কথিত আছে, ভালো বা মন্দ– যে যেমন চায়, কল্পতরু তাকে তাইই দেয়। কিন্তু খতিয়ে দেখলে, শ্রীরামকৃষ্ণ কি তেমনটাই করেছিলেন ওইদিন? ঠিক তা নয়। আমরা কিছু না চাইতেই সেইদিন শ্রীরামকৃষ্ণ উচ্চারণ করেছিলেন– ‘তোমাদের চৈতন্য হউক।’ শুধু উচ্চারণ করেননি, প্রার্থনা করেছিলেন– নিজের জন্য নয়, আমাদের সকলের জন্য। হয়তো বা এর মধ্য দিয়ে তিনি আসলে আমাদের আগামীর জন্য প্রার্থনা করতেই শেখাচ্ছিলেন।
বেশ কিছুকাল হল, শহর কলকাতায় আর তেমন আকাশে বাতাসে ঠান্ডা পড়ে না। নভেম্বরের শেষে কনফেকশনারিজের র্যাকে ভিড় করে আসা নতুন স্বাদের কেকের ছোটবড় বাক্সের ভিড়ে আমাদের শীত লুকোনো থাকে। পুজোর তুলনায় কিছুটা কম হলেও, সন্ধে পেরলে রাস্তাঘাটে ছিমছাম, সম্ভ্রান্ত আলো জ্বলে থাকে উৎসবের; হিমের পরশ গায়ে লাগে অমনি। পথচলতি দুপুরে দেখা যায়, হগ মার্কেটের বাইরে ভুটিয়ারা বসেছেন মোটা পশমি টুপি আর সোয়েটার সাজিয়ে; গাঢ় হয়ে ওঠে শীত। এমন ঘটলে, স্মৃতিরা আজও লাইন দেয় নাহুমে, পরিযায়ী পাখির মতো দেশে-ফেরা বন্ধুর ফোন আসে দৈবাৎ– ‘ফাঁকা নাকি?’, আর অসময়ের ধোঁয়াটে-কমলা গোধূলি শহরের রূপরেখা গিলে খেতে খেতে জানিয়ে যায়– এসবই বড় ক্ষণিকের, পালাই-পালাই। অগত্যা বছর ফুরনোর মুখে আমরা সবাই-ই একান্ত নিভৃতে করজোড় করি যার যার ব্যক্তিগত যিশুর কাছে; বোঝাপড়া করে নিতে চাই এ বছরের প্রাপ্তিগুলো, সাজাতে চাই আগামীর চাওয়ার ফিরিস্তি।
তবে শুধুই কি প্রাপ্তি? আমাদের প্রাত্যহিক হেরে যাওয়া আছে কিছু। না-পারা আছে। ভয় আছে, ক্ষয় আছে। এসবের মুখোমুখি যে এক অসহায়তা, সে-ও আছে। পীড়িত কারও হাতে খাবার তুলে দিতে গিয়ে বোঝা, আসলে সে আশ্রয় চায়, এবং বুঝে, কিছু না করতে পারার যে গ্লানি, আছে। প্রতিটা মৃত্যুসংবাদে নিজেকে অপরাধী মনে হওয়ার অনিবার্যতা আছে। বেঁচে থেকে, প্রয়াতের সন্তানের সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর যে গভীর কুণ্ঠা, আছে। সারাদিন ধরে নিজের নিজের সমূহ যন্ত্রণা কপচে, মনে মনে জানা যে এর চেয়ে শতসহস্রগুণ তীব্র দুঃখে-শোকেও মানুষ মহীরূহ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আর তার পদপ্রান্তে নতুন জীবন ফোটে ঘাসফুল হয়ে– জেনে, লজ্জিত হওয়াও আছে। আর সবশেষে হয়তো আছে এক পরিণতির বোধ– বছরভর যতই বাকেট লিস্ট তৈরি করে ডিসেম্বরের শেষ হপ্তায় সেইসব থেকে গোণাগুনতি প্রাপ্তিতে মাত্রা বসাই না কেন, বৎসরান্তে আসল কাঁটা হয়ে থেকে যায় অন্তরালের শূন্যতা, পরোক্ষ বেহিসেব, গরমিলগুলো। সেই লুকিয়ে রাখা ক্ষতস্থানে, বিষাদে পৌঁছবে কোন আলাদিনের জিনি? অন্ধজনে কে দেবে আলো? মৃতজনে কে দেবে প্রাণ?
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
পৃথিবীর হৃদযন্ত্রটি হাপরের মতো উঠছে আর পড়ছে– প্রাপ্তির দম্ভ কেন্দ্রাতিগ আগুনের ফুলকির মতো ছিটকে বেরচ্ছে, অপ্রাপ্তির আঁধার কেন্দ্রানুগ অতিথি হয়ে দরজায় এসে দাঁড়াচ্ছে। এসবের মাঝে ফি-বছরে এই ছোট্ট ‘আমি’টাকে ঘিরে আমোদ-আহ্লাদ করতে চাওয়া কেমন বিবর্ণ শীতের মতো লাগে না?
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
কাজেই, ওই যে শুরুতে বলছিলাম, হয়তো বা আমরা সকলেই করজোড়ে যিশুর কাছে চাওয়া-পাওয়ার হিসেবটুকু বুঝে নিই বছরের শেষে– সেও পুরোপুরি সত্যি নয়। বহুবিধ অপ্রাপ্তি ভাঁড়ারে জ্বলজ্বল করে একটিই অমোঘ প্রশ্ন– কী চাইলে সকল আশ মিটবে?
চাওয়া তো কোনও সরলরৈখিক লং ড্রাইভ নয়; না আমরাও কোনও ‘হোমোজেনাস মাস্’! ইয়েস, মাই ডিয়ার হোরেশিও! কতকিছু চাওয়ার আছে যা আমি-তুমি জানি না, কত মানুষ যে কী না কী চাইছে, আমরা বুঝছিই না। ব্রহ্মাণ্ডের আনখশির চেয়ে বসে আছে মানুষ– কেউ চাইছে ভিনগ্রহে প্রাণের স্পর্শ, কেউ ছড়িয়ে যেতে চাইছে অসীম মহাশূন্যে, কেউ ডুব দিচ্ছে জলের তলায়, অপোগন্ড এই গ্রহের প্লেটে প্লেটে যে ঠোকাঠুকি লেগেই চলেছে, মেপে দেখতে চাইছে সেই সব। সর্বগ্রাসী পুঁজিপতি গিলে খেতে চাইছে আরও সবুজ; ধূর্ত নেতা চাইছে ভোটবাক্স আর কাটমানির একচ্ছত্র অধিকার। আর এইসব বৈভব ও পরাক্রমের পর্দা সরিয়ে দেখলে, আরও কত অযুত-নিযুত মানুষ আজও চাইছেন রুটি, পানীয় জল, মাথার উপর ছাদ, লজ্জা ঢাকার বস্ত্রখণ্ড, চাকরি, সমানাধিকার, সম্মান, যুদ্ধের অবসান। কতটুকুর খবর রাখছি আমরা?
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: দেশ সেকুলার তবু শেষকৃত্য সেকুলার নয়
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
পৃথিবীর হৃদযন্ত্রটি হাপরের মতো উঠছে আর পড়ছে– প্রাপ্তির দম্ভ কেন্দ্রাতিগ আগুনের ফুলকির মতো ছিটকে বেরচ্ছে, অপ্রাপ্তির আঁধার কেন্দ্রানুগ অতিথি হয়ে দরজায় এসে দাঁড়াচ্ছে। এসবের মাঝে ফি-বছরে এই ছোট্ট ‘আমি’টাকে ঘিরে আমোদ-আহ্লাদ করতে চাওয়া কেমন বিবর্ণ শীতের মতো লাগে না? যে শীতে আলো নেই, যিশু নেই, নতুনের আগমনি নেই? বরং চাওয়ার আড়ালে লুকিয়ে থাকে অন্যের দারিদ্র্যকামনা। আমাদের এই ‘আমি’ চেয়েছে তো অনেক কিছুই, পাওয়ার হিসেবও নিতান্ত মন্দ নয়। তবু, এই যে নতুন বছরের মুখে প্রতিবার এত-এত না-পাওয়া দেখি, তার কারণ কি এইই যে আমি চেয়েছি বটে, কিন্তু সবার জন্য চাইতে পারিনি? আমি পেয়েছি ঠিকই, কিন্তু তাতে হাসি সবার মুখে ফোটেনি। তাই কি আমি ভালো নেই? চাইব আমি, কিন্তু ভরবে সকলের ভাঁড়ার– এমন কল্পতরু কি আসবেন আমার সামনে? এসে বলবেন, ‘তথাস্তু’?
কল্পতরু! এ কথাটা যে-ই না মনে আসা, চোখের সামনে কালির ছাপে গড়ে ওঠে অনেকদিন আগেকার একটা ছবি। নতুন ইংরেজি বছরের প্রথম দিন; গঙ্গার ধারে উত্তর কলকাতার এক বাগানবাড়ি। তখনও এমন কমলা গোধূলি নেমে আসত আগেভাগে, ধোঁয়ার ভাগ কিছুটা কম ছিল তাতে অবশ্য। তেমনই এক বিকেলে, রোগশয্যা থেকে উঠে এসে সেই বাগানে দাঁড়িয়েছেন শীর্ণ, কোমল এক মানুষ। মাথায় কানঢাকা গরম টুপি, গায়ে চাদর। গলায় তাঁর ক্যান্সার, তাই বাক্যালাপ প্রায় বন্ধ। তবু, সেখানে উপস্থিত আর সকলের উদ্দেশ্যে সেই বিকেলে তাঁর কথা ছিল এটুকুই– ‘তোমাদের চৈতন্য হউক।’ সেই থেকে শ্রীরামকৃষ্ণের স্নেহধন্য ভক্তেরা তাঁর এই ভাবটির নাম দেন ‘কল্পতরু’– আজ অবধি ইংরাজি বছরের প্রথম দিন আর কল্পতরু উৎসব তাই মিলেমিশে এক হয়ে যায় কোথাও। আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতা, জৌলুসময় ইংরাজি নববর্ষ ও সংলগ্ন কামনার সঙ্গে আশ্চর্যভাবে এক সিম্ফনি তৈরি করে পশ্চিমী-মডেলে গড়ে ওঠা এক শহরের বুকে দাঁড়িয়ে গ্রামবাংলার এক ‘মেঠো বামুনের’ জীবনের শেষ আশীর্বাণী।
কথিত আছে, ভালো বা মন্দ– যে যেমন চায়, কল্পতরু তাকে তাইই দেয়। কিন্তু খতিয়ে দেখলে, শ্রীরামকৃষ্ণ কি তেমনটাই করেছিলেন ওইদিন? ঠিক তা নয়। আমরা কিছু না চাইতেই সেইদিন শ্রীরামকৃষ্ণ উচ্চারণ করেছিলেন– ‘তোমাদের চৈতন্য হউক।’ শুধু উচ্চারণ করেননি, প্রার্থনা করেছিলেন– নিজের জন্য নয়, আমাদের সকলের জন্য। হয়তো বা এর মধ্য দিয়ে তিনি আসলে আমাদের আগামীর জন্য প্রার্থনা করতেই শেখাচ্ছিলেন। কেবল চাইলেই তো হয় না; সেও এক অভ্যাস, চর্চা, অধ্যবসায়। ঠিক ঠিক চাইতে পারলে, ক্ষুদ্র, স্বার্থবুদ্ধি-ঘেরা ‘আমি’টাকে চেতনার মহাসাগরে ভাসিয়ে দিতে পারলে, ‘বহু’র মধ্যে নিজেকে খুঁজে পেলে, যৎসামান্য চাওয়াও প্রার্থনা হয়ে ওঠে– একজন চাইলে, সহস্র জীবনে লক্ষ্মীশ্রী আসে। নিষ্কলুষ, নিঃস্বার্থ শুভাকাঙ্খা প্রদানে মানুষই হয়ে ওঠে কল্পতরু তখন।
নতুন বছরের মুখে তাই মাথার ভিতর থাকুক গিরিশ ঘোষের শব্দস্ফুলিঙ্গ– “কর হে চেতন, কে আছ চেতন,/ কতদিনে আর ভাঙিবে স্বপন?/ কে আছ চেতন ঘুমায়ো না আর,/ দারুণ এ-ঘোর নিবিড় আঁধার।” বয়স বাড়ে, বাইরের গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ-শীতকে নিজেরই ভিতরের নির্জন ঠিকানা বলে বোধ হয়; সময় চলে যায়, নতুন পুরোনো হয়, পুরনো নতুনে পা রাখে। অনন্ত রাধার মায়ায় ফুল ফোটে-বাড়ে-ঝরে, আকাশে তারা ওঠে, খসে পড়ে যায়, আর দেখতে দেখতে কী যেন একটা কেঁপে ওঠে মনে, অথচ স্পষ্ট বুঝি না– এ আসলে আমার-তোমার একজীবনেরই বাঁচা-মরার গল্প– আমাদের ওয়ার্ল্ড ম্যাপের পাতায় ধরা না পড়া দূরের গল্পগুলো ঘরের কথা হয়ে ওঠে। আবহে কেবল বেজে চলে মহাকবির সেই আকুতিময় ডাক– হে মানুষ, চেতন হও। পান্না সবুজ হয়, সেও চেতনারই রঙে; আর তাতে মানুষের মুখে হাসি ফুটবে না? কষ্ট একটু হলেও লাঘব হবে না? যুদ্ধের মেয়াদ একবেলা হলেও কমবে না?
সূর্য না হয় না-ই হতে পারলাম, যেন জোনাকি হয়ে বাঁচি, হোরেশিও! গ্রীষ্মে যেন ছায়াসুশীতল আশ্রয় হতে পারি, শীতে যেন মোটা চাদরের ওম হতে পারি। মানুষের আশ্রয় ও অভিসার– যুগপৎ যেন হয়ে উঠি। এ বছর বাহ্যসম্পদ নয়, আত্মসম্পদে যেন বলীয়ান হই আমরা।
চাওয়াগুলোকে প্রার্থনায় বদলে দিয়ে দেখাই যাক না, কী হয়! একবছরের তো ব্যাপার। না মিললে আবার সব তোলপাড় করে দেওয়া যাবে সামনের শীতে।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved