বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের প্রথম কবিতার বই ‘গভীর এরিয়েলে’ প্রকাশিত হয়েছিল ওঁর ছাত্রজীবনে। দ্বিতীয় কবিতার বই ‘কফিন কিংবা সুটকেস’-এর পাণ্ডুলিপি ভরসা করে বুদ্ধদেবদা আমাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। আমরা তাঁর ভরসার কিছুমাত্র অমর্যাদা করিনি। বইটির অসাধারণ প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছিলেন আমাদের প্রিয় শিল্পী পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায়। ধীরে ধীরে বুদ্ধদার চলচ্চিত্র সংক্রান্ত ব্যস্ততা বাড়তে লাগল। কবিতা লেখাও চলল, সঙ্গে ছেদসহ রবিবারের আড্ডা।
আবার এসে গেল ১০ জুন। দেখতে দেখতে কেটে গেল তিন তিনটে বছর। বুদ্ধদেবদা, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত নেই। করোনা তখনও স্বমহিমায়, লকডাউন চলছে। আমার দ্বিতীয় ডোজ নেওয়া হলেও বুদ্ধদেবদার নেওয়া হয়নি। আকাশ কালো মেঘে ঢাকা। থমথমে আবহাওয়া মধ্যে বুদ্ধদেবদা চলে গেলেন। অনেক দিন ধরেই অসুস্থ, সপ্তাহে তিনবার ডায়ালিসিস চলত। অথচ তখনও একেক দিন ফোন করে জিজ্ঞেস করতেন নিয়মিত, ‘ভালো গল্প কিছু পড়লে?’ তারপর সেই অবধারিত প্রশ্ন, “কবে আসছ? এবার গৌরীকেও নিয়ে এসো, আমরা ক’দিন একসঙ্গে থেকে অনেকগুলো পড়ে থাকা কাজ গুছিয়ে নেব।”
‘কবে আসছ?’ বুদ্ধদেবদার রোজের প্রশ্ন, এমনকী, আগের দিন দেখা হলেও। এমনকী, লিফ্ট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসে লিফ্টের দরজা বন্ধ হওয়ার পূর্ব মুহূর্তেও।
২০২১ সালের মে মাসের শেষের দিকে দিল্লি থেকে ফিরেছি। বুদ্ধদেবদা রোজই তাড়া দিচ্ছেন ‘রুচিরা’য় যাওয়ার জন্য। পড়ে থাকা কাজ গুছিয়ে নেওয়ার তাগিদ। আসলে ৫০-৫১ বছরের সম্পর্কের কাল গড়িয়ে এসে আমি জানি, বাকি সবই অছিলা। আসলে এত ডাকাডাকির অনেকটাই আড্ডা মারার জন্য। পুরনো দিনের কথা, হারিয়ে দেওয়া বন্ধুদের কথা, আর কিছু অন্তরঙ্গ আলাপচারিতা। কাজ বলতে আগামী কোনও বইয়ের পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করা, কবিতা সমগ্রর এবং চিত্রনাট্য সংগ্রহের দ্বিতীয় খণ্ড নিয়ে আলোচনা, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বুদ্ধদেবদার সিনেমা বা সাহিত্য-সংক্রান্ত গদ্যগুলিকে ফাইলবন্দি করে ফেলা। ‘উড়োজাহাজ’ শেষ। প্রশংসিত। সবচেয়ে বড় কাজ তাই বুদ্ধদেবদার কাছ থেকে সম্ভাব্য আগামী ছবির গল্প শোনা ও মতামত দেওয়া।
১৯৭০ সালে, বছর উনিশ-কুড়ির সদ্য কৈশোর পেরনো, আমাদের সঙ্গে যে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের পরিচয় হয় হাওড়ার বেতাইতলা বাজারের কাছে একটা তিনতলা বাড়ির আড়াইতলার ঘরে, তাঁর সঙ্গে চলচ্চিত্র জগতের কোনও যোগাযোগের কথা আমাদের জানা ছিল না। জানতাম, তিনি আদ্যন্ত একজন কবি এবং বর্ধমানের শ্যামসুন্দর কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক। বুদ্ধদেবদার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছিলেন গল্পকার অরূপরতন বসু। ‘কলকাতা’ পত্রিকায় লেখালিখির সূত্রে তাঁকে আমরা চিনতাম। ‘আমরা’ মানে আমি আর প্রিতম (মুখোপাধ্যায়)। ‘উলুখড়’ পত্রিকা প্রকাশ করতে আমরা সবে শুরু করেছি।
বুদ্ধদেবদার বাড়ি থেকে বলা হল, রবিবার সকালে এলে ওঁর সঙ্গে দেখা হবে। প্রথম রবিবারই আমাদের আড্ডাটা জমে গেল! তারপর সেই আড্ডা গড়িয়ে চলল প্রায় প্রতি রবিবারই। বেলা বাড়লে সেই আড্ডার ‘লাঞ্চ ব্রেক’ যার যার বাড়িতে। তারপরও আড্ডার মুড থাকলে কোনও কোনও দিন আড্ডার দ্বিতীয় অধিবেশন বসত আমাদের বাড়িতে। আমরা যেমন সকালবেলা পুরনো শিবপুরের অলিগলি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম বুদ্ধদেবদার বাড়ি, আবার বিকেলবেলা ওই রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বুদ্ধদেবদা চলে আসতেন আমাদের বাড়ি। আড্ডা বেজে উঠত আবার। এই আড্ডাতেই আমরা জানতে পারি, বুদ্ধদেবদার সিনেমা-স্বপ্নের কথা। জানতে পারি, স্নাতকোত্তর পড়ার সময়ই তিনি একটি স্বল্প-দৈর্ঘ্যের ছবি ‘কন্টিনেন্ট অব সার্সি’ বানিয়ে প্রশংসিত হয়েছেন। ওই ছবির নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন মীনাক্ষী দত্ত। বুদ্ধদেব বসুর প্রথম কন্যা ও ‘কলকাতা’ পত্রিকার সম্পাদক কবি ও সাংবাদিক জ্যোতির্ময় দত্তের স্ত্রী। গ্র্যাজুয়েশনের পর, বুদ্ধদাই আমাদের সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে ‘ক্যালকাটা সিনে ইনস্টিটিউট’-এর সদস্য করে দেন।
বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের প্রথম কবিতার বই ‘গভীর এরিয়েলে’ প্রকাশিত হয়েছিল ওঁর ছাত্রজীবনে। দ্বিতীয় কবিতার বই ‘কফিন কিংবা সুটকেস’-এর পাণ্ডুলিপি ভরসা করে বুদ্ধদেবদা আমাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। আমরা তাঁর ভরসার কিছুমাত্র অমর্যাদা করিনি। বইটির অসাধারণ প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছিলেন আমাদের প্রিয় শিল্পী পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায়। ধীরে ধীরে বুদ্ধদার চলচ্চিত্র সংক্রান্ত ব্যস্ততা বাড়তে লাগল। কবিতা লেখাও চলল, সঙ্গে ছেদসহ রবিবারের আড্ডা। এই আড্ডাতেই আমরা পরিচিত হলাম বুদ্ধদেবদার বন্ধু আমাদের প্রিয় কবিদের সঙ্গে। সুব্রত চক্রবর্তী, ভাস্কর চক্রবর্তী, শামশের আনোয়ার। বুদ্ধদেবদার আরেক বন্ধু দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কেন জানি না কিছুতেই আমাদের ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়নি। এক রবিবার আমরা সকাল থেকে দুপুর খুব অন্তরঙ্গভাবে দীপক মজুমদার ও তাঁর স্ত্রী ক্যারসকে এই আড্ডায় পেয়েছিলাম। সঙ্গে ছিল তাঁদের শিশু সন্তান। দীপক মজুমদার গ্রিস থেকে ফিরে তখন অন্যান্য কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ‘গোলকধাঁধা’ নামে এক কাগজ-সম্পাদনা করছিলেন।
রবিবারের এই আড্ডায় আমরা সুব্রতদাকে মাঝেমধ্যেই পেতাম। ভাস্করদাকে খুব কম। শামশের আনোয়ারকে আরও কম। এক রবিবার সকালে হাজির হয়ে দেখি সুব্রত চক্রবর্তী ইতিমধ্যেই উপস্থিত। বন্ধুকে পেয়ে বুদ্ধদেবদাও খুব ভাল মুডে। আড্ডা জমে উঠল দারুণ। সুব্রতদা ও বুদ্ধদেবদা তাঁদের নতুন কবিতা শোনালেন বেশ কিছু। আমিও পড়েছিলাম। প্রিতম তো কবিতা লেখে না আর গল্পপাঠে তার তীব্র অনীহা। সবই ঠিক ছিল, গোল বাধল আড্ডায় ইতি টেনে আমরা যখন বাড়ির দিকে রওনা হব। বুদ্ধদা বললেন, ‘তোমরা বাড়ি থেকে খাওয়া-দাওয়া সেরে অরণির বাড়িতে চলে এসো। আমরা যাচ্ছি। আজ সুব্রতর অনারে ম্যারাথন আড্ডা হবে।’ আমি বেশ ঘাবড়ে গেলাম। আজ তো বিকেলে আমাদের রবীন্দ্রসদনে ‘টিনের তলোয়ার’ দেখতে যাওয়ার কথা। কবে থেকে প্ল্যান করে টিকিট কেটে রাখা। উত্তর দিচ্ছি না। চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। আমার এহেন ল্যাজে-গোবরে অবস্থা দেখে প্রিতম হাল ধরল। বলল, “বুদ্ধদা আমরা আজ বিকেলে রবীন্দ্র সদনে ‘টিনের তলোয়ার’ দেখতে যাব।”
যা ভেবেছিলাম তাই। বুদ্ধদা ভীষণ চটে গেলেন। ‘আমাদের টিকিট কাটেনি কেন?’ কী করে জানব বুদ্ধদেবদা যেতে পারেন? কী করে জানব, সুব্রতদা আজকে বর্ধমান থেকে আসবেন? কিন্তু বুদ্ধদা যখন রেগে যান কোনও যুক্তিতর্কই আর কাজ করে না তখন। সুব্রতদা কিছুই বলছেন না, একটা বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছেন আর কালো, মোটা ফ্রেমের চশমার ভিতর দিয়ে পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছেন। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বুদ্ধদা বললেন, ‘চলো, দেখি আমাদের দুটো টিকিট পাওয়া যায় কি না।’ আমি মিনমিন করে বললাম, ‘আজ সকালে কাগজে দেখলাম প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ।’ সুব্রতদা বুদ্ধদার দিকে তাকিয়ে। আমরাও। বুদ্ধদা বললেন, ‘বাড়ি যাও। তিনটের সময় আমরা আসছি। দেখা যাক কী হয়!’
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন অরণি বসু-র লেখা: রবি ঘোষের চোখের সামনেই তাঁর প্রথম বইয়ের পুরো লট পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল বইমেলায়
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
তখন বিদ্যাসাগর সেতু স্বপ্নেরও বাইরে। ৬.৩০টায় শো। আমরা বাড়ি থেকে বেরলাম পৌনে ৪টে। শিবপুর ট্রামডিপো-ধর্মতলা-রবীন্দ্রসদন। খুব বেশি কথা নেই কারওর মুখেই। আমার তো ঘোর দুশ্চিন্তা, ‘টিনের তলোয়ার’ দেখা হবে তো শেষপর্যন্ত! রবীন্দ্রসদনে পৌঁছে প্রথমে চা খাওয়া আর টিকিটের যথাসাধ্য খোঁজখবর করা হল। টিকিট পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। ৬.১৫ নাগাদ সুব্রতদা বললেন, ‘তোরা হলে ঢুকে যা। আমরা বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়াম যাচ্ছি। শেষ হলে আমরা এই ফোয়ারার পাড়ে অপেক্ষা করব। একসঙ্গে ফিরব।’ বুদ্ধদেবদা আমার দিকে চেয়ে মুচকি মুচকি হাসছেন।
বিস্ময় আর কৃতজ্ঞতার ডানায় ভর করে আমরা হলে ঢুকলাম। ‘টিনের তলোয়ার’ মন ভরিয়ে দিল। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে দেখি দু’জন তরুণ কবি ও অধ্যাপক, ফিজিক্স আর অর্থনীতির, ফোয়ারার পাড়ে বসে বসে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসা দর্শকদের ওপর লক্ষ রাখছেন। প্ল্যানেটোরিয়ামের শো শেষ হয়েছে দেড় ঘণ্টা আগে। দেড় ঘণ্টা ধরে এঁরা অপেক্ষা করছেন শুধু আমাদের মতো দু’জন অর্বাচীনের সঙ্গে একসঙ্গে বাড়ি ফিরবেন বলে। বেণীমাধব, রঙিন ঝরনা, আকাশের ঝকঝকে চাঁদ– কৃতজ্ঞতায়, ভালোবাসায় চোখ জলে ভরে আসে। মনে মনে বলি, যেন এই ভালোবাসার যোগ্য হতে পারি।
আবার আর একদফা চা। তারপর কিছুটা হেঁটে, কিছুটা বাসে বাসে বাড়ির দিকে। আর অনেক কথা।
সুব্রতদা চলে গেছেন ১৯৮০ সালের ১০ জানুয়ারি। বুদ্ধদেবদা ২০২১ সালের ১০ জুন ঘোর লকডাউনের মধ্যে মেঘে মেঘে আঁধার করে আসা এক সকালে। এঁরা কেউই কিন্তু আমার জীবন থেকে হারিয়ে যাননি। এঁদের ভোলা সম্ভব নয়।
ভুলে যাওয়া এতই সহজ!
……………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………..