‘সূর্যোদয়’ ছবিটাই পড়ল সবচেয়ে বেশি ভয়ংকর সমালোচনার মুখে। বলা হল ছবিটি অসমাপ্ত, অপেশাদার কাজ ও প্রকৃতির অক্ষম রূপান্তর। লেখা হল, ‘নোংরা ক্যানভাসের তৃতীয়-চতুর্থাংশ ঢেকে দাও কালো আর সাদায়, বাকিটায় হলুদ ঘষো, তার গায়ে গায়ে লাল আর নীল রঙের ছিটে ছড়িয়ে দাও, তাহলে তুমি পেয়ে যাবে বসন্তের নির্ঘোষ আর যিনি আঁকলেন তিনি উদ্বাহু হয়ে নাচবেন’! ছবিটার ‘ইম্প্রেশন’ নামটাকে ব্যঙ্গ করা হল আর পুরো প্রদর্শনীর নাম দেওয়া হল ‘ইম্প্রেশনিস্টদের ছবি’।
একটি সূর্যোদয়ের দৃশ্য! আবছা, ধোঁয়াটে, ব্রাশের হালকা ছাড়া ছাড়া আঁচড়ে আঁকা অপার্থিব এক পরিবেশ। শিল্পী এই ছবির নাম রেখেছেন ‘ইম্প্রেশন, সানরাইজ’। ক্যানভাসে এই প্রথম আঁকা হল ঠিক ‘ছবি’ নয়, ‘আলো, রং আর বায়ুমণ্ডলের এক কবিতা! ল্যান্ডস্কেপ পেন্টিংয়ে এতদিন প্রকৃতিকে অবিকল কপি করা হত ফোটোগ্রাফির মতো। এই প্রথম প্রকৃতির দৃশ্যের অনুভূতি আর ঘ্রাণ মেখে নির্মিত হল এই ছবি। তাই নাম রাখা হল, ‘ইম্প্রেশন’। ১৮৭৪ সালে প্যারিসের এক চিত্রপ্রদর্শনীতে এই গ্যালারির দেওয়ালে ছবি ঝোলালেন শিল্পী ক্লদ মোনে।
এই প্রদর্শনীতে নামী সব শিল্পী ছিলেন, যেমন এডগার দেগা, ক্যামিল পিসারো, অগাস্তে রেনোয়ার প্রমুখ। কিন্তু এই ‘সূর্যোদয়’ ছবিটাই পড়ল সবচেয়ে বেশি ভয়ংকর সমালোচনার মুখে। বলা হল ছবিটি অসমাপ্ত, অপেশাদার কাজ ও প্রকৃতির অক্ষম রূপান্তর। লেখা হল, ‘নোংরা ক্যানভাসের তৃতীয়-চতুর্থাংশ ঢেকে দাও কালো আর সাদায়, বাকিটায় হলুদ ঘষো, তার গায়ে গায়ে লাল আর নীল রঙের ছিটে ছড়িয়ে দাও, তাহলে তুমি পেয়ে যাবে বসন্তের নির্ঘোষ আর যিনি আঁকলেন তিনি উদ্বাহু হয়ে নাচবেন’! ছবিটার ‘ইম্প্রেশন’ নামটাকে ব্যঙ্গ করা হল আর পুরো প্রদর্শনীর নাম দেওয়া হল ‘ইম্প্রেশনিস্টদের ছবি’। এ যেন সেই জীবনানন্দের কবিতা যেমন প্রথম যুগে ‘শনিবারের চিঠি’-র তীব্র আক্রমণের হাতে পড়ত অহরহ, অনেকটা সেই রকম।
আরও পড়ুন: জল ও জমির আলপথ দেখে রফিকুন নবী শিখেছিলেন রেখা ও রঙের ব্যবহার
অথচ এই আক্রমণই যেন শাপে বর হল ক্লদ মোনের চিত্রজীবনে। আর সেই সঙ্গে শিল্পকলার ইতিহাসে এক যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটে গেল। এই প্রথম একজন শিল্পী ছবি আঁকলেন তুলিকে ব্যক্তিগত রঙের প্যালেট ডুবিয়ে। এর থেকেই প্রাণিত হয়ে পরবর্তী দিনগুলোয় ল্যান্ডস্কেপের ছবিতে নিজস্ব স্বর উচ্চারণ করলেন ডাচ শিল্পী ভ্যান গঘ, বাংলার শিল্পী গোপাল ঘোষ, ইংল্যান্ডের শিল্পী ডেভিড হকনি প্রমুখ।
আরও পড়ুন: আলো ক্রমে আসিতেছে: কমলকুমারের কাঠখোদাই ছবি
এই প্রথম আলো আর রঙকে এত মূল্য দেওয়া হল কোনও ছবিতে। সূর্যের রশ্মির তির্যক আর ভঙ্গুর রেখা এবং তার ঢেউ-খেলানো প্রতিফলন সমুদ্রের বুকে যেন এক বিমূর্ত ভাব প্রকাশ করল এই ছবিতে। ছবিতে বিমূর্ততার সেই বোধহয় প্রথম শুরু। রঙকে প্যালেটে মিশিয়ে ব্যবহার করা হল না এখানে। প্রতিপূরক আর প্রতিপূরকের কাছাকাছি রং– যেমন কমলা ও নীলকে পাশাপাশি রাখা হল, যা দর্শকের রেটিনায় মিশে এক হয়ে মিশে যাবে। এইভাবে পৃথিবীতে আধুনিক কোনও শিল্প আন্দোলন জন্ম নিল প্রথম, যার নাম হয়ে গেল ‘ইম্প্রেশনিজম’। এই ছবিটি শুধু শিল্পের নবজন্ম ঘটল তা নয়, ফরাসি দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক পুনর্জন্মেরও যেন দ্যোতনা এই ছবিতে চিহ্নিত হয়ে আছে, কারণ তার আগেই ১৮৭০-’৭৩ সালে প্রুশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে হেরে যায় ফ্রান্স।
আরও পড়ুন: বিশ্ব শিশু দিবসের বক্তৃতা খেয়ে পেট ফুলে ওঠে পথশিশুদের
ক্লদ মোনের শৈশব কাটে সমুদ্রের ধারে ধারে, তার বাবার সঙ্গে ব্যবসার কারণে ঘুরে। তিনি কোনও বিশেষ শিল্প ইন্সটিটিউশনে ছবি আঁকা শেখেননি। তিনি বিশিষ্ট শিল্পী ইউজিন বুডিনের সংস্পর্শে এসে প্রথম খোলা প্রান্তরে ছবি আঁকার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ হন। একবার তিনি আলজেরিয়ায় যান, যেখানে বিখ্যাত শিল্পী ইউজিন দেলাক্রোয়া-র ছবির রঙের ব্যবহার তাঁকে বিমুগ্ধ করে।
ক্লদ মোনেই পৃথিবীর প্রথম শিল্পী যিনি ছবির সিরিজ আঁকতে শুরু করেন। এর নেপথ্যে তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল একই বস্তু দিনের আলোর আর আবহাওয়ার পরিবর্তনের সঙ্গে কীভাবে দৃশ্যগতভাবে পাল্টে যায়। তারই ধারাবিবরণী তিনি এঁকে রাখেন ছবির সিরিজে সিরিজে। খড়ের গাদা, রেলওয়ের ব্রিজ, পাথরের স্তর প্রভৃতির ছবি তিনি আঁকতে থাকেন পরিবর্তিত আলোয় আর বিভিন্ন আবহাওয়ায়। এইভাবে পুরাণ গাথা, মিথোলজি, বাইবেলের উপাখ্যান ছেড়ে শিল্পকলা নেমে আসে একেবারে ভূমিতে, সাধারণের জীবনযাপনে। এইভাবে শিল্পকলার আধুনিকতার সূত্রপাত ইম্প্রেশনিস্টদের হাত ধরেই।
ক্লোদ মনের সবচেয়ে বিখ্যাত সিরিজ হল ‘ওয়াটার লিলিস’। তিনি প্রায় ২৫০টি ওয়াটার লিলির ছবি আঁকেন, তার মধ্যে বেশ কিছু ছিল অতিকায়, যা প্যারিসের মিউজিয়ামে রাখা আছে। মোনে চাইতেন, তাঁর ছবি দেখতে দেখতে দর্শকরা প্রকৃতির মধ্যে ডুবে যাক। এবং প্রকৃতপক্ষে তাই হয়। এই ওয়াটার লিলিদের আঁকতেও তিনি তাঁর বিখ্যাত ইম্প্রেশনিস্ট স্টাইলই ব্যবহার করেছেন যেমন হালকা পালকের মতো ব্রাশওয়ার্ক, বিচ্ছুরিত আলো আর রং। ১৮৮৬ সাল অবধি তিনি মানুষ বা বাড়িঘর নিয়ে অনেক ছবি এঁকেছেন। কিন্তু তারপর থেকে তিনি প্রকৃতির দিকে ফিরে তাকান পুরোপুরি। তিনি একটা বাড়ি ভাড়া নেন প্যারিস থেকে ৫০ মাইল দূরে। সেখানে একটা বিশাল বাগান তৈরি করেন। বাগান পরিচর্যাও ছিল তাঁর প্রিয় নেশা। এর পাশেই তিনি একটা বিরাট জমি কিনে আর একটি বড় বাগান তৈরি করেন যেটি এখন ‘ওয়াটার লিলি পন্ড’ বলে বিখ্যাত। এই জল লিলিদের মোনের এত ভালোবাসার কারণ তিনি মনে করতেন যে, এই লিলিগুলো যেন বাগান, জল আর আকাশের মধ্যে একটা সেতু। এই লিলিপুকুরগুলোর ওপর দিয়ে ছিল জাপানি বাগানোর মতো ছোট ছোট ব্রিজ। মোনের ছবিতে এই ব্রিজের ছবি পুকুরের জলে প্রতিফলিত হয়। তিনি তাঁর এই শেষের দিকের ছবিতে মানুষের দ্বারা নির্মিত কোনও বস্তুর ছবি রাখতে চাইতেন না। যদিও আয়রনি এই যে এই বাগান, ব্রিজ সবই মনে বা তাঁর বাগানের পরিচারকরা নির্মাণ করেছিল।
১৯১২ সাল থেকে মোনের চোখের দৃষ্টি কমে আসতে থাকে ছানি পড়ার কারণে। চিকিৎকরা তাঁকে অপারেশন করতে বলেন কিন্তু তিনি রাজি হন না। ক্রমেই তাঁর চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হতে থাকে। এ যেন অনেকটা আমাদের দেশের প্রখ্যাত শিল্পী বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের মতো ট্রাজেডি। মনের ছবিতেও এই দৃষ্টিহীনতার প্রভাব পড়তে থাকে, লাল রং তাঁর চোখে ঘোলাটে হয়ে আসে, অন্য সব রং তাঁর কাছে অনুজ্জ্বল লাগে। তাঁর ছবিতে অন্ধকারের প্রাবল্য দেখা দেয়।
মোনের স্ত্রী ক্যামিলের মৃত্যু হয় ক্যানসারে ১৮৭৯-তে। তিনি তাঁর পরলোকগতা স্ত্রীর একটি অয়েল পেন্টিং করেন। পরে তিনি তাঁর এক বন্ধুর কাছে স্বীকার করেন, ‘আমি একদিন দেখলাম আমার প্রিয়ার মৃত মুখের দিকে তাকিয়ে আছি আর তাঁর মুখের সব রং অটোমেটিক রিফ্লেক্সে চিহ্নিত করে যাচ্ছি।’ এইভাবে রঙের বিশ্লেষণ তাঁর কাছে একই সঙ্গে আনন্দের আবার যন্ত্রণার হয়ে ওঠে।