লেখক-প্রকাশক-সম্পাদক মায় প্রুফ রিডার– কারুক্কে পরোয়া করে না ছাপাখানার ভূত! লিটল ম্যাগাজিন বা বইয়ের কড়া সম্পাদক যদিও সে ভূতকে প্রায়শই সম্মার্জনী দিয়ে বিদেয় দেন, তবুও সেই জাঁদরেল সম্পাদকরা বোধহয় হাতে গোনাই। ফলে ভূতের কেত্তন চলতেই থাকে। দে’জ পাবলিশিংয়ের শুভঙ্কর দে, সকলের কাছে পরিচিত ‘অপু’ নামেই, লিখলেন তাঁর ছাপাখানার ভূত দেখার অভিজ্ঞতা।
আজ ভূতচতুর্দশী। ভেবেছিলাম, আমার গ্রামে দেখা ভূতের গল্প করব। শীতকালে কুয়াশায় ঘেরা ধানজমির আলের ওপর দিয়ে কে যেন সাদা কাপড়ে ঘোমটা দিয়ে হেঁটে যায় রাতের বেলায়। দাসদের বাড়ির বাঁশবন থেকে শেয়ালের ডাক আর হওয়ায় বাঁশের শব্দে মনে হয়, ‘গুপী গাইন ও বাঘা বাইন’ সিনেমার ভূতেরা স্বয়ং এসে পড়েছেন। এত কিছু যখন ভাবছি, তখন ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ হয়ে সম্বিত আমার দপ্তরে উপস্থিত হবে, এটা ভাবিনি। উপস্থিত যখন হয়েই পড়েছে, বেশ তো চা খেয়ে গল্প করব। সম্বিতের প্রথম কথাই ছিল, ‘সামনেই তো ভূতচতুর্দশী’। শুনেই ভেবেছিলাম, ভূতের তো অনেক বই আছে তা নিয়ে কিছু করা যায় কি না, ভাবা যেতে পারে।
দূর ভূতের বই কোথায়, এ তো বইয়ে ভূত খুঁজে লেখার কথা বলছে। ছাপাখানার ভূত! এক সময় মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের কাছে রাইটার্সে ভূতের গল্প শুনেছিলাম। নলিনী বেরার কাছে কত রকমের ভূত আছে, তারা কে কেমন, কী কাজ করে তার গল্প শুনেছিলাম। ‘ছাপাখানার ভূত’ এই নামটা প্রথম শুনি বাবার কাছে। ছোটবেলায় ভাবতাম ছাপাখানায় গেলেই ভূতে ধরবে। ছোট্ট ঘরে আধোআলো বাল্বের আলোয় হ্যান্ড কম্পোজের কাজ হচ্ছে। দেখলে ভুতুড়ে বাড়ি বলে মনে হতে পারে! লেটার প্রেসে যখন ছাপার কাজ চলত তখন বেশ জোরে আওয়াজ হত। একটা অদ্ভুত ভাইব্রেশন হত।
ছাপাখানার ভূতের জন্ম কথা
ছাপাখানায় ভূতের জন্ম লেটার প্রেসের সময় শুরু। সিসের টাইপগুলো জুড়ে জুড়ে এক একটা পাতা তৈরি করে তা দড়ি দিয়ে বেঁধে লোহার কেসে সেট করতে হত। একসঙ্গে যখন ১৬ পাতা ছাপা হত, তখন অনেক সময় দড়ি আলগা হয়ে টাইপ খসে পড়ত। মেশিন ম্যান সেই টাইপ না দেখেই অনেক সময় অন্য জায়গায় জুড়ে দিতেন। লেখক, প্রুফ রিডার প্রত্যেকেরই নাম পাল্টে যায়। লেখকের নামের বানান পাল্টে যায়। কভারে এক নাম, বইয়ের ভেতর আর এক লেখা। প্রকাশকের নাম পড়া যায় না। চেনা লেখকের পরিচিতিতে অন্য নাম। এত রকমের ভৌতিক ব্যাপার অনেকটা যেন সত্যজিৎ রায়ের দেখানো ভূতগুলোর মতো।
ভূতের গল্প
এক।
লেখক তখন জীবিত। ২০০০ সালে কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘কবিতা সমগ্র’ চতুর্থ খণ্ড প্রকাশিত হবে নন্দন চত্বরে ‘কবিতা উৎসব’-এ। আমি তখন একটি কবিতার বইয়ের স্টল দিতাম। সমস্ত কবিতার বই এই স্টলে থাকত। বিকেল বেলায় মঞ্চে নীরেন জেঠুর ‘কবিতা সমগ্র চতুর্থ খণ্ড’-র প্রকাশ অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের আগে ২০ কপি বই আমার স্টলে পৌঁছে যায়। উদ্বোধনের পরে নীরেন জেঠু স্টলে আসেন। আমার কাঁধের ওপর হালকা ভর দিয়ে নিজের প্রকাশিত বইটি টেবিলের ওপর রেখে দেখতে থাকেন। হঠাৎ বলে ওঠেন,
–দেখেছো বাবা, ওঁরা না আমায় মেরে ফেলেছে।
–মানে? কী হয়েছে জেঠু?
–এই দেখো লেখক পরিচিতি।
তৃতীয় প্রচ্ছদে লেখক পরিচিতিতে সুকুমার সেনের ছবি ও তাঁর পরিচিতি ছাপা হয়েছে। তখন প্রচ্ছদ ব্লকে ছাপা হত। আর প্রচ্ছদের ব্লক হত টুকরো টুকরো। ফ্রন্ট কভার, সেকেন্ড কভার, থার্ড কভার আর ব্যাক। ফ্রন্ট কভারের সঙ্গে থাকে বইয়ের স্পাইন। নীরেন জেঠুর এই বইয়ের কভার ছাপার সময় কোনওভাবে চতুর্থ প্রচ্ছদের ব্লক পাল্টে যায়।
দুই।
শঙ্খ ঘোষের বাড়িতে গেছি। ২০২০ সালের কোনও একটা সময়। বসার জায়গায় কথা বলছিলাম। কথার শেষে উঠব, তখন বললেন, ‘একবার এসো এই ঘরে’। তাঁর পড়ার ঘরে। একটি বইয়ের মাঝে কিছু ছবির পাতা।একটি ছবি দেখিয়ে বলেন, ‘চিনতে পারছ’? বইটি ছিল মানস চক্রবর্তী ও দেবেশ রায় সম্পাদিত শঙ্খ ঘোষের ওপরে আলোচনা গ্রন্থ ‘শঙ্খধ্বনি’। ছবিটি একজন কমবয়সি যুবকের। নীচে লেখা ‘কম বয়সে শঙ্খ ঘোষ’। আর ছবিতে যে যুবক ছিলেন, তিনি হলেন কম বয়সি সুভাষ মুখোপাধ্যায়।
তিন।
বেশ অনেক বছর আগে শঙ্খ জেঠুর বাড়ি গেছি। একটি বই তাক থেকে নামিয়ে আনলেন। বইটি ছিল ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত মহাকোষ’। বইয়ের ভেতরে একটি পাতা বের করে দেখালেন একই নম্বরের পাতা ডানদিকে ও বামদিকের পাতা। এটা কোনওভাবেই সম্ভব নয়। তবুও এটা হয়েছে। শঙ্খ জেঠুকে বললাম, এটা আমায় দিন আমি নতুন আর একটা নিয়ে আসব। আমায় তো বইটা দিলেনই না উল্টে আর একটা বই কিনেছিলেন। বলেছিলেন, ‘এটা আমার সংগ্রহে থাকবে’।
চার।
নলিনী বেরার ‘সেরা পঞ্চাশটি গল্প’ বইটি প্রকাশিত হয়েছে। কিছু কপি বিক্রিও হয়েছে। নলিনী কাকু এসেছেন দে’জ এর দপ্তরে বইটি নিতে। বইটি হাতে নিয়ে হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘এ মা, আমার নাম তো এখানে পাল্টে গেছে। তখন দেখা গেল কভারে ‘নলিনি’ হয়ে আছে।
পাঁচ।
কিছুদিন আগে মৃদুল দাশগুপ্তের একটি বই প্রকাশিত হয়। বইটি প্রকাশের আগে লেখক সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচ্ছদটি পোস্ট করেন। বইটি ছাপা হয়, প্রচ্ছদও ছাপা হয়। বইটি যখন প্রকাশিত হয়ে লেখকের হাতে আসে তখন লেখক বলেন, ‘এটা কী করে হলো বইয়ের নাম তো ভুল হয়ে গেছে!’ ছাপা বইয়ের নাম ‘ঘুরে ঘুরে উড়ে উড়ে’, প্রচ্ছদে ছাপা হয় ‘উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে’। সোশ্যাল মিডিয়াতেও পোস্ট হয়েছিল ‘উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে’।
ছয়।
কিছুদিন আগে দে’জ এর কাউন্টারে আমি আর শ্রীকুমার নতুন কিছু বই দেখছিলাম। হঠাৎ শ্রীকুমার একটা অনুবাদের বই বের করে আমায় বলল এই বইয়ের প্রকাশকের নাম উচ্চারণ করো দেখি। অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও উচ্চারণ করতে পারিনি। বইটি সুমনা চক্রবর্তীর অনুবাদে ‘ইকিগাই’। প্রকাশক ডায়মণ্ড বুকস হওয়ার কথা। হয়ে আছে ‘ডায়মণ্ড ন্ত্তুক্স’। ছাপাখানার ভূত কম্পিউটারকেও ছেড়ে যেতে পারেনি এখনও। দে’জ প্রকাশিত মিলন দত্তের ‘ইসলামিক শব্দকোষ’ ছাপার পরে দেখা যায় বেশ কিছু পাতায় ইংরেজি শব্দগুলো হিব্রু হয়ে গেছে। দে’জ প্রকাশিত সরলাদেবী চৌধুরানীর নির্বাচিত প্রবন্ধ সংকলন বইয়ে লেখকের নাম যেভাবে ছাপা হয়, তার উচ্চারণ আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। সরলাদেবী চৈ, এর পরে আ-কার যুক্ত হয়ে যায়। লেটার প্রেসের যুগে ‘ন্ড’ ছাপা যেত না। প্রচ্ছদে ইন্ডিয়ান থাকলেও বইয়ের মধ্যে সব জায়গায় ছাপা হত ‘ইণ্ডিয়ান’। সে অদ্ভুত দেখতে লাগত!
সাত।
সম্পাদক, লেখক, প্রচ্ছদশিল্পী অজয় গুপ্তের সঙ্গে ছাপাখানার ভূত নিয়ে নানান সময় বেশ কিছু মজার গল্প শুনেছিলাম। অজয় জেঠু একসময় কম্যুনিস্ট ম্যানিফেস্টো অনুবাদ করেছিলেন। একদিন অজয় জেঠু কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাথ দিয়ে হাঁটছেন, কিছু পুরোনো বইয়ের সারিতে চোখ আটকে যায়। পাতলা কাগজে ছাপা ‘কম্যুনিস্ট ম্যানিকেষ্ট’। ‘উল্টোরথ’ পত্রিকা আয়োজিত উপন্যাস প্রতিযোগিতায় মতি নন্দী, পূর্ণেন্দু পত্রী এবং অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় যথাক্রমে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পুরস্কার পান। পূর্ণেন্দু পত্রীর উপন্যাসের নাম ছিল ‘দাঁড়ের ময়না’। ছাপাখানার ভূতের কারসাজিতে বিজ্ঞাপনে ছাপা হল পূর্ণেন্দু পত্রীর ‘দাঁতের ময়লা’।
‘দৈনিক বসুমতী’-র পত্রিকার লাগোয়া হাড়কাটা গলির রেড লাইট এরিয়ায় দাঙ্গা লেগে গেছে। পত্রিকার একজন রিপোর্টার ক্যামেরাম্যান সঙ্গে নিয়ে ছুটলেন। গিয়ে দেখেন তুমুল কাণ্ড, কে কাকে মারছে ঠিক নেই! তাদের দিকেও একদল ধেয়ে এল। রিপোর্টার চেঁচিয়ে বললেন, ‘এ কী আমাদের মারছেন কেন? আমরা তো ‘প্রস’।’ আসলে তিনি বলেছিলেন ‘প্রেস’, কিন্তু ছাপাখানার ভূত ‘এ’কারটা চুরি করে নিয়েছিল খবরটা ছাপার সময়।
‘দৈনিক বসুমতী’ পত্রিকায় প্রথম পাতায় বক্সের মধ্যে ছাপা হয়েছে, ‘জলে ডুবিয়া বকের মৃত্যু’। ছাপাখানার ভূত ‘যু’ নিয়ে ভেগেছে।
ছাপাখানার ভূত কখন কী করে দেয়, বলা খুব মুশকিল! তবে এই ভুল তাড়াতেও ওঝার সংখ্যাও কম নয়। বাবার কাছে বুদ্ধদেব বসুর গল্প শুনেছি। নিজে দেখেছি স্বপন মজুমদার, অজয় গুপ্ত, পুলক চন্দ, শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। এখনও ভূত তাড়াতে ব্যস্ত শ্রীকুমার, পৃথ্বী, অভিরূপরা।
শেষ করি, একটা মজার ঘটনা বলে। আমার গ্রামের কাছের যে শহর রামনগর সেখানে একটা পেটাই পরোটার দোকান আছে। পেটাই পরোটা সঙ্গে কুমড়োর ছক্কা খাচ্ছি। সামনে একটা দেওয়াল ক্যালেন্ডার টাঙানো। ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ খেতে ভুলে গিয়েছিলাম। ক্যালেন্ডারে বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা ‘লঙ্কার বিচি’। না, ছাপাখানার ভূত এই কাণ্ড করেনি। কেউ বদমাইশি করে আগে ‘অ’ ও শেষে ‘ত্রা’ কেটে খেয়ে নিয়েছে।