জীবনের একটা বড় সময় দারিদ্র ও নেশার কবলে কাটিয়েছিলেন পো, সাহিত্যজগতে উপযুক্ত স্বীকৃতির অভাব তাঁকে ঠেলে দিয়েছিল নৈরাশ্যের অন্ধকারে। সে কারণেই হয়তো তাঁর সৃষ্টিতে বারবার ছায়া ফেলেছিল মৃত্যুচেতনা। পো-এর সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতা ‘দ্য রেভেন’– যেখানে প্রেমিকার মৃত্যুতে কাতর কবিকে হতাশার অতলে নিমজ্জিত করে দাঁড়কাকের বিষণ্ণ উচ্চারণ ‘নেভারমোর’– নিঃসন্দেহে তাঁর অবচেতন ‘ডেথ উইশ’-এরই বহিঃপ্রকাশ।
আঠেরো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে হোরাস ওয়ালপোল-এর ‘দ্য ক্যাসল অফ অত্রান্তো’ (১৭৬৪) বা ম্যাথিউ লিউইস-এর ‘দ্য মঙ্ক’ (১৭৯৬)-এর হাত ধরে যে গথিক ফিকশনের পথচলা শুরু হয়েছিল, তা এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছয় উনিশ শতকের প্রথমার্ধে, আমেরিকান সাহিত্যিক এডগার অ্যালান পো-র হাত ধরে। প্রায় ধূমকেতুর মতো লেখালিখির জগতে প্রবেশ করেন পো, নিজের স্বতন্ত্র স্থান খুঁজে নেন অলৌকিক সাহিত্যের আঙিনায়। তাঁর প্রথম প্রকাশিত কাহিনি ‘মেটজেঙ্গারস্টাইন’ (১৮৩২) যেমন, পরতে পরতে বহন করে গা ছমছমে অতিপ্রাকৃতের স্বাদ। ইউরোপীয় গথিক-এর বৈশিষ্ট্য কেবল তার বাহ্যিকেই সীমাবদ্ধ থাকে না, মূলেও রেখাপাত করে অবলীলায়। সার্থকতা পায় সৃষ্টি ও স্রষ্টা।
‘দ্য ফল অফ দ্য হাউজ অফ আশার’ (১৮৩৯) নিঃসন্দেহে পো-এর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তি; এই গল্পের চরিত্রায়ণ থেকে আবহ নির্মাণ– সব ক্ষেত্রেই অসামান্য দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। আশার বংশের আঁধারঘেরা অতীত, মানসিক ভারসাম্যহীনতা ও অজাচারের গোপন ইতিহাস কাহিনির মুখ্যচরিত্র রডরিক ও তার যমজ বোন ম্যাডেলাইন-এর মধ্যেকার অস্বাভাবিক সম্পর্কের প্রতি দিকনির্দেশ করে, পাশাপাশি ইঙ্গিত দেয় জড় এবং চেতনের মধ্যেকার অশুভ যোগাযোগেরও। কাহিনি এগোনোর পরে কথকের মতো আমরাও উপলব্ধি করি, ‘হাউজ অফ আশার’ কেবলই এক পুরনো, ভগ্নপ্রায় বাড়ি নয়, বরং প্রায়-জীবন্ত এক অস্তিত্ব, যার আয়ু বংশের শেষ দুই উত্তরাধিকারীর জীবনের সঙ্গে এক তারে বাঁধা। রডরিক ও ম্যাডেলাইন পরস্পরের মৃত্যুর কারণ হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই ধ্বংস হয়ে যায় আশার-এর অভিশপ্ত বাড়ি। ট্র্যাজেডি-র দ্যোতনা জাগিয়ে গল্পে যবনিকা পড়ে, অনুচ্চকিত আতঙ্কের রেশ তবু রয়ে যায় বহুক্ষণ।
পাঠকের শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বইয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ‘ডোপলগ্যাংগার’ থিম-কে একাধিকবার ব্যবহার করেছেন পো, এবং প্রতিবারই সফল হয়েছেন। ‘লিজিয়া’ (১৮৩৮) এর অন্যতম উদাহরণ। গল্পে আমরা পাই রহস্যময়ী সুন্দরী লিজিয়া-কে, যে কথকের সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হওয়ার পরপরই অজানা অসুখে মারা যায়। শোকসন্তপ্ত কথক দ্বিতীয়বারের জন্য বিয়ে করেও সুখের মুখ দেখে না, তার দ্বিতীয় স্ত্রী রোয়েনা-ও অল্প সময়ের মধ্যেই মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। মৃত্যুর পর রোয়েনা-কে জাগিয়ে তোলার সবরকম চেষ্টা করে কথক, এবং আশ্চর্যজনকভাবে একসময় প্রাণও ফিরে পায় সে। কিন্তু পাঠক অবাক হয়ে দেখে, সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে পরপার থেকে ফিরে আসা রোয়েনা, ধারণ করেছে লিজিয়া-র রূপ! ‘উইলিয়াম উইলসন’ (১৮৩৯) কাহিনির শুরুতে আমরা দেখি, কথক তথা নামচরিত্র উইলিয়াম-এর জীবনে অশনির কালো মেঘের মতো উপস্থিত হয়েছে হুবহু তারই মতো দেখতে আরেকজন ব্যক্তি। হাঁটাচলা, আচার-আচরণ সবেতেই উইলিয়াম-কে নকল করতে থাকে সেই ‘অপর’, মানসিক বিকারের দিকে তাকে ঠেলে নিয়ে যায় ক্রমশ। অস্তিত্বের সংকট সহ্য করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত ‘ছদ্মবেশী’ উইলিয়াম-কে খুন করে কথক, এবং ভাগ্যের বিচিত্র পরিহাসে, নিজের ওপরই হেনে বসে মারণ আঘাত!
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
কাহিনি এগোনোর পরে কথকের মতো আমরাও উপলব্ধি করি, ‘হাউজ অফ আশার’ কেবলই এক পুরনো, ভগ্নপ্রায় বাড়ি নয়, বরং প্রায়-জীবন্ত এক অস্তিত্ব, যার আয়ু বংশের শেষ দুই উত্তরাধিকারীর জীবনের সঙ্গে এক তারে বাঁধা। রডরিক ও ম্যাডেলাইন পরস্পরের মৃত্যুর কারণ হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই ধ্বংস হয়ে যায় আশার-এর অভিশপ্ত বাড়ি। ট্র্যাজেডি-র দ্যোতনা জাগিয়ে গল্পে যবনিকা পড়ে, অনুচ্চকিত আতঙ্কের রেশ তবু রয়ে যায় বহুক্ষণ।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
‘টেরর’ ও ‘হরর’-এর মধ্যেকার পার্থক্য নিরূপণ করতে গিয়ে অ্যান র্যাডক্লিফ লিখেছিলেন, টেরর ‘expands the soul and awakens the faculties to a high degree of life’, অন্যদিকে হরর ‘freezes and nearly annihilates them.’ এই আঙ্গিকে বিচার করলে পো অধিকাংশ সময়ে ‘টেরর’-এরই জয়গান গেয়েছেন। পোড়োবাড়ি বা কবরখানায় হানা দেওয়া ভূত-প্রেত-পিশাচের তাণ্ডব নয়, মনের গহীনে লুকোনো নিষিদ্ধ আকাঙ্ক্ষা ও অবদমিত যৌনচেতনাই তাঁর ভয়সাহিত্যের মূল প্রতিপাদ্য। ‘বেরেনিস’ (১৮৩৫) কাহিনিতে ভাবী স্ত্রী বেরেনিস-এর দাঁতের প্রতি এগিয়াস-এর তীব্র আকর্ষণ পর্যবসিত হয় ‘মনোম্যানিয়া’-য়, যার ভয়ংকর পরিণতি পাঠককে স্তব্ধ দেয়। ‘দ্য কাস্ক অফ অ্যামনটিলাডো’ (১৮৪৬) গল্পে প্রতিশোধস্পৃহায় অন্ধ মন্ট্রেসর তার বন্ধু ফরচুনেটো-কে দুর্লভ মদের লোভ দেখিয়ে ভূ-গর্ভস্থ সুড়ঙ্গে নিয়ে যায়, জ্যান্ত কবর দেয় দেওয়ালের পেছনে। আসন্ন মৃত্যুর ভয়ে দিশাহারা ফরচুনেটো-র অসংলগ্ন সংলাপ এবং প্রতিদ্বন্দ্বীর অন্তিমক্ষণ উপভোগ করা মন্ট্রেসর-এর নিষ্ঠুর শীতলতা এই ‘রিভেঞ্জ টেল’-কে অন্য মাত্রায় উন্নীত করে।
‘দ্য টেলটেল হার্ট’ (১৮৪৩) ও ‘দ্য ব্ল্যাক ক্যাট’ (১৮৪৩) নিয়ে দু’-চার কথা না বললে পো সংক্রান্ত যে কোনও আলোচনাই অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। ‘আনরিলায়েবল ন্যারেটর’ ট্রোপ-কে ছোটগল্পের পরিসরে এমন নিপুণভাবে ব্যবহারের মুনশিয়ানা খুব কম সাহিত্যিকই দেখিয়েছেন। দু’ক্ষেত্রেই অতিপ্রাকৃতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক ভয়ের দোলাচল পাঠককে শেষ অবধি বিভ্রান্ত করে রাখে, কোনটা সত্যি এবং কোনটা কথকের অসুস্থ মনের কল্পনা, তা স্পষ্টভাবে বুঝে ওঠা সম্ভব হয় না কখনওই। প্রথম গল্পে খুন হওয়া বৃদ্ধের হৃৎপিণ্ডের নিরন্তর লাবডুব শব্দ খুনিকে খাদের কিনারায় এনে দাঁড় করায়, মানসিক যন্ত্রণার তাড়নায় একসময় নিজের অপরাধ স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয় সে। দ্বিতীয় গল্পে অত্যাচারী, মদ্যপ কথকের মনে বদ্ধমূল ধারণা জন্মায় যে, তার পাপের শাস্তি দিতে একটা কালো বিড়াল পরপার থেকে ফিরে এসেছে, এবং শেষমেশ সে নিজেই নিজের পতন ডেকে আনে। সঙ্গত কারণেই ভয়রসিকদের অকুণ্ঠ প্রশংসা পেয়েছে এই দুই কাহিনি, নানা সংকলনে জায়গা করে নিয়েছে, অগুনতিবার অনূদিতও হয়েছে।
জীবনের একটা বড় সময় দারিদ্র ও নেশার কবলে কাটিয়েছিলেন পো, সাহিত্যজগতে উপযুক্ত স্বীকৃতির অভাব তাঁকে ঠেলে দিয়েছিল নৈরাশ্যের অন্ধকারে। সে কারণেই হয়তো তাঁর সৃষ্টিতে বারবার ছায়া ফেলেছিল মৃত্যুচেতনা। পো-এর সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতা ‘দ্য রেভেন’– যেখানে প্রেমিকার মৃত্যুতে কাতর কবিকে হতাশার অতলে নিমজ্জিত করে দাঁড়কাকের বিষণ্ণ উচ্চারণ ‘নেভারমোর’– নিঃসন্দেহে তাঁর অবচেতন ‘ডেথ উইশ’-এরই বহিঃপ্রকাশ। ‘শ্যাডো: আ প্যারাবেল’ ও ‘দ্য সিটি ইন দ্য সি’ কবিতায় মৃত্যুকে সর্বগ্রাসী জীবন্ত সত্তা হিসেবে বর্ণনা করেই ক্ষান্ত দেননি তিনি, ‘ফর অ্যানি’ কবিতায় রীতিমতো আঁকড়ে ধরেছেন মৃত্যুবিলাসকে, ‘The fever called living is conquered at last.’ এ প্রসঙ্গে তাঁর ছোটগল্প ‘দ্য মাস্ক অফ দ্য রেড ডেথ’ (১৮৪২) উল্লেখের দাবি রাখে। প্লেগ মহামারীকে রূপকের আঙ্গিকে ফুটিয়ে তোলা এই ডার্ক-ফ্যান্টাসির নায়ক মৃত্যু স্বয়ং। অভিজাত প্রাসাদের চার দেওয়ালের মধ্যে নিজেকে সুরক্ষিত মনে করে যুবরাজ প্রস্পেরো, সপার্ষদ বেলাগাম ভোগবিলাসে মত্ত হয়ে সময় কাটায়। কিন্তু অবশ্যম্ভাবী নিয়তিকে সে এড়াতে পারে না। ছদ্মবেশে প্রাসাদে প্রবেশ করে ‘রেড ডেথ’, একে একে সাত কক্ষ পার হয়ে প্রস্পেরো-সহ সমস্ত অতিথির জীবন কেড়ে নেয়। সংশয়াতীতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় মৃত্যুর সর্বময়তা।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এডগার অ্যালান পো রহস্য-রোমাঞ্চ ঘরানার ভিত্তি স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন, একথা সর্বজনবিদিত। ১৮৪১ সালে প্রকাশিত ‘মার্ডারস অ্যাট দ্য রু মর্গ’ পাঠকদের এক টানটান ‘লকড রুম মিস্ট্রি’ উপহার দেওয়ার পাশাপাশি পরিচয় করিয়েছিল সাহিত্যের প্রথম গোয়েন্দা চরিত্র অগস্তে দ্যুপেঁ-র সঙ্গে। তারপর আর মাত্র দু’টি গল্পে দেখা দেন দ্যুপেঁ, কিন্তু তাতে তাঁর জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি। বরং কাব্য ও অঙ্কশাস্ত্রে সমপরিমাণে আগ্রহী, রাত জাগতে উৎসুক, পাইপের ধোঁয়ায় মগজ শানানো দ্যুপেঁ অচিরেই হয়ে ওঠেন খামখেয়ালি প্রাইভেট ডিটেকটিভ-এর ‘আর্কেটাইপ’; পরবর্তীকালে আর্থার কোনান ডয়েল, আগাথা ক্রিস্টি তাঁর ছাঁচেই গড়েন শার্লক হোমস, এরকুল পোয়ারো-কে। দ্যুপেঁ-র ‘রেশিওসিনেশন’– মনে মনে যুক্তির সিঁড়ি সাজিয়ে রহস্যের সমাধানে পৌঁছনোর পদ্ধতি– আজও ‘আর্মচেয়ার ডিটেকশন’ শাখার মূলমন্ত্র হিসেবে গণ্য হয়– এ নিঃসন্দেহে পো-এর মুকুটে এক রঙিন পালক।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আরও পড়ু্ন: শক্তিপদ রাজগুরুর বই শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে দিয়ে এক পাঠক সই করাবেনই করাবেন!
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
সায়েন্স ফিকশন সাহিত্যের রূপরেখা নির্মাণেও পো-এর অবদান অনস্বীকার্য। মেরি শেলি-র ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন’ উপন্যাসে বিজ্ঞান-কল্পনার পাশাপাশি স্থান পেয়েছিল রোম্যান্টিকতা, দর্শন, ধর্মীয় অনুষঙ্গ ইত্যাদি। পো সে পথে হাঁটেননি, কল্পবিজ্ঞানের চর্চায় মন দেন নিজের মতো করে। ‘দ্য আনপ্যারালেলড অ্যাডভেঞ্চারস অফ ওয়ান হান্স ফল’ (১৮৩৫), ‘আ ডিসেন্ট ইন্টু দ্য মেলস্ট্রম’ (১৮৪১) ‘মেলনটা টাউটা’ (১৮৪৯) জাতীয় কাহিনির মাধ্যমে, কোনওরকম আবেগ বা অতিনাটকীয়তা ছাড়াই, চন্দ্রাভিযান, সামুদ্রিক অ্যাডভেঞ্চার বা সময়যাত্রার মতো বিস্ময়কর বিষয়কে পাঠকের সামনে তুলে ধরেন তিনি। বাস্তবতার মোড়কে বিজ্ঞানভিত্তিক কল্পকাহিনি পরিবেশনের এই ধরনকেই পরে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন জুল ভার্ন, এইচ জি ওয়েলস প্রমুখ কিংবদন্তি, জন্ম নেয় অবিস্মরণীয় কিছু ‘সায়েন্টিফিক রোম্যান্স’।
১৮৪৯ সালে মাত্র ৪০ বছর বয়সে পো-র দেহাবসান হয়। তারপর পেরিয়েছে প্রায় ১৭৫ বছর, তবু এতটুকু হ্রাস পায়নি তাঁর প্রাসঙ্গিকতা। হরর-এর তত্ত্ব নিয়ে জীবদ্দশায় গভীরভাবে চর্চা করেছেন পো, রচনার গদ্যশৈলী এবং নান্দনিকতাকে প্রাধান্য দিয়েছেন বিশেষভাবে। ফলে তাঁর ভৌতিক-অলৌকিক সাহিত্য হয়ে উঠেছে পরবর্তী প্রজন্মের লেখকদের কাছে দিকনির্দেশ, নিবিড় অনুপ্রেরণা। বর্তমানে পাশ্চাত্য পপুলার কালচার-এর অন্যতম ‘আইকন’ তিনি, একইসঙ্গে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের পাঠক্রমের অপরিহার্য অংশও।