যে সময়ে আমি কাদম্বিনী হয়েছি, এক চিকিৎসকের চরিত্রে অভিনয় করছি, তখন বিশ্বজোড়া কোভিড। তিনি সে অর্থে কোনও অতিমারীর মুখোমুখি হননি। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সে সময়ে অনেক রোগ নিয়েই যথেষ্ট ছুঁৎমার্গ ছিল, যা পেরিয়ে গিয়েছিলেন কাদম্বিনী। সে ছুঁৎমার্গ যে শুধু রোগ বিষয়ে, তাই নয়, সামাজিক-মানসিকভাবেও তা ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে ছিল। সেই অসুখের ভ্যাকসিন ছিলেন কাদম্বিনী গাঙ্গুলি। আজ তাঁর শততম মৃত্যুদিন।
২০১৫ সাল। বইমেলা। যা করি প্রতিবার, করছি– মানে এই-ওই স্টল ঘুরে বেড়াচ্ছি। মনের খাদ্য খুঁজছি। হঠাৎই একগাদা বইয়ের ফাঁকে একটি বইয়ের দিকে নজর গেল। ‘ঝড়ের মেয়ে কাদম্বিনী’। হাতে তুলে, একটু উল্টে দেখলাম। ‘ঝড়ের মেয়ে’ এই শব্দজোড়াও ভারী পছন্দ হল। কিন্তু তার সঙ্গে এই ‘কাদম্বিনী’ নামক ভদ্রমহিলার কী সম্পর্ক? কে তিনি? একটু পাতা ওল্টাতেই টের পেলাম, তিনি এশিয়ার প্রথম বাঙালি মহিলা ডাক্তার। জন্মেছিলেন ১৮৬১ সালে। ১৮৬১! বটে! পড়তে হচ্ছে। অতএব, সেই বইমেলায় আমার সঙ্গে ফিরেছিলেন কাদম্বিনী গাঙ্গুলি।
বইখানা পড়ে ফেলেছিলাম দ্রুত। এমন এক আশ্চর্য জীবন। সমসময়ের সঙ্গে কী তীব্র লড়াই! নিজের পায়ে দাঁড়ানোর কী অপ্রতিরোধ্য জেদ। সেই প্রথম কাদম্বিনী আর আমার সখ্য, আলাপ। তখন মাত্র দু’-বছর হয়েছে, আমি অভিনয় জগতে কাজ করতে শুরু করেছি। কিন্তু কাদম্বিনীর সঙ্গে ওই অক্ষর-আলাপের পর মনে হয়েছিল, কেন ওঁকে নিয়ে কাজ হয় না? যদি হয়, অবশ্যই দেখব। ওঁকে আরও জানতে চাইব, বুঝতে চাইব।
২০২০ সালে, হঠাৎ একদিন দেখলাম, কাদম্বিনী টেলিভিশনে আসছে। একটি চ্যানেলের তরফ থেকে প্রোমো প্রকাশিত হয়েছে। সত্যি বলতে একইসঙ্গে ভাল লেগেছিল, মন খারাপও হয়েছিল, কারণ সেই চরিত্রটা আমি করছি না। এমন একটা সময় ‘স্টার জলসা’ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। বলে, একটা শো করতে হবে। কী শো, কীসের শো– কিছু জানি না, কিন্তু তড়িঘড়ি করে নাকি মিটিংয়ে যেতে হবে। স্টার-এর অফিসে গিয়ে শুনলাম আমাকে ওঁরা কাদম্বিনীর চরিত্র দিতে চায়! আমি প্রায় দু’-তিনবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, কাদম্বিনী? গাঙ্গুলি? ডাক্তার? যেটা হচ্ছে অলরেডি? সেটা!?
আমি যেটা মনে মনে চেয়েছিলাম, যাকে বলে, স্বপ্ন আখেরে সত্যি হওয়া– এটা একেবারে সেই মুহূর্ত! তবে কাজ করতে করতে আমি বুঝতে পেরেছিলাম, এতদিন কাদম্বিনী গাঙ্গুলিকে জেনেছিলাম বাইরে থেকে। কাজ করতে করতে নিজের সত্তা দিয়ে তাঁকে চিনতে পেরেছিলাম। বই পড়ে জানা একরকম, কিন্তু চরিত্র হয়ে বাঁচা তো আলাদা। অভিনেত্রী না হলে, এটা সম্ভব হত কি না, জানি না। সম্ভব করেছিলেন আমাদের টিম। লেখক ও পরিচালক। প্রায় ১০ বছরের রিসার্চ। এবং সবথেকে বড় কথা, দ্বারকানাথ গাঙ্গুলির পরিবারের সদস্যরা আমাদের যারপরনাই সাহায্য করেছিলেন। ওঁদের জন্যই বাস্তব থেকে আমরা সরে যাইনি। সিরিয়ালের প্রতি অনেকেরই ক্ষোভ রয়েছে– অতিরঞ্জনের, তা এক্ষেত্রে ঘটেনি।
কাদম্বিনী করার আগের আমি ও পরের আমির মধ্যেও ঘটে গিয়েছে বদল। নিজে শুধু সমৃদ্ধ হয়েছি, এমনটাই নয়, সম্ভবত একটা মানসিক উত্তরণও ঘটেছে। জীবনের যে ঝড়ঝাপটায় আগাপাশতলা মুষড়ে পড়তাম, সেই পরিস্থিতিতে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পেরেছি।
একটা অদ্ভুত ব্যাপার যে, যে সময়ে আমি কাদম্বিনী হয়েছি, এক চিকিৎসকের চরিত্রে অভিনয় করছি, তখন বিশ্বজোড়া কোভিড। তিনি সে অর্থে কোনও অতিমারীর মুখোমুখি হননি। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সে সময়ে অনেক রোগ নিয়েই যথেষ্ট ছুঁৎমার্গ ছিল, যা পেরিয়ে গিয়েছিলেন কাদম্বিনী। সে ছুঁৎমার্গ যে শুধু রোগ বিষয়ে, তাই নয়, সামাজিক-মানসিকভাবেও তা ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে ছিল। সেই অসুখের ভ্যাকসিন ছিলেন কাদম্বিনী গাঙ্গুলি।
তবে শুধু চিকিৎসকই বা কেন, তাঁর প্রেম নিয়েও কথা বলা উচিত। ১৭ বছরের বড় দ্বারকানাথকে বিয়ে করেছিলেন তিনি, জনশ্রুতি যে, এটাই নাকি বাঙালির প্রথম ‘লাভ ম্যারেজ’। এবং দ্বারকানাথ নিরন্তর তাঁর স্ত্রীর জন্য, যে আত্মপরিচয়ে উজ্জ্বল, তাঁর পাশে রইলেন মাটির প্রদীপের মতো। কিন্তু নিজের লড়াই, নিজেই লড়েছিলেন কাদম্বিনী। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়াটা আমার মনে হয়, ওঁর জীবনে বিরাট একটা ব্যাপার! কারণ, চারপাশে শুধু পুরুষ সহপাঠী। পুরুষ শিক্ষক। চিকিৎসা শাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করতে এসে বিষয়ের বাইরে গিয়ে কত কারণেই যে বেকায়দায় ফেলা হয়েছিল তাঁকে! শৌচালয় ব্যবহার করতে না পারা থেকে ঋতুস্রাবের সময় নানা কুকথাও ছুটে এল তাঁর দিকে। ইচ্ছাকৃতভাবে কতবার যে ফেল করানোও হল। তবু, তিনি অনড়। স্পষ্টবাক। কেউই তো রুখতে পারল না তাঁকে। এই ৫ বছরের মেডিক্যাল কলেজের জীবন ও পড়াশোনা তাঁকে গড়ে তুলেছিল আরও দৃঢ়ভাবে।
কিন্তু এসবের পরও, একথা বলতে বাধ্য হচ্ছি, ওঁকে যতটা জানা বা বোঝা জরুরি ছিল– তার সিকিভাগও এখনও আমরা পড়ে উঠতে, বুঝে উঠতে পারিনি। এ আমাদেরই ব্যর্থতা। সর্বাঙ্গীণ ব্যর্থতা। তাঁকে জানে যে খুব কম মানুষ, তা কাজ করতে করতেই পেয়েছি। তিনি চর্চায় উঠেই আসেননি সেভাবে। এমনকী, এই চরিত্রের জন্য রিসার্চ করতে গিয়ে যখন তাঁর কলেজ বেথুনে যাই, দেখি যে চন্দ্রমুখী বসুর শংসাপত্র থাকলেও, তাঁর শংসাপত্র সেখানে মজুত নেই। সারা গুগ্ল খুঁজেও কাদম্বিনী গাঙ্গুলির দুটোর বেশি ছবি পাইনি। এখনও পাওয়া যায় না।
১৮৬১ সালে যে মেয়েটি জন্মেছিলেন, সময়ের থেকে যিনি এগিয়ে, তাঁকে বাংলার নারীকুল এভাবে পাওয়া সত্ত্বেও, নারীদের হালবদল তেমন দ্রুততায় ঘটল না। এটা আক্ষেপের বটে। ১৮৮০ সালের আশপাশে তাঁর সহপাঠী ও শিক্ষকদের সামনে তিনি নির্দ্বিধায় কথা বলেছেন ঋতুস্রাব নিয়ে। হাজার বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও পরীক্ষায় প্রথম হওয়ায় কেউ আটকাতে পারেনি তাঁকে। এমনকী, ওঁকে সার্জারি করতে দেওয়া হবে না– তা বুঝতে পারায় ৯ সন্তানকে ছেড়ে তিনি চলে গিয়েছিলেন লন্ডনে, নিজের কেরিয়ার গড়ে তুলতে। সেই স্থিতধী, লক্ষ্যে অবিচল যে ঝড়ের মেয়ে, পরবর্তীকালে সেই ঝড়ের ব্যাটন আরও বেশি করে আমাদের হাতে এসে পড়া উচিত ছিল। কিন্তু, দুর্ভাগ্যবশত তা হয়নি। কাদম্বিনী তাতে অবশ্য হারেননি।
আজও, নানা ক্ষেত্রে কাদম্বিনীরা জন্ম নিচ্ছেন– এ আমার বিশ্বাস। হয়তো, তাঁরা সামনে আসছেন না। কোনও একদিন আবারও লেখা হবে, ‘ঝড়ের মেয়ে’ এই বিশেষণ দিয়ে অন্য কোনও কাদম্বিনীর নাম। তিনি তো নামটুকু শুধু নন, আসলে চরিত্র। তাঁর মৃত্যুশতবর্ষে আমার প্রণাম।