আশপাশের পাড়ার যে কোনও পরিবার যখনই শ্রীহরি থেকে মিষ্টি বা নোনতা মায় জিলিপিও কিনত, প্রতিবার অন্তত একটা অতিরিক্ত পেয়ে থাকত ফাউ হিসেবে। এই রীতি গত পঞ্চাশ বছরের হলে, আর ক্রমবর্ধমান (আঞ্চলিক) পরিবারের সংখ্যাকে মাথায় রেখে ওই লাল জাবদা খাতাগুলো নামিয়ে হিসেব কষলে অঙ্কটা সেদিনের মূল্যে লাখের অনেক বেশিই হত, সন্দেহ নেই। না, সব লেনদেন তখনও বাজারের নিখাদ অর্থবহ বিনিময় হয়ে ওঠেনি। বহুলাংশে তা ছিল সামাজিক, মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের এক মুদ্রিত বিস্তার।
তো, ঠিক হল বোন্টিদি, টুম্পাদিদের সঙ্গে আমিও দাঁড়িয়ে পড়ব। অপেক্ষা করতে হবে না। জুগ্নু অনেক বোঝার ও বোঝানোর চেষ্টা করে অবশেষে ইতুদি-র ঝোড়ো ইনিংসের সামনে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করে এই ব্যবস্থা মেনে নেয় এবং তা পূর্ণ সাফল্যের সঙ্গে কার্যকর হয়। বহাল থাকে ততদিন, যতদিন ওই দিদিদের বৃত্ত সম্পূর্ণ ছিল। বিষয়টা সরল ও সাংঘাতিক। ফাউ-এর দুনিয়ায় এক আলোড়ন সৃষ্টিকারী চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। ফুচকার ঝাল আর ঝাঁঝালো টকজল পেটে না পড়লে সন্ধেবেলায় পড়ায় মন বসত না যাদের, তাদের মধ্যে আমিও ছিলাম। আর বলাই বাহুল্য– ছিল আমার পাড়াতুতো দিদিদের দোর্দণ্ডপ্রভাবশালী দল। চার আনায় (২৫ পয়সা) পাঁচটা হলেও, ওই চার আনা জোগাড় করা আমাদের মতো বিদ্যার্থীদের পক্ষে যথেষ্ট কঠিন ও দুশ্চিন্তার বিষয় ছিল সেসময়ে! বিকেলে মাঠে বা রাস্তায় ফুটবল অথবা ক্রিকেট অথবা এক সুবিস্তৃত পরিসরে আই স্পাই(স) খেলার পর আমি ছুট লাগাতাম পাড়ার মোড়ে জুগ্নু-র ফুচকার উদ্দেশে। কাঁটায় কাঁটায় ছ’টা। সাড়ে ছ’টার মধ্যে বাড়ি ফিরে সাতটায় পড়তে বসা। সাড়ে ন’টার মধ্যে হোমওয়ার্ক শেষ করতে পারলেই আধঘণ্টা খাওয়ার ছুটি, সঙ্গে একটা ফাউ– ‘জনি সোকো এন্ড হিস ফ্লাইং রোবট’। ঠিক ওই ছ’টার সময়ে জুগ্নুকে ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে মাথা খারাপ করত বোন্টিদি-রা– সাতজন। কার ঝাল কম, কার বেশি, কার টক বেশি, নুন কম ইত্যাকার নির্দেশের তিরে জুগ্নু এমনিতেই চাপে থাকত। এদের পাশে আমি কোনও দিন দুটো, কোনও দিন ১৫ পয়সার সামান্য ফুচকার গ্রাহক। ব্যবসায়ীর বৃহত্তর স্বার্থে আমাকে অপেক্ষা করতে হত পরের রাউন্ডের জন্য। সরল আমি এবং নির্দয় ফুচকা বিক্রেতার এই করুণকাহিনির ভিতর দেবীর মতো ইন্টারভেন করে এই দিদিদের দল। তারা নিদান দেয়– ওদের সাতজনের সাতটা ফাউ ফুচকা আমি পাব। অপেক্ষাও করতে হবে না। একই রাউন্ডে দাঁড়াব এবং সৌজন্যবশত সবাই যেহেতু একটা করে ফাউ পেয়েই থাকে, সেহেতু সাতটা ফাউয়ের সঙ্গে আমি আরও একটা ফাউ সমেত মোট আটটা ফুচকার অধিকারী। শুধু তাই-ই নয়, কোনও কারণে সাতজনের এক বা একাধিক বা সকলেও যদি কোনও দিন অ্যাবসেন্ট থাকে, সেক্ষেত্রে আমার দাবি অপরিবর্তিত থাকবে, কারণ সেটা পরে ‘অ্যাডজাস্ট’ হয়ে যাবে। এই অঙ্ক জুগ্নুর বোঝা সম্ভব ছিল না। কয়েকবার মিহি প্রতিবাদ করে, টিকি চুলকে সে এই ব্যবস্থা মেনে নেয় এবং ফাউ-এর কনসেপ্ট যে, অভুক্তকে, সামান্যকে অসামান্য করে তুলতে পারে, তার দিকচিহ্ন নির্দিষ্ট হয় আজ থেকে বহু বছর আগে আমাদের এই বকুল বাগান রোডে। এখানে বলে রাখা ভালো, যেদিন ওদের কেউ আসত না, সেদিন আমি আটের বদলে ঠিক সাতটা ফুচকা খেতাম। পরেরদিন ওরা সাতজন একটা করে ফুচকা কম খেত এবং দুটো করে ফাউ নিত। সারা বছরের বাঁধা খদ্দের যাতে তাকে ছেড়ে ও-মোড়ের মোতি-র কাছে না চলে যায়, এই আশঙ্কায় জুগ্নু এই আপাতসরল গণিত মেনে নিয়েছিল।
‘যদি হিসেব করতাম, তাহলে লাখ টাকা রোজগার হত বুঝলি’– একগাল হেসে বলেছিল পরাশরদা, আমাদের বিখ্যাত শ্রী হরি মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মালিক কাম ক্যাশিয়ার শ্রী পরাশর গুঁই। আশপাশের পাড়ার যে কোনও পরিবার যখনই শ্রীহরি থেকে মিষ্টি বা নোনতা মায় জিলিপিও কিনত, প্রতিবার অন্তত একটা অতিরিক্ত পেয়ে থাকত ফাউ হিসেবে। এই রীতি গত পঞ্চাশ বছরের হলে, আর ক্রমবর্ধমান (আঞ্চলিক) পরিবারের সংখ্যাকে মাথায় রেখে ওই লাল জাবদা খাতাগুলো নামিয়ে হিসেব কষলে অঙ্কটা সেদিনের মূল্যে লাখের অনেক বেশিই হত, সন্দেহ নেই। না, সব লেনদেন তখনও বাজারের নিখাদ অর্থবহ বিনিময় হয়ে ওঠেনি। বহুলাংশে তা ছিল সামাজিক, মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের এক মুদ্রিত বিস্তার। ওই যে বাজারের সঙ্গে একমুঠো লঙ্কা আর দু’গাছি ধনেপাতা ঢুকে পড়ত থলের ভিতরে, সেই যে বাড়ির কাটাপোনার সঙ্গে একভাগা চুনোমাছ শালপাতায় মুড়ে চলে আসত হেঁশেলে হেঁশেলে, বা ধরো, আট আনার মাঞ্জা কিনতে দশ হাত এমনিই গুটিয়ে নেওয়া যেত হাতের পাঞ্জায় আর ফেরার পথে বেকারির দরজায় দাঁড়ালেই ম্যানেজারবাবু বিরক্তমুখ করে আমাদের দু’হাত ভাঙা বিস্কুটে ভার দিয়ে ‘দূর হ’ বলে কী এক আশ্চর্য সুরে গেয়ে উঠতেন এককলি হরিনাম। এসবই ছিল বাজারের ভিতরে কোন এক গাছতলায় কেনা-বেচার মধ্যে দু’টি হাতের সামান্য স্পর্শের মতো একটু অতিরিক্ত।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
খিদের মুখে গরম গরম লুচি-বেগুন ভাজা-ছোলার ডাল টপকে সবে মাছে ঢুকব, এমন সময়ে বাইরে বিরাট গন্ডগোল– কনের সীতাহার পাওয়া যাচ্ছে না! একজন দৌড়ে এসে আমাদের বলল– ‘পালান, পালান জেঠু আসছে’। কে জেঠু? কীসের হার? এসব ভাবার সময় নেই, ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়চ্ছি স্টেশনের দিকে, পিছনে একটা ‘ধর্ ধর্ টাইপের চিৎকার।’ কোনওক্রমে আরও কয়েকজনের সাহায্যে উঠে পড়লাম বালিগঞ্জগামী লোকালে। সবে হাঁপ ছেড়ে একটা বিড়ি ধরাতে যাব, পাশ থেকে পলাশ বলল– ‘এই দ্যাখ’। দেখি একগাল হাসি নিয়ে দু’হাতে একটা গোটা দইয়ের হাঁড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
কিছুটা অভাবী সংসারের আর পাঁচজন গৃহিণীর মতো আমার মা-ও পাকেচক্রে জড়িয়ে পড়েছিলেন ‘ফেয়ারডিল’ সংস্থার সঙ্গে। কিছু টাকাকড়ি জমা রেখে পছন্দমতো থালা-বাসন, প্রসাধনী, জামাকাপড় কিনে পরিচিতজনের বাড়ি বাড়ি ঘুরে তা বিক্রি করা। এক্ষেত্রে ছিল দু’রকম ফাউয়ের ফাঁদ। ক্রেতা দু’টি জিনিস কিনলে একটি পাবেন (তৃতীয়টি) ফাউ হিসাবে, এবং তিনি ফেয়ারডিলের সদস্য হয়ে ওই একই পদ্ধতিতে নিজেও এই ঘরোয়া ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হতে পারবেন, উপরন্তু বিক্রেতা দু’জন নতুন ফেয়ারডিল সদস্য জোগাড় করে দিতে পারলে পরের দফায় বিক্রয়সামগ্রী বা নিজের ব্যবহারের জন্য কোনও জিনিস ওই সংস্থা থেকে কেনার সময় প্রতি তিনটিতে একটি করে ফাউ পেতে থাকবেন। বিনামূল্যে অতিরিক্ত কোনও কিছুর প্রাপ্তি যে মানুষকে কতটা পুলকিত করতে পারে, তা আজকের বড় বড় আনন্দের পৃথিবীতে ছোট ছোট উজ্জ্বল হাসির মতো বর্ণনাতীত মনে হয়। ফেয়ারডিল-এর চক্করে ফাউয়ে পাওয়া গামলা, গামবুট, হাতা, ছাতা, এমনকী, মশারি পর্যন্ত মা-মাসিদের আমি এর-ওর উপনয়ন বা অন্নপ্রাশনে সুন্দর মোড়কে মুড়ে নাম না-লিখে অত্যন্ত পারদর্শিতার সঙ্গে চালান করতে দেখেছি।
পাবলিক ফাউ পেলে বিষও খায়। সোনারপুরে খেপ খেলতে গেলে শুধু টাকাই নয়, একটা বিয়েবাড়িতে খাওয়াদাওয়া ফাউ আছে শুনে আমরা রাজি হয়ে গেলাম। আয়োজক এবং প্রতিপক্ষ দু’দলেই ভাগ হয়ে খেলে দিলাম সবাই। খেলা হল ধুন্ধুমার। খেলা শেষে টাকাপয়সাও জুটল এবং বলা হল সবাইকে মিঠু-র দিদির বিয়েতে নিয়ে যেতে। সবে সন্ধে হয়েছে কি হয়নি, সারা গায়ে কাদামাটি মাখা আমরা আটজন হাজির হলাম একটা প্যান্ডেলের পিছনে। সামনে মাইকে সানাই শুরু হয়েছে, ডেকরেটার তখনও ফুল লাগাতে ব্যস্ত, এর মধ্যেই একজন পিছনের তেরপল ফাঁক করে আমাদের ফিসফিস করে বললেন– ‘দাদা, বসে যান।’ রান্নাঘরের ঠিক সামনে পাতা বেঞ্চিতে বসে খেতে শুরু করেছি আমরা। বাকি সব টেবিল-চেয়ার ফাঁকা। খিদের মুখে গরম গরম লুচি-বেগুন ভাজা-ছোলার ডাল টপকে সবে মাছে ঢুকব, এমন সময়ে বাইরে বিরাট গন্ডগোল– কনের সীতাহার পাওয়া যাচ্ছে না! একজন দৌড়ে এসে আমাদের বলল– ‘পালান, পালান জেঠু আসছে’। কে জেঠু? কীসের হার? এসব ভাবার সময় নেই, ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়চ্ছি স্টেশনের দিকে, পিছনে একটা ‘ধর্ ধর্ টাইপের চিৎকার।’ কোনওক্রমে আরও কয়েকজনের সাহায্যে উঠে পড়লাম বালিগঞ্জগামী লোকালে। সবে হাঁপ ছেড়ে একটা বিড়ি ধরাতে যাব, পাশ থেকে পলাশ বলল– ‘এই দ্যাখ’। দেখি একগাল হাসি নিয়ে দু’হাতে একটা গোটা দইয়ের হাঁড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
তা সে যুগও নেই, জগ্নুও নেই। আজকের ‘বাই ওয়ান গেট ওয়ান ফ্রি’-র দুনিয়ায় ফাউ সরে গিয়েছে দূরে। এখন তা হয়ে উঠেছে নির্বাচনী হাতিয়ার। ভোট দিলে ভেট ফ্রি। এত দান, অনুদান, সম্প্রদানের শ্রীময় জগতে ফাউ এক ফাউস্টের সঙ্গে শয়তানের চুক্তির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু যে নিতে জানে, সে নেবেই। আজও যে কোনও ফুচকার বৃত্তে একটি বা দু’টি অতিরিক্ত শুকনো বা পাপড়ি চালু আছে। পরিচিত বাজারে এখনও শোনা যায় ‘পঞ্চাশ গ্রাম বেশি আছে কাকু’, আর আধো-পরিচিত পানশালায় এখনও সেই ৩০ বছর আগের ফরমুলা মেনে চারজনের পয়সায় একজন ফ্রি হয়ে যায়। বিকেলের পড়তি আলোয় তারা সদাহাস্যময় সাকিকে জিজ্ঞেস করে– ‘কোনটা’? সাকি দেখিয়ে দেয়– ‘এই যে, অফার আছে, দুটো নিলে তিনটে পাবে।’ চলতে থাকে সামান্য ফাউয়ের ফোয়ারা, তবে কেউ না এলে পরের দিন অ্যাডজাস্ট হয়ে যাবে, এই পরিকল্পনা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি।
হল বলে… চিয়ার্স।
সবার থেকে বেশি আক্রমণ নেমে এসেছে কাশ্মীরের সাংবাদিকদের ওপর। একাধিক সংবাদপত্রের সম্পাদক, সাংবাদিকদের শুধু জেলবন্দিই করা হয়নি, ইন্টারনেট লকডাউন করে প্রায় উপত্যকাকেই একটা জেলে পরিণত করা হয়েছে, যেখানে কোনও রকম সাংবাদিকতাই করাই একসময় অসম্ভব হয়ে উঠেছিল।