আদৌ কোনও প্রথাগত বিদ্যা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি ছিল না কমলকুমারের। তা সত্ত্বেও আধুনিক গণিতশাস্ত্রের মত এক জটিল বিষয়কে তিনি পত্রিকার বিষয় নির্বাচন করেছিলেন, ভাবলে অবাকই হতে হয়। রেনেসাঁ যুগের মানুষের মতো তাঁর ছিল বিচিত্র বিষয়ে অনায়াস যাতায়াত।
‘সাহিত্যিকরা যখন লেখে, তখন তাদের মাথায় হিসেব থাকে না যে, কী লিখছি। কিন্তু অঙ্কটা শিখলে তাদের মাথায় লেখার ব্যাপারে দায়িত্ববোধ হবে, হিসেব থাকবে যে কী লিখতে হবে, কতটা লিখতে হবে, এটা বেশি হবে না, এটা পৌনঃপুনিকতা হয়ে যাবে। এর জন্যই অঙ্ক শেখা দরকার লেখকের।’
ইন্দ্রনাথ মজুমদার ছিলেন তৎকালীন কলকাতার গুরুত্বপূর্ণ পুরনো বইয়ের দোকান ‘সুবর্ণরেখা’র কর্ণধার এবং প্রবাদপ্রতিম সংগ্রাহক– যাঁকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলতেন, কলেজ স্ট্রিটের মটরু মিয়া। তিনি একটা সময়ের পর থেকে নিঃসন্তান কমলকুমার মজুমদারের সন্তানসম ও ঘনিষ্ঠ সহচর হয়ে ওঠেন। একান্ত কথোপকথনে একবার ইন্দ্রনাথ অধ্যাপক নারায়ণচন্দ্র ঘোষকে কমলকুমারের বলা প্রাগুক্ত কথাগুলি জানান। ‘অঙ্ক ভাবনা’ পত্রিকার জন্ম যে কমলকুমারের ওই ভাবনা থেকেই, তা বোঝা যায়।
১৯৬৫ সাল। কমলকুমার কী না করছেন তখন! তাঁর সমগ্র শিল্পীজীবনটি ছিল এককথায় রঙিন, বর্ণময়। জীবনের প্রথম দিকে একটা সময় পর্যন্ত কোনও একটি বিষয়ে তিনি স্থির থাকেননি। কাঠখোদাই করছেন, গয়নার ডিজাইন করছেন, গ্রামগঞ্জ ঘুরে লোকশিল্প সংগ্রহ করছেন, অবশ্যই ছবি এঁকেছেন, উচ্চাঙ্গ সংগীতের তালিম নিয়েছেন, কবিতা লিখেছেন। নাটকের দল গড়ে নাটক করছেন, ‘চলচ্চিত্র ভাবনা’ করছেন, চিত্রনাট্য লিখছেন আবার একটা সময় গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য নেমেছেন বিচিত্র সব ব্যবসায়! জীবিকার তাড়নায় কিউরিও সংগ্রহেও তাঁকে নামতে হয়েছে। অবাকই হতে হয়, যখন দেখা গেল এসবের পাশাপাশি সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে সরে গিয়ে দু’টি বিচিত্র বিষয়ের পত্রিকার সম্পাদনাও করলেন। ‘তদন্ত’ আর ‘অঙ্ক ভাবনা’।
‘অঙ্ক ভাবনা’র নামকরণ নাকি করেছিলেন ‘এক্ষণ’ পত্রিকার সম্পাদক নির্মাল্য আচার্য। সম্পাদনা যুগ্মভাবে। কমলকুমার মজুমদার ও আনন্দময় ঘোষ। অঙ্কশাস্ত্র সম্বন্ধীয় এই ত্রৈমাসিক পত্রিকার প্রথম কার্যালয় ছিল ১৬, ম্যান্ডেভিল গারডেন্স, কলকাতা- ১৯। প্রথম সংখ্যার প্রকাশ ১৯৬৫ সালের জানুয়ারিতে । ওই বছরেই নিয়ম মেনে ঠিক সময়ে দ্বিতীয় সংখ্যা প্রকাশিত হয় এপ্রিল-জুন মাসে। সেই সঙ্গে ঘোষণাও হল কার্যালয়ের স্থান পরিবর্তন করে– ৭৭/১, মহাত্মা গান্ধী রোড, কলকাতা- ৯। শোনা যায়, বিশিষ্ট শিল্পী শুভাপ্রসন্নর সহায়তা ছিল এই নতুন কার্যালয় সন্ধানে। আর আমরা প্রত্যেকেই এটা জানি, ৭৩, মহাত্মা গান্ধী রোডের দ্বিতলে ‘সুবর্ণরেখা’য় ছিল ‘এক্ষণ’-এরও কার্যালয়। ‘সুবর্ণরেখা’ তখন শুধু নিছক একটি পুরনো বইয়ের দোকান নয়, সাহিত্য শিল্প ও সংস্কৃতির ক্লাসিক্যাল আড্ডা ও বিচিত্র স্তরের ভাবনাচিন্তার আদানপ্রদানের মিলনস্থল। সম্ভবত ইন্দ্রনাথ মজুমদারের মাধ্যমেই পদার্থবিদ আনন্দময় ঘোষ যুক্ত হন এই পত্রিকার সঙ্গে। ‘অঙ্ক ভাবনা’র প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হল শুধু নয়, প্রকাশমাত্রই গণিত বিশেষজ্ঞরা সেই সময় এই পত্রিকাকে ইংরেজি, হিন্দি, বাংলায় প্রকাশিত গণিত বিষয়ক পত্রিকার ‘সেরা’ পত্রিকার আখ্যা দিলেন।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
জীবনের প্রথম দিকে একটা সময় পর্যন্ত কোনও একটি বিষয়ে স্থির থাকেননি কমলকুমার। কাঠখোদাই করছেন, গহনার ডিজাইন করছেন, গ্রামগঞ্জ ঘুরে লোকশিল্প সংগ্রহ করছেন, অবশ্যই ছবি এঁকেছেন, উচ্চাঙ্গ সংগীতের তালিম নিয়েছেন, কবিতা লিখেছেন। নাটকের দল গড়ে নাটক করছেন, চলচ্চিত্র ভাবনা করছেন, চিত্রনাট্য লিখছেন আবার একটা সময় গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য নেমেছেন বিচিত্র সব ব্যবসায়। জীবিকার তাড়নায় কিউরিও সংগ্রহেও তাঁকে নামতে হয়েছে। অবাকই হতে হয়, যখন দেখা গেল এসবের পাশাপাশি সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে সরে গিয়ে দুটি বিচিত্র বিষয়ের পত্রিকার সম্পাদনাও করলেন। ‘তদন্ত’ আর ‘অঙ্ক ভাবনা’।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
কমলকুমার এর ভাষায় পত্রিকার উদ্দেশ্য ছিল এইরকম:
“অঙ্কশাস্ত্র জিজ্ঞাসু পাঠক বর্গকে অঙ্কধারা সম্পর্কে জ্ঞাত করা– কারণ ইতিহাস জানার মূল্য আমরা নিশ্চয় সকলেই স্বীকার করিব– ইহা ব্যতীত আমাদের পাঠ্যক্রম যাহাতে অত্যন্ত আধুনিক নিয়ম অনুযায়ী হয় তাহার আভাস দেওয়া। এই সংখ্যায় সেইজন্য আমরা ‘বিমান গতিবিধির অঙ্ক’ বিষয়ে আলোচনা করছিলাম।”
আদৌ কোনও প্রথাগত বিদ্যা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি ছিল না কমলকুমারের। তা সত্ত্বেও আধুনিক গণিতশাস্ত্রের মত এক জটিল বিষয়কে তিনি পত্রিকার বিষয় নির্বাচন করেছিলেন, ভাবলে অবাকই হতে হয়! রেনেসাঁ যুগের মানুষের মতো তাঁর ছিল বিচিত্র বিষয়ে অনায়াস যাতায়াত। রামানুজনম কথিত ‘সংখ্যা আমার ভাই’ শিরোনামে একটি লেখায় কমলকুমার লিখেছেন ‘অঙ্ক পৃথিবীর সর্বত্র আছে। আলোতে এবং অন্ধকারে মিশাইয়া বিশেষ তাহার রূপ, জীব জীবনে স্থাবরে সকল কিছুতেই অঙ্কের সৌন্দর্য, অঙ্কের অক্ষর সত্য বর্তমান। এবং উপরে গম্ভীর আকাশেও তাহা ওতোপ্রোত।’
লীলাবতীর অনুবাদ, বিমান গতিবিধির অঙ্ক, ইউক্লিডীয় জ্যামিতি, ন্যায়তত্ত্ব, বীজগণিতের ইতিকথা– এসব ছিল প্রথম সংখ্যার সূচি। আর প্রাচীন মিশরীয় পরিমাপের বাটখারা দিয়ে প্রচ্ছদ-চিত্র এখনও যেন আমাদের চোখে ভাসে। অনুরূপভাবে, দ্বিতীয় সংখ্যার সূচিতেও ছিল ভাবগম্ভীর বিষয়। আর্কিমিডিসের পাটিগণিত, দশমিকের রহস্য, ত্রিমাত্রিক আয়তন। আঁরি পাওয়াকার-এ কৃত সায়েন্স ও হাইপোথিসিস থেকে অনুবাদ তিনি নিজে করেছিলেন এই সংখ্যায়। আরও অনেকের সঙ্গে তরুণ দুই কবি– সুব্রত চক্রবর্তী (পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক) ও বেলাল চৌধুরীকেও এই পত্রিকার অনুবাদ কাজে যুক্ত করেছিলেন তিনি। দুঃখের বিষয়, দু’টি সংখ্যা প্রকাশের পর ‘অঙ্ক ভাবনা’ বন্ধ হয়ে যায়। তার কারণ অবশ্য জানা যায় না।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: আলো ক্রমে আসিতেছে: কমলকুমারের কাঠখোদাই ছবি
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
তথ্য কিন্তু বলছে, কমলকুমারের এই গণিত-প্রীতি তাঁর সঙ্গে-সঙ্গেই সর্বদা থাকত। তিনি তাঁর লেখার তত্ত্বের কথা বলতে গিয়েও বলেছেন, ‘আমি নিজে জ্যামিতির অনুগ্রাহী বা আমি ঠিক এনালিটিক কিউবিজমের পক্ষপাতী নই। এখানে টেনশনে রেখা সকল যতক্ষণ না সৃষ্টি হচ্ছে (অনেকটা টিম্বারের মত অথচ এগুলিকে অনেকে ইমেজ বলেন) ততক্ষণ গল্প হয় নাই বলিয়া আমার ধারণা–’। আরও জানা যায়, এসবের অনেক পরে ১৯৭৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ‘ক্যালকাটা ম্যাথামেটিক্যাল সোসাইটি’ যে কনভেনশনের আয়োজন করেছিল, সেখানে কমলকুমার এক জ্ঞানগর্ভ ভাষণ দিয়েছিলেন। ভারতবর্ষে গণিতের প্রশিক্ষণ ও গবেষণা ছিল তাঁর বলার বিষয়।
কমলকুমার বলতেন, ‘লেখা আমি দুর্বোধ্য করি না– এত সরল যে তাহা দুর্বোধ্য হইয়া যায়। তবে আমি বৈদিক অন্তত ব্রাহ্মণ্য সরলতা ভালবাসি।’
ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতা মনে পড়ে।
দারিদ্রে লালিত, আজন্ম বস্তুসুখে বঞ্চিত মেয়েটি যেন এক আশ্চর্যময়ী। সে দুয়ারের ভিখারিকে ভিক্ষা দেয় পিছনপানে সংকটের দিকে তাকাতে তাকাতে, মৃদু ভীত, অপারগ, যে সমস্যাগুলি সে এখনও পুরোপুরি বোঝে না, তাকে বুঝছে কিন্তু বুঝছে না... পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে ভাইয়ের গুরুত্ব বেশি সে জানে।