বাঙালির ন্যাড়া পোড়ার সঙ্গে হোলিকা দহনের কিছুটা হলেও পার্থক্য রয়েছে। হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী, হোলিকা দহনের সঠিক সময় পূর্ণিমার রাত। হোলির আগের দিন পূর্ণিমার রাতে বনফায়ার করে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করা। কাঠের মতো দাহ্য বস্তু এবং পুজোর সমস্ত উপকরণের সাহায্যে কোনও মন্দিরের কাছে ফাঁকা জায়গায় যজ্ঞ করাই হল হোলিকা দহন। একটি বিশেষ সময়ে সমস্ত রীতি-নীতি মেনে ভগবানের কাছে এই আহুতি দিয়ে আগুনকে পরিক্রমা করে পুজো সম্পন্ন করা হয়।
‘আজ আমাদের ন্যাড়া পোড়া কাল আমাদের দোল, পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে বলো হরি বোল।’ সবে শীতরোদ গিয়ে ধরার মরুপ্রান্তরে তুলেছে মর্মর ধ্বনি! ধূলিধূসরিত প্রান্তর। তবুও প্রকৃতি পরমায় জেগে থাকে জীর্ণতা। জীবনচক্রে এ যেন কালের কপালে ঋতুকালের বিলাপ! মায়াহীন কৌতুককর! সেই ফাগুন পূর্ণিমার থালা ভরা টকটকে কমলা চাঁদের নিচেই বেজে উঠত অদূরের বাঁশবনে চাঁচর পোড়া বা ন্যাড়া পোড়ার ঢোল! একদল উৎসব প্রিয় মানুষের উদ্দাম হট্টরোল।
বাঁশবনে তারই পাতা ঝরঝর বাজনায় আমাদের মেতে ওঠা একলা প্রকৃতির দোলে! ভালোবাসা ভালোবাসি। গাছে গাছে রঙের আয়োজন। শিরিষের বীজপত্র ঝুমঝুমি বাজিয়ে চলে লীলাসহচরী হয়ে সারা দুপুর। কোকিল কুহুতানে মনকেমনের এই গ্রামীণ আয়োজনে জীবন রঙের একলা ফাগুনমাস। পলাশ, শিমুল, আম, জাম, বট, পাকুড়ের মধুমাস। মৌমাছির গুঞ্জন ফুলে, মুকুলে। সেখানেই মনের মোহমায়া নিবিড়তাকে আঁকড়ে ধরে সোনালি রংমহল। এই আমাদের দোল! তখনও বেলা বাড়েনি! অবাধ্য প্রেমের ফাগুনমাস আগুন আগুন মনে হয়! উৎকট গরমে একান্ত ছেলেবেলার মোহে রং হাতে এদিক-ওদিক ঘোরা। প্রিয় নারীর গাল তখনও অধরা! আমাদের ছেলেবেলায় তখনও তৈরি হয়নি ফাগুন পূর্ণিমার শেষ চৈত্রের রাসমণ্ডপ। দক্ষিণা বাতাসে গা দুলুনি ভাব এসেছে আলতো সবে সবে।
সে সময়ের দোল মানে আমাদের সমবেত বন্ধুমহলে আগের দিনের আয়োজনে সারা হয়ে থাকত বাঁশের নলের ফিচকারি। আর তা নিয়ে কয়েক প্রস্তর এ ওর দিকে ছোড়াছুড়ি। কীর্তনের দল ঠিক করে রাখা! আর গুড় বাতাসা! মিষ্টি মুখ করিয়ে দেওয়া হত রং মাখিয়ে।
………………………………..
আমাদের ছোট মনে দাগ কেটে যায় সে কাহিনি। ঠাকুমা রাঙা পানের একটা পিক, ছাঁচ উঠানে ফেলে এসে বলল, রাজা ব্রহ্মার বর পেয়েছিলেন। আর এটাই ছিল রাজার অহংকার! সে বরে নিজেকে সে অমর মনে করতে শুরু করে। ব্রহ্মার দেওয়া রাজাকে পাঁচ বর। ‘সে পাঁচটা বর কি কি ঠাকুমা?’ আমাদের অধৈর্য লাগে! রাঙা ঠাকুমা নিজের গতিতে বলতে থাকেন গল্পের ফুঁপি!
………………………………..
গরিবের আয়োজনে পলাশ, শিমুলের পাঁপড়ি শুখানো আবির ছিল সে কালে। রাঙা ঠাকুমা কয়েকদিন রাত ও দুপুরের ঘুম নষ্ট করে আমাদের আবদারে করতেন সেসব সস্তার আয়োজন। পুই মেটুরির জাম রং। আর সেসব শেষ হলে গৃহকাজের বালতি নিয়ে জলে গোলা হত মা, কাকিমার ব্যবহারের আলতা, কখনও কখনও রান্নার হলুদ গুলে তৈরি হত রং। সে রং নিয়ে ছোটাছুটির অন্ত ছিল না পাড়া জুড়ে। গ্রামের এই গলি ওই গলি তখন নববৃন্দাবন! নিকুঞ্জবনের গোপীমহলে পাড়া জুড়ে দোলের লীলাময় কৃষ্ণ কেবল আমিই। নববধূর দল রং মাখার ভয়ে বাড়ির গৃহকোণে থাকত লুকিয়ে!
আমাদের ফিচকারি তৈরির অবসরে হোলির কয়েক দিন আগে থেকেই পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে রাঙা ঠাকুমার নাচ উঠানে বসত প্রাক্ দোলের আড্ডা। তার রান্নাশালার এক প্রস্তর মেঝের দখল নিতাম আমরা, সে ক’দিন। চাঁচর পোড়া, হোলি, শ্রীকৃষ্ণের লীলাময় আলোচনা, কীর্তনের পদ আর পদাবলি গাইত কপালে রসকলি এঁকে ঠাকুমা নিজেও। তার সুরেলা গলায় সে পদ দুপুরের নিস্তব্ধতাকে জয় করে ফিরত। আমরা মোহিত হয়ে শুনতাম রাক্ষসরাজ হিরণ্যকশিপুরের অত্যাচারের কথা। তাঁর সে অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেছিল প্রজাগণ। এক সময় রাজাকে দমন করতে অসহায় প্রজাদের আর্তি শোনা যায় নগরে নগরে। তবে রাজা যে দৈব বলে বলিয়ান! তাঁকে কোনও ভাবেই দমন করা সম্ভব নয়, বলেছিল রাঙা ঠাকুমা।
আমাদের ছোট মনে দাগ কেটে যায় সে কাহিনি। ঠাকুমা রাঙা পানের একটা পিক, ছাঁচ উঠানে ফেলে এসে বলল, রাজা ব্রহ্মার বর পেয়েছিলেন। আর এটাই ছিল রাজার অহংকার! সে বরে নিজেকে সে অমর মনে করতে শুরু করে। ব্রহ্মার দেওয়া রাজাকে পাঁচ বর। ‘সে পাঁচটা বর কি কি ঠাকুমা?’ আমাদের অধৈর্য লাগে! রাঙা ঠাকুমা নিজের গতিতে বলতে থাকেন গল্পের ফুঁপি!
এদিকে অধিকারীদের শেষ প্রস্তুতির চাঁচর পোড়ার আগুনের ঝলকানি বাজে পবনপুরের ফাঁকা মাঠের বাঁশবাগানের ঈশান আকাশের একটু মাথার দিকে। আমরা এক ঝলক তাকিয়ে, ফের ঠাকুমাকে বলি– ‘তারপর!’ ঠাকুমা বলতে শুরু করে, ভাই রে সে সব দেব-দৈত্যের কাহিনি! সামান্যে তার মর্ম বোঝা কঠিন! নবীন চিৎকার করে বলে, ‘ও ঠাকুমা বলো গো বলো! রাত হয়ে এলো!’ ঠাকুমা শুরু করে পাঁচ বরের কথা দিয়ে।
প্রথম বরে ছিল কোনও মানুষ, কোনও প্রাণী তাঁকে মারতে পারবে না। ঘরের ভেতরে, ঘরের বাইরে তাঁর মৃত্যু হবে না। তাঁর মৃত্যু দিনেও হবে না, আবার রাতেও হবে না। অস্ত্র দ্বারাও হবে না! জানিস ভাই, এই ভয়ঙ্কর রাজা দস্যু হিরণ্যকশিপুরের মৃত্যু জমিতেও হবে না, জলেও হবে না আবার শূন্যেও হবে না! রাজা যখন অমরত্ব লাভের তপস্যায় ছিল, তাঁর তপস্যায় খুশি হয়ে এই বর দেন স্বয়ং ব্রহ্মা। এই শুরু হয় অত্যাচার। এদিকে রাজা হিরণ্যকশিপুরের সন্তান হল ভক্ত প্রহ্লাদ। সে আবার ছিল বিষ্ণুর পূজারি। রাজা নিজের সন্তান প্রহ্লাদকে প্রাণে মারার চেষ্টা করে বিষ্ণুর পূজারি বলে।
এদিকে দুষ্টু হোলিকা জানিয়েছিল হিরণ্যকশিপুরকে, ব্রহ্মার বরে পাওয়া চাদর যদি তিনি জড়িয়ে আগুনের মধ্যে বসেন, তাহলে তাঁর গায়ে আগুন লাগবে না কোনও ভাবেই। তবে অন্যরা পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। ছালনাময়ী হোলিকা! এই বরকেই কাজে লাগালেন রাজা হিরণ্যকশিপুর। কিন্তু দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনে ঘটনার পটভূমি বদলে যায় বাছা! হিরণ্যকশিপুর একসময় হোলিকাকে বলেন, প্রহ্লাদকে সঙ্গে নিয়ে অগ্নিকুণ্ডে তাঁকে বসতে হবে। এদিকে প্রহ্লাদও ছল করে হোলিকার কোলে বসে পড়ে। অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হলে দেখা যায়, হোলিকার সেই বিশেষ পরিধান বিষ্ণু তার ভক্তকে প্রাণে বাঁচাতে ঝোড়ো হাওয়ায় বইয়ে দিয়ে ওই চাদর দিয়ে দেন প্রহ্লাদের ওপরে। ঘটনাচক্রে সে চাদরে মুড়ে যায় প্রহ্লাদের সারা শরীর।
অন্যদিকে পুড়ে ছাই হয়ে যায় হোলিকা। প্রজাগণ মনে করে, রাজা হিরণ্যকশিপুরের এই অশুভ শক্তির চেয়ে ভক্তির শক্তি অনেক বেশি। কথিত রয়েছে, হোলির আট দিন আগে ভক্ত প্রহ্লাদের ওপর রাজা হিরণ্যকশিপুর প্রচণ্ড নির্যাতন শুরু করেছিলেন। এই সময়কে বলা হয় হোলাষ্টক। তাই কোনও শুভ কাজ এই সময়ে হয় না! সে কারণে আজও ন্যাড়া পোড়া পালন করে সমস্ত অশুভ শক্তিকে মুছে তারপর শুরু হয় পূজার্চনা। চৈতন্যের এই প্রেমময় রং এর উৎসবের আগে তাই অধিকারীদের বাঁশবনে চাঁচর-পোড়ানো হয় ভাই।
ছেলেবেলার রাঙা ঠাকুমা ন্যাড়া পোড়াকে ‘বুড়ির ঘর’ পোড়ানো বলত। সে সব আজকে স্মৃতির মনের বনে ঘুরপাক খায়। বাংলার বাইরে এই রীতি ‘হোলিকা দহন’। যদিও রীতি পালনের ধরনে, স্থানভেদে এই হোলিকা দহনের নানা পার্থক্য। তবে এই রীতি মূলত উত্তর ও দক্ষিণ ভারত, নেপাল আর পশ্চিম বাংলার বাইরেই বেশি প্রচলিত।
বাঙালির ন্যাড়া পোড়ার সঙ্গে হোলিকা দহনের কিছুটা হলেও পার্থক্য রয়েছে। হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী, হোলিকা দহনের সঠিক সময় পূর্ণিমার রাত। হোলির আগের দিন পূর্ণিমার রাতে বনফায়ার করে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করা। কাঠের মতো দাহ্য বস্তু এবং পুজোর সমস্ত উপকরণের সাহায্যে কোনও মন্দিরের কাছে ফাঁকা জায়গায় যজ্ঞ করাই হল হোলিকা দহন। একটি বিশেষ সময়ে সমস্ত রীতি-নীতি মেনে ভগবানের কাছে এই আহুতি দিয়ে আগুনকে পরিক্রমা করে পুজো সম্পন্ন করা হয়।
রাজস্থানের উদয়পুরে এই হোলিকা দহন উৎসবটি সাড়ম্বরে পালিত হয়। উদয়পুরের সিটি প্যালেসে পূর্ণিমার রাতে স্থানীয় মানুষ একত্রে পৌরাণিক কাহিনিকে স্মরণে রেখেই হোলিকা দহন করে। প্রাচীন প্রথা অনুসারেই উদয়পুরের রাজপরিবার তাদের মেওয়ার বংশের গৌরব অক্ষুণ্ণতা রক্ষার জন্য উৎসবে মিলিত হয়। এই দিনে রাজ পরিবারের সমস্ত সদস্য রাজস্থানের নির্দিষ্ট পোশাক পরিধান করে ঘোড়ার পিঠে চেপে গানবাজনা সহকারে রাজবাড়ি থেকে মানেক চৌক পর্যন্ত একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করে।
………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………….
বাংলায় ন্যাড়া পোড়া যদিও হয় দোলযাত্রার আগের দিন। ঋতুরাজ বসন্তের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের সর্বত্রই রঙের খেলায় মেতে ওঠে সবাই। প্রকৃতপক্ষে দোলের সূচনা হয় আগের দিন রাতের বনফায়ার থেকেই। বাঙালি হিসেবে এই বনফায়ার বেশ আকর্ষণের। আমাদের ছোটবেলার সে অভিজ্ঞতা বেশ অন্য রকমের। সমবয়সি কিছু বন্ধুবান্ধব মিলে দোলের আগের দিনে স্কুল ছুটির পরে বেড়িয়ে কিছু শুকনো কাঠ, পাতা, বিচুলি সংগ্রহ করে যে কোনও প্রকাণ্ড আকার তৈরি করে বনফায়ার করা হত! ‘ন্যাড়া পোড়া’-র উত্তাপ ছড়িয়ে দিত দোলযাত্রার আগমনী সুর।
সন্দীপদা জিজ্ঞেস করলেন, ‘How was the experience?’ পরিষ্কার উত্তর দিলেন, ‘I loved the chaos of the city.’ আসলেই ক্যাওসের মধ্য থেকেই তো বিভিন্ন দৃশ্যের জন্ম, মৃত্যু ও পুনর্নবীকরণ ঘটে– আমরা হয়তো বা অনেক সময় তা দেখেও দেখি না। সেখানেই তো সত্যজিৎ বা উইমের মতো দৃশ্যনির্মাণকারীর দক্ষতা, অনন্যতা ও বিভিন্নতা। তাঁদের চোখ খুঁজে পায় এমন জিনিস যা আমাদের নতুন দৃশ্য ও দৃশ্যমানতা সম্বন্ধে ভাবায়।
সবার থেকে বেশি আক্রমণ নেমে এসেছে কাশ্মীরের সাংবাদিকদের ওপর। একাধিক সংবাদপত্রের সম্পাদক, সাংবাদিকদের শুধু জেলবন্দিই করা হয়নি, ইন্টারনেট লকডাউন করে প্রায় উপত্যকাকেই একটা জেলে পরিণত করা হয়েছে, যেখানে কোনও রকম সাংবাদিকতাই করাই একসময় অসম্ভব হয়ে উঠেছিল।