ব্যাধের হাতে উপার্জনের জন্যে হাতে রইল কি!
কোন অতীতেই নাকি উচ্চবর্ণের কাছে এইসব অচ্ছুত অপাঙক্তেয়রা সামাজিক-অর্থনৈতিক যাবতীয় অধিকার থেকে বিচ্যুত হয়ে পৌরাণিক দেবদেবীদের রূপসজ্জা ধারণকেই বেছে নিয়েছিল উপার্জনের পন্থা হিসেবে। তারই অবশেষ বয়ে চলেছে আজকের এই বহুরূপীরা।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আরও পড়ুন: শুধু থিয়েটার করা নয়, থিয়েটার নিয়ে কথা বলা ও শোনার পরিসর তৈরি করেছে বহুরূপী পত্রিকা
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
কলকাতার বাংলা আকাডেমির জীবনানন্দ সভাঘরের এক আলোচনাসভায় এই বহুরূপী-বৃত্তিকে বাঁচিয়ে রাখার ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছিলাম বলে ভীষণ হইচই বেধে গিয়েছিল। আমার বক্তব্য ছিল, চলমান জীবনের সঙ্গে সঙ্গে লোকসংস্কৃতিও রূপ বদলাবে। সেটাই স্বাভাবিক। লোকায়ত জীবনসংগ্রামের সঙ্গে লোকসংস্কৃতির প্রত্যক্ষ যোগ। যে লোককলা যুগপরিবর্তনের কারণে আর লোক-মানুষকে দুটো ভাত বা রুটি দিতে পারে না, তাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা লোকজীবনের সঙ্গে প্রতারণা।
গত শতকের শেষ দশক পর্যন্ত আমার পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েছিল, বহুরূপীরা জাতিগত পরিচয়ে মূলত ব্যাধ। তারা নিজেরাই বলে, ‘আমরা মহাভারতের জরা ব্যাধের বংশধর। আমরা এসেছি গুজরাত থেকে।’ সত্যিমিথ্যে জানি না! তবে শ্রীকৃষ্ণের পায়ে জরাসন্ধ ব্যাধ বিষ-তির মেরেছিল গুজরাতের দ্বারকাতেই!
কিন্তু এখন আমি এক অন্যরকম সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছেছি। তারকেশ্বরের কাছে জ্যোতশম্ভু গ্রামে দেখেছি অন্যরকম ছবি। দেখেছি, ওসব জাতিতত্ত্ব-নৃতত্ত্বের গবেষণা মিছে! আসল কথাটা সেই ক্ষুধা। মানুষের খড়কুটো আঁকড়ে বেঁচে থাকার অন্যতম পন্থাই বোধহয় বহুরূপী-বৃত্তি।
কেন বলছি একথা? কারণ জ্যোতশম্ভুতে কেউ বংশপরম্পরায় বহুরূপী নয়। ব্যাধদের সঙ্গে এদের দূরতর সম্পর্কও নেই। এরা কেউ কারখানায় কাজ করত, কেউ মালিকের রিক্সা ভাড়ায় টানত, কেউ বাজারে তরিতরকারি বেচত। কাজ হারিয়ে এখন এক মহাজনের কাছে পোশাক ভাড়া নিয়ে সাজ দেখিয়ে ওরা বেঁচে থাকার রাস্তা খুঁজেছে। আর পাখমারা-বহুরূপীরা এখন কেউ অনুষ্ঠানবাড়িতে সঙ সাজে, কেউ ফুচকা বেচে, কেউ আবার ঘোড়ানাচের ঘোড়া বানিয়ে মেলাখেলায় যায়!
মনে পড়ে যায় জাতকের একটা গল্পের কথা। দুঃখী রাজার মনোরঞ্জনের জন্যে নানান বাজিকর এসেছে রাজবাড়ির আঙিনায়। এক খেলোয়াড়কে লম্বা তলোয়ার গলায় আমূল ঢুকিয়ে দিতে দেখে রাজা জিজ্ঞেস করলেন যে, এমন ভয়ংকর খেলা ওরা দেখাচ্ছে কেন? মন্ত্রী বললেন, ‘মহারাজ, ওরা এসব করছে শুধুই ক্ষুধার জন্যে!’