আপাতকঠিন এই মানুষটির মধ্যে লুকিয়ে আছেন অন্য আর একজন দেবীপ্রসাদ। ঠিক এই কারণে তাঁর শিল্পসৃষ্টির ভাষার মধ্যেও রয়েছে বিভিন্নতা। এ পর্যন্ত পড়ে হয়তো অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, এত রকমের ভিন্ন ধারার চর্চা করার ফলে কি শিল্পী হিসেবে দেবীপ্রসাদের নিজস্ব আত্মপরিচয় নির্মাণের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হয়েছিল? এই প্রশ্নের সদুত্তর আমার জানা নেই, তবে এটুকু বলতে পারি দেবীপ্রসাদ যে সময়ের শিল্পী, সেই সময়ের অনেক বড় মাপের শিল্পীর কাজের মধ্যেই এই ধরনের শিল্পভাষার বিভিন্নতা দেখতে পাওয়া যায়।
তাঁর নাম শুনলে প্রথমেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে প্রকাণ্ড, ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ সব মনীষীর মূর্তি। কলকাতা শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় মহাত্মা গান্ধী, স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ প্রমুখ ব্যক্তিত্বের যেসব মূর্তি আমরা ছোটবেলা থেকে দেখে বড় হয়েছি, অনেক পরে জেনেছি– তাদের স্রষ্টা হলেন শিল্পী দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী। আবার আরও কিছুকাল পরে, যখন আর্টের ব্যাপারে কিঞ্চিৎ লায়েক হয়েছি, তখন মনে হয়েছে শিল্পী হিসেবে তাঁকে নিয়ে বিশেষ ভাবনা-চিন্তা করার অবকাশ নেই, কারণ এইসব বড় বড় অর্ডারি মূর্তির মধ্যে শিল্পীর অসামান্য দক্ষতা প্রকাশ পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাঁর সৃজনশীলতা বা চিন্তা-ভাবনার কোনও প্রতিফলন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ঠিক এইরকম একটা সময়েই কলকাতা বইমেলায় ললিতকলা অ্যাকাডেমির স্টলে পড়ে থাকা ছোট মাপের ভারতীয় শিল্পীদের মনোগ্রাফের একটি স্তূপের মধ্যে আকস্মিকভাবে শিল্পী দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরীর একটি মনোগ্রাফ খুঁজে পাই আমি। ওইখানে দাঁড়িয়ে বইটির কয়েকটি পাতা উল্টে দেখতেই আমার বিস্ময় বহুগুণ বেড়ে যায়। সেখানে ছিল দেবীপ্রসাদের জলরং ও তেলরঙে আঁকা বেশ কয়েকটি ছবি এবং ভাস্কর্যের রিপ্রোডাকশন, যার কোনওটাই অর্ডারি কাজ নয়, শিল্পীর খাঁটি নিজস্ব ভাবনা-চিন্তার ফসল। ললিতকলা অ্যাকাডেমি প্রকাশিত এই সিরিজের বইগুলির দাম খুবই কম ছিল তখন, বোধহয় সাত বা আট টাকা। বলা বাহুল্য, বইটা তৎক্ষণাৎ কিনে নিয়েছিলাম। এই আমার শিল্পী দেবীপ্রসাদের সঙ্গে নতুন করে পরিচয়।
১৮৯৯ সালে অধুনা বাংলাদেশের রংপুরে এক জমিদার পরিবারে জন্মেছিলেন দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী। তেলরঙে ছবি আঁকা শিখেছিলেন এক ইতালিয়ান শিল্পীর কাছে। তারপর কলকাতায় এসে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ফলে, একদিকে যেমন ইউরোপীয় পদ্ধতিতে তেলরঙে ছবি আঁকার তালিম পেয়েছিলেন, তেমনই অবনীন্দ্রনাথ প্রবর্তিত ভারতীয় ধারায় ওয়াশ পেইটিং এবং দূরপ্রাচ্যের কালি তুলির ড্রয়িঙেও সমান দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, স্বয়ং অবনীন্দ্রনাথের নিজের শিল্পশিক্ষাও শুরু হয়েছিল প্রায় একইরকম ভাবে। তবে দেবীপ্রসাদ কেবল ছবি আঁকা শিখেই থেমে যাননি। সেই সময়ের বিখ্যাত ভাস্কর হিরন্ময় রায়চৌধুরীর কাছে পশ্চিমি ধারায় ভাস্কর্যেরও পাঠ নেন, এবং পরবর্তীকালে ভাস্কর হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। এর কিছুকাল পরে তিনি মাদ্রাজ আর্ট স্কুলের প্রিন্সিপাল পদে যোগদান করেন। এটা সেই সময় যখন বাংলায় পশ্চিমি শিল্পধারার সঙ্গে স্বদেশি শিল্পের বিরোধ তার তুঙ্গ স্পর্শ করেছে! একদিকে নন্দলাল বসু, অসিত হালদার, ক্ষিতীন্দ্রনাথ মজুমদার প্রমুখ শিল্পীরা বেঙ্গল স্কুল নাম নিয়ে দেশীয় পদ্ধতির শিল্পচর্চাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন, অন্যদিকে হেমেন্দ্রনাথ মজুমদার, যামিনীপ্রকাশ গঙ্গোপাধ্যায়, অতুল বসু প্রমুখ শিল্পীরা সচেতনভাবে বেঙ্গল স্কুলের ধারাকে পরিহার করে পুরোপুরি ইউরোপীয় পদ্ধতিতে শিল্পচর্চা চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ‘প্রবাসী’, ‘মডার্ন রিভিউ’ ইত্যাদি পত্রিকা শিল্পের ভারতীয়ত্ব এবং বিদেশি প্রভাব নিয়ে তর্কবিতর্ক ও আলোচনায় সরগরম। অবনীন্দ্রনাথের শিষ্য হয়েও দেবীপ্রসাদ কিন্তু এই বিতর্কের প্রভাব নিজের কাজের মধ্যে পড়তে দেননি। একই সঙ্গে ইউরোপীয় ধারায় চিত্রাঙ্কন এবং ভাস্কর্য চর্চার পাশাপাশি খাঁটি দেশীয় ধারাতেও ছবি এঁকে গিয়েছেন এবং এই বিষয়েও তিনি তাঁর গুরু অবনীন্দ্রনাথেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন। যদিও কলকাতায় থাকলে দেবীপ্রসাদ কী অবস্থান গ্রহণ করতেন তা আমরা জানি না, কিন্তু মাদ্রাজে থাকার কারণেই বোধহয় তিনি যে কেবল বেঙ্গল স্কুলের প্রভাব মুক্ত থাকতে পেরেছেন তাই-ই নয়, নিজের শিল্পচর্চাকে স্বাধীনভাবে ইচ্ছেমতো খাতে বইয়ে দিতে পেরেছেন। কোনও বিশেষ স্কুলের আনুগত্য তিনি কখনওই স্বীকার করেননি।
দেবীপ্রসাদের দু’-একটি কাজের উদাহরণ দিয়ে বললে বিষয়টা বুঝতে সুবিধা হবে। ওয়াশ টেকনিকে (অবনীন্দ্রনাথের প্রবর্তিত) আঁকা একটি ছবির নাম ‘মুসাফির’। এই ছবির ড্রয়িং, কম্পোজিশন এবং রঙের প্রয়োগ দেখলে বুঝতে কোনও অসুবিধে হয় না যে, বেঙ্গল স্কুলের ধারায় দেশীয় পদ্ধতিতে ছবি আঁকার ব্যাপারে কতটা দক্ষতা অর্জন করেছিলেন দেবীপ্রসাদ। কিন্তু এইখানেই তিনি নিজেকে সীমাবদ্ধ করে রাখেননি। ১৯২৪ সালে তৈরি তাঁর বাবার প্রতিকৃতি ভাস্কর্য দেখলে আবার নতুন করে চমক লাগে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এই ভাস্কর্যেরই একটি প্রতিলিপি ছাপা হয়েছিল আমার দেখা সেই ললিতকলা অ্যাকাডেমির প্রকাশিত মনোগ্রাফের প্রচ্ছদে। এই প্রতিকৃতি ভাস্কর্য কিন্তু দেবীপ্রসাদের অর্ডারি কাজের থেকে একেবারেই আলাদা। দ্রুত হাতে কিছুটা এক্সপ্রেশনিস্ট ধারায় নির্মিত এই ভাস্কর্যের মধ্যে ব্যক্তির চরিত্রগুণ যেমন প্রকাশ পেয়েছে তেমনই অক্ষুণ্ণ রয়েছে ব্যবহৃত মেটিরিয়ালের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। দেবীপ্রসাদের প্রিয় ভাস্কর রদ্যাঁর কাজের যে অন্তর্নিহিত গুণ, তাই-ই যেন পুরোমাত্রায় সঞ্চারিত হয়েছে কাজটির ভেতরে। সবথেকে বড় কথা, এই প্রতিকৃতি ভাস্কর্যকে তৎকালীন আন্তর্জাতিক আধুনিকতার মাপকাঠিতেও রসোত্তীর্ণ কাজ বলে মেনে নিতে কোনও অসুবিধে হয় না। আবার এই দেবীপ্রসাদেরই জীবনের শেষ পর্বে সাদা-কালো রঙে আঁকা শেয়ালের ছবিটি দেখলে মনে পড়ে যাবে দূর প্রাচ্যের শিল্পধারার কথা। সেই নিয়ম মেনে তিনি ছবিতে সইও করেছেন লম্বালম্বিভাবে, ওপর থেকে নিচে। মনে রাখতে হবে, এইসব কাজকর্মের সঙ্গে সঙ্গেই তিনি শিক্ষকতা করেছেন, প্রকাণ্ড সব অর্ডারি ভাস্কর্য নির্মাণ করেছেন, সাহিত্যচর্চা করেছেন এমনকী, কুস্তিও করেছেন।
দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী হলেন প্রথম ভারতীয় শিল্পী, তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার যাকে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের (গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুল) সবথেকে উঁচু পদে নিয়োগ করেছিলেন। আবার তাঁর শিল্পনৈপুণ্য এবং দক্ষতার স্বীকৃতি স্বরূপ এমবিই (মোস্ট এক্সিলেন্ট অর্ডার অফ দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার) সম্মানও প্রদান করেছিলেন। দেবীপ্রসাদ চাইলে কেবলমাত্র বড় বড় উচ্চপদস্থ সাহেব এবং এদেশীয়দের মূর্তি গড়েই ক্ষান্ত দিতে পারতেন। কিন্তু আশ্চর্যভাবে যখনই তিনি নিজের ইচ্ছেমতো ছবি এঁকেছেন বা মূর্তি গড়েছেন, সেখানে সবসময় ফিরে ফিরে এসেছে ভারতের দরিদ্র, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জীবনের কথা। শিল্পের মধ্য দিয়ে তাঁর নিজের কথা তিনি যতটুকু বলার চেষ্টা করেছেন, সেখানে সমাজের সবথেকে পিছিয়ে পড়া শ্রেণির প্রতি সহমর্মিতাই প্রতিফলিত হয়েছে বারেবারে। মনে হয় যেন আপাতকঠিন এই মানুষটির মধ্যে লুকিয়ে আছেন অন্য আর একজন দেবীপ্রসাদ। ঠিক এই কারণে তাঁর শিল্পসৃষ্টির ভাষার মধ্যেও রয়েছে বিভিন্নতা।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন সমীর মণ্ডল-এর লেখা: চিন্তা ও রুচির দুর্ভিক্ষের কোনও ছবি হয় না, বলেছিলেন জয়নুল আবেদিন
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এ পর্যন্ত পড়ে হয়তো অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, এত রকমের ভিন্ন ধারার চর্চা করার ফলে কি শিল্পী হিসেবে দেবীপ্রসাদের নিজস্ব আত্মপরিচয় নির্মাণের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হয়েছিল? এই প্রশ্নের সদুত্তর আমার জানা নেই, তবে এটুকু বলতে পারি দেবীপ্রসাদ যে সময়ের শিল্পী, সেই সময়ের অনেক বড় মাপের শিল্পীর কাজের মধ্যেই এই ধরনের শিল্পভাষার বিভিন্নতা দেখতে পাওয়া যায়। অবনীন্দ্রনাথের কৃষ্ণলীলা সিরিজ, আরব্য রজনী সিরিজ, খুদ্দুর যাত্রা এবং কুটুম কাটামের কথা ভাবলেই এই শিল্পভাষার বিভিন্নতা স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু তার মানে এই নয় যে শিল্পীর অস্তিত্বের কোনও ছাপই নেই তাঁর সৃষ্টির মধ্যে। এই ঘটনার পিছনে প্রধান কারণ হচ্ছে, ওই বিশেষ সময়ের বড় মাপের শিল্পীরা কেউই পূর্ববর্তী কোনও শিল্পীর তৈরি করে দেওয়া মসৃণ এবং নিশ্চিত পথে হাঁটছিলেন না। তাঁরা প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে করতে, ভিন্ন ভিন্ন রাস্তা পরখ করতে করতে এগোচ্ছিলেন। আক্ষরিক অর্থেই তাঁরা ছিলেন এক একজন পায়োনিয়ার। বরং তাঁদের তৈরি করে দেওয়া আধুনিক ভারতীয় শিল্পের সেই মসৃণ পথ না পেলে আমরা অর্থাৎ আজকের শিল্পীরা নিজস্ব শিল্পভাষার মাধ্যমে আত্মপরিচয় নির্মাণের কথা ভাবতে পারতাম না। দেবীপ্রসাদের কাজও সেই ভারতীয় শিল্পের নিজস্ব পথ নির্মাণ পর্বেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
……………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………….