বাণিজ্যিক প্রয়াসে চণ্ডীবাবুর কর্মকাণ্ড চোখে পড়েছে সিনেমা বা ফিল্মের টাইটেল কার্ডে, ওঁর কার্টুন ও লিখনশৈলীর আকর্ষণ প্রশ্নাতীত। বেশিরভাগ হাসির ছবিতে ওঁর করা টাইটেল কার্ডগুলি পর্দায় আসার সঙ্গে সঙ্গে দর্শকের মুখে মৃদু হাসি এসে যায়, তাঁরা বুঝতে পারেন ছবিতে কী কীর্তি তাঁরা দেখতে চলেছেন। ‘ধন্যি মেয়ে’, ‘চারমূর্তি’, ‘পাকা দেখা’, ‘মৌচাক’, ‘ফুলুঠাকুমা’ ইত্যাদি ছায়াছবির টাইটেল কার্ড তাঁর কার্টুনে অলংকৃত। আজ চণ্ডী লাহিড়ীর জন্মদিনে বিশেষ লেখা।
কার্টুন ও চণ্ডী লাহিড়ী– এই দু’টি শব্দ সমার্থক। কার্টুন আঁকার বাইরে তাঁর পারদর্শিতা প্রসারিত হয়েছিল ব্যঙ্গ রচনা, রম্য রচনা, গবেষণাধর্মী রচনা, শিশুসাহিত্য– নানা পরিসরে। কার্টুনিস্টকে হতে হয় নিরপেক্ষ, প্রতিবাদী ও বাস্তববাদী। চণ্ডী লাহিড়ীর কার্টুনে এই সবক’টি সত্তার প্রতিফলন ঘটেছে। বিশেষত খুদে আকারের পকেট-কার্টুনে চণ্ডীবাবুর সাবলীলতা অস্বীকার করা যাবে না। ‘তির্যক’-এর ছোট্ট জানালায় চোখ রাখলেই দেখা যেত সমাজ ও রাজনীতির অবক্ষয়।
কার্টুনের ব্যবহার আজ আর খবরের কাগজ বা পত্রিকার পাতায় সীমাবদ্ধ নেই। নানা ক্ষেত্রে বিশেষ করে বিজ্ঞাপন ও প্রচারশিল্পে তা আজ বহুল ব্যবহৃত। আর ঠিক এই ক্ষেত্রেই চণ্ডীবাবু একটি সুপরিচিত নাম। বিজ্ঞাপন শুধুমাত্র পণ্যের গুণাগুণ প্রচারের জন্য ব্যবহৃত হয় না, সরকারি নানা বিজ্ঞপ্তি, যা জনসাধারণের অবগতির জন্য বা সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োগ করা হয়। সাইবার অপরাধের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে সজাগ ও সতর্ক হতে যেমন প্রশাসন ব্যাপক প্রচার চালাচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ক্রেতা সুরক্ষা দপ্তরের উদ্ভব হয়েছে নানা ক্ষেত্রে– ক্রেতারা যেভাবে পণ্য কিনে প্রতারিত হচ্ছে তার বিরুদ্ধে তাদের সতর্ক করতে। বিক্রেতা জিনিসটি ক্রেতাকে বিক্রয় করল, ক্রেতা তা ব্যবহার করতে গিয়ে দেখল প্যাকেটের ভিতর থেকে নষ্ট হয়ে যাওয়া মশলা বা অন্য কিছু বের হচ্ছে। মেয়াদ উত্তীর্ণ ঔষধ বা বেবি ফুড, প্যাকেট-জাত শুকনো খাবার শরীরের পক্ষে বিপদজ্জনক, তাও অনেকে ঠিকমতো জানে না। ডাক্তার দেখাতে গেছে, ডাক্তারের কর্তব্য তাঁর দক্ষিণা চেম্বারের বাইরে টাঙিয়ে রাখা– এইসব নানা বিষয়ে ক্রেতা সুরক্ষা দপ্তর দায়িত্ব দেন চণ্ডী লাহিড়ীকে, আর এইসব প্রত্যেকটি বিষয়ে সহজবোধ্য কার্টুনে তিনি সাধারণ ক্রেতাদের সজাগ করে দিয়েছেন। স্বতঃস্ফূর্ত জলরঙে আঁকা এইসব কার্টুন দেখলে শিক্ষিত বা স্বল্প শিক্ষিত দর্শকও বুঝতে পারবে, আগত সমস্যাগুলিকে। খাদ্য দূষণ বা ভেজাল, বেসরকারি হাসপাতালের রোগীর অজান্তে অনাবশ্যক ঔষধের চড়া বিল করা থেকে শুরু করে আগাম টাকা নিয়ে অসাধু প্রমোটারের ক্রেতাকে ফ্ল্যাট হস্তান্তরে ক্রমাগত বিলম্ব করা– সব বিষয়েই খণ্ড খণ্ড কৌতুকচিত্রে সাধারণ মানুষকে সাবধান করে দেওয়ার মোক্ষম মাধ্যম চণ্ডীবাবুর কার্টুনগুলি ব্যাপকভাবে কাজে লাগায় ক্রেতা সুরক্ষা দপ্তর।
পণ্যের প্রচারে যখন কৌতুকচিত্র আঁকছেন চণ্ডীবাবু, তখন তাঁর উদ্দেশ্য অন্য। হাস্যরসের মাধ্যমে সাধারণ ক্রেতাদের তিনি সেই পণ্যের গুণাগুণ জানিয়ে দিচ্ছেন।
তার অন্যতম উদাহরণ গাঙ্গুরামের মিষ্টান্ন দ্রব্য। সৌভাগ্যের বিষয়, উনি গাঙ্গুরামের জন্য যে সচিত্র ক্যাটালগ বানিয়ে ছিলেন, তা দেখেছি, কিন্তু আমার সংগ্রহে নেই। রসগোল্লা, সন্দেশ, দই প্রভৃতি উপকরণকে হাসির ছবিতে এমনভাবে চিত্রায়িত করেছিলেন, তা ওইসব খাবারের মতোই উপাদেয়। খুদে কার্টুনের মতো খুদে বিজ্ঞাপনে ওঁর মুনশিয়ানা দেখার মতো। হাওয়াই চপ্পল, গ্রহরত্ন প্রসাধনীর বিজ্ঞাপনে তার প্রমাণ মিলেছে।
বাণিজ্যিক প্রয়াসে চণ্ডীবাবুর আর এক কর্মকাণ্ড চোখে পড়েছে সিনেমা বা ফিল্মের টাইটেল কার্ডে, ওঁর কার্টুন ও লিখনশৈলীর আকর্ষণ প্রশ্নাতীত। বেশিরভাগ হাসির ছবিতে ওঁর করা টাইটেল কার্ডগুলি পর্দায় আসার সঙ্গে সঙ্গে দর্শকের মুখে মৃদু হাসি এসে যায়, তাঁরা বুঝতে পারেন ছবিতে কী কীর্তি তাঁরা দেখতে চলেছেন। ‘ধন্যি মেয়ে’, ‘চারমূর্তি’, ‘পাকা দেখা’, ‘মৌচাক’, ‘ফুলুঠাকুমা’ ইত্যাদি ছায়াছবির টাইটেল কার্ড তাঁর কার্টুনে অলংকৃত।
বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের লেখনিতে: চণ্ডী লাহিড়ী আমার কাছে এক পূর্বাপর বিমোহিত করা আকর্ষণের মানুষ… ১৯৭০ সালে ‘ধন্যি মেয়ে’ নামে একটা হাসির ছবি করতে গিয়ে ঠিক করলাম, এর টাইটেল চণ্ডী লাহিড়ীকে দিয়ে করাব। যাই হোক, ঠিকানা মতো বাড়িতে গিয়ে ওঁকে দেখে প্রথমে একটু চমকে গেলাম। একটা হাত কাটা। পরে ঘনিষ্টতার হওয়ার পর মনে মনে উপলব্ধি করলাম– উনি সব্যসাচীর চেয়ে বড়। সেদিন আমার মুখে টাইটেলের কথা শুনে উনি হাসলেন। বললেন, ‘আমি একবার আপনার ছবিটা দেখব।
তারপর আমাদের টালিগঞ্জের নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওর প্রোজেকশন রুমে বসে তিনি ছবিটা দেখলেন। হেসে বললেন, ভালো ছবি হয়েছে। তারপর জানতে চাইলেন আমার কোনও সাজেশন আছে কি না। আমি বললাম না। আপনার যা আইডিয়া আসে সেইভাবে করুন। চণ্ডীবাবু একটু ভেবে বললেন, ‘আপনার এই ছবির স্টিল অ্যালবাম থাকলে দেবেন।’ বললাম– কাল পাঠিয়ে দেব। তারপর সংকোচের সঙ্গে বলি– আপনাকে কত দিতে হবে। চণ্ডীবাবু বললেন, যে পরে হবে– আগে আপনাকে খুশি করি… পনেরো দিন পর ওঁর বাড়ি গেলাম। দেখলাম তখনও সব টাইটেল তৈরি হয়নি, কিন্তু যেগুলো হয়েছে যেগুলো দেখে আমি মুগ্ধ। উনি বললেন, প্রথমে টাইটেল কার্ডটা অ্যানিমেশনের মতো মুভি হবে, ওটা টাইটেল টেক করার সময় ক্যামেরার সামনে ফ্রেম টু ফ্রেমে এঁকে করব। দেখলাম মুভি ক্যামেরা সম্বন্ধে ওঁর যথেষ্ট জ্ঞান আছে। তারপর যথাসময়ে টাইটেল তোলা হল। যাঁরা ‘ধন্যি মেয়ে’ ছবিটা দেখেছেন– তাঁরা চণ্ডী লাহিড়ীর আঁকা ও লেখা টাইটেল কার্ড দেখে বলেছেন– অপূর্ব। তারপর আমি যতগুলো হাসির ছবি করেছি– ‘মৌচাক’, ‘পাকা দেখা’, ‘হুলস্থুল’, সব ছবির টাইটেল উনি করেছেন।
……………………………………..
চণ্ডী লাহিড়ীকে নিয়ে সমীর মণ্ডলের লেখা। যে পারে সে এমনি পারে শুকনো ডালে ফুল ফোটাতে, বলতেন চণ্ডী লাহিড়ী
……………………………………..
অ্যানিমেশনের ওপর এই স্বোপার্জিত জ্ঞান থেকে তিনি অনুপ্রেরণা পান দিল্লি দূরদর্শন প্রযোজিত তিনটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ফিল্ম নির্মাণ করতে। অত্যাধুনিক যন্ত্রাংশের সাহায্য ছাড়াই তিনি তৈরি করেন: Under the blue Moon, The biggest egg, Be a mouse again. এই ফিল্মগুলো নিছক ছোটদের বিনোদনের জন্য নয়, এগুলোর মধ্য দিয়ে তিনি বন্যপ্রাণ এবং ক্ষুদ্র প্রাণীজগৎকে বাঁচিয়ে রাখার বার্তা দিয়েছেন।
কলকাতা দূরদর্শনের নিয়মিত অনুষ্ঠানে চণ্ডী লাহিড়ীর উদ্ভাবন ও জনসংযোগের নতুন কৃতিত্ব দেখা গেল ছোটদের জন্য ‘চিচিং ফাঁক’ অনুষ্ঠানে তিনি সহজে কার্টুন শিক্ষার পাঠ দিয়েছেন। রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের টেলিসিরিয়াল ‘অবিরত চেনামুখ’ ও মেঘনাদ ভট্টাচার্যের নাটক ‘বধূতন্ত্র’-তে ব্যবহৃত হয়েছে তাঁর অনুনকরণীয় অঙ্কনশৈলী। নাট্যব্যক্তিত্ব শম্ভু মিত্র ও রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গ সখ্য ছিল। বহু গ্রুপ থিয়েটার তাঁর দাক্ষিণ্য পেয়েছে, লোগো ও কার্টুনে তাঁদের প্রচারপত্র সাজিয়ে দিয়েছিলেন। নান্দীকার নাট্যমেলার সময় রোজ যে প্রচার বুলেটিন বের করত, তাতে অনিবার্য ছিল চণ্ডীবাবুর কার্টুনের উপস্থিতি।
‘ছায়া স্টোর্স’ ও ‘এম.পি জুয়েলার্স’-এর বিখ্যাত লোগো আজও দেখা যায়। শহরের একটি হাসপাতালে ক্যানসার বিভাগ শিশুদের জন্য ‘কেমোথেরাপি’ ওয়ার্ডে টাঙিয়ে রেখেছিল মন ভালো করা চণ্ডীর কার্টুন, থেরাপির অংশ হিসাবে।
কার্টুনকে শুধু পণ্য প্রচারের বিজ্ঞাপনে নয়, প্রচারের যে নানাদিক আছে, বিশেষত জনসংযোগের মাধ্যমে কাজে লাগানোর বিচক্ষণতার পরিচয় রেখেছেন চণ্ডীবাবু– তাঁর নিজের ভাষাতেই বিদ্যা হিসাবে ‘কার্টুন হল সর্বগ্রাসী’। শিশুশিক্ষা থেকে জনবিজ্ঞান, ইতিহাসের চর্চা থেকে রঙ্গব্যঙ্গচর্চা সবেতেই তাই চণ্ডী লাহিড়ীর সুদক্ষ হাতের তুলির আঁচড় চোখে পড়েছে।
আক্ষেপ একটাই, তথ্যচিত্র নির্মাতা হিসাবে তাঁকে পেলে আমাদের জানার জগৎ আরও সমৃদ্ধ হত, ‘তারা বাংলা’ চ্যানেলের হয়ে এককালের সুপ্রসিদ্ধ বাঙালি কার্টুশিল্পী ‘পিসিয়েল বা কাফি খাঁ’-কে নিয়ে ক্ষুদ্র তথ্যচিত্র ‘এক যে ছিল কার্টুনিস্ট’ নির্মাণে তাঁর ভূমিকা দেখতে পেয়েছিলাম, সেটাই প্রথম ও শেষ।