তাঁর ডাক এলেই চলে যেতাম তাঁর আদরের শান্তিনিকেতনের বাড়িতে। কত কত কথার ফাঁকে শুনেছি তাঁর সবচেয়ে আদরের ধন রবীন্দ্রনাথের কথা, গান গাওয়ার সময় কোথায় যে হারিয়ে যেতেন, মনে হত কোন এক সুদূর পারে বসে সাধনার আসনটি পেতে বসে আছেন কবির জন্য। কখনও কখনও বলতেন: ‘কী হে কবি গান শোনাও একটা।’ কত ভুল শুধরে দিতেন, কত অজানার পথে হাত ধরে এগিয়ে দিতেন আমাদের। কখনও কখনও সঙ্গ পেতাম বিক্রমের। বিক্রমের গান আমাদের সবার প্রিয়। কখনও কখনও কবিতা পাঠে গড়িয়ে যেত বেলা।
কবিদের সঙ্গে আমার ভাব খুব ছোট থেকেই, বলেছিলেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর সেই সূত্র ধরেই কবিদের সঙ্গে তাঁর ভিন্ন একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। রবীন্দ্রনাথ থেকে সেই সংযোগ শুরু হয়, আর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেই সংযোগে তিনি গড়ে তুলেছিলেন ভিন্ন এক মন। যাকে আমরা ‘কবি-মন’ বলি, অনেকটা সেইরকম। তাঁর মনের একটা বড় অংশ জুড়ে ছিল শান্তিনিকেতনের প্রকৃতি। রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথের গান আর এই প্রকৃতিই তো তাঁর গানের অনেকটা অংশ জুড়ে রয়েছে। আমরা যদি তাঁর গান শুনি, তাহলে বুঝতে পারব রবীন্দ্রনাথের প্রেম কী অসম্ভব, সেই জগৎ যা প্রাণাধিক। মনে হয় চুপ করে সেই অনন্ত গানের স্রোতে ভেসে যাই। মনের নিচু মহলে যখন অনবরত বয়ে চলে ভিন্ন এক প্রাণের ধারা। মনে কি হয় না যখন আমরা তাঁর গানের মধ্যে পেয়ে যাই রবীন্দ্রনাথের ভিন্ন এক অভিপ্রায়? কী সেই অভিপ্রায় ?
তিনি নিজেই বলেছিলেন সে-কথা। ‘‘আমি যখন রবীন্দ্রনাথের গান গাই তখন এই জগতের সবকিছুই ভুলে যাই, এ-‘আমি’ সেই তাঁর সঙ্গে গাওয়া থেকে শুরু করে আজও। আজও মনে হয় এই তো তিনি বসে শুনছেন আমার গান, হয়তো গানের শেষে কিছু বলবেন।’’ মনের শেষ তল পর্যন্ত যাঁর যাওয়া-আসা, তিনি তো কবিই। আর কবিদের এই যাওয়া-আসা আমার বড় আদরের। আমি বুঝতে পারি এ-আমার সবকিছুর মধ্যে শ্রেষ্ঠ পাওয়া। জীবনে ওই একজনই পাওয়া। কবির সঙ্গ। একবার কথার ফাঁকে বলেছিলেন ওই একই প্রসঙ্গে ‘অমন করে কে বলবে বলো জীবনের সঙ্গে লগ্ন হয়ে থাকার কথা, তাঁর গানের কাছে বসে আমাদের জীবনের কত অচেনা দুর্গম পথের সন্ধান যে পেয়েছি তার আর শেষ নেই… কত অভিমান ভেঙে গেছে… কত অভিজ্ঞতার পথে আলো হয়ে বন্ধুর মতো দাঁড়িয়ে আছেন গুরুদেব। সেই পথে এগিয়ে গিয়েছি তাঁরই হাত ধরে… যা পেয়েছি কুড়িয়ে নিয়েছি…’
মনে পড়ে তাঁর ডাক এলেই চলে যেতাম তাঁর আদরের শান্তিনিকেতনের বাড়িতে। কত কত কথার ফাঁকে শুনেছি তাঁর সবচেয়ে আদরের ধন রবীন্দ্রনাথের কথা, গান গাওয়ার সময় কোথায় যে হারিয়ে যেতেন, মনে হত কোন এক সুদূর পারে বসে সাধনার আসনটি পেতে বসে আছেন কবির জন্য। কখনও কখনও বলতেন: ‘কী হে কবি গান শোনাও একটা।’ কত ভুল শুধরে দিতেন, কত অজানার পথে হাত ধরে এগিয়ে দিতেন আমাদের। কখনও কখনও সঙ্গ পেতাম বিক্রমের। বিক্রমের গান আমাদের সবার প্রিয়। কখনও কখনও কবিতা পাঠে গড়িয়ে যেত বেলা।
তোমায় নতুন করে পাব বলে হারায় ক্ষণে ক্ষণ
কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, এ-কথা যে কত সত্যি এখন বুঝতে পারি। এই যে হারিয়ে ফেলি, তা নতুন করে পাব বলে… একবার ভাবো তো কত বড় কথা অথচ কত সহজ করে গুরুদেব বলেছেন তা… জীবনের শেষে এসে এই কথাগুলো… আমার জীবন দিয়ে বুঝেছি। আমাদের সহজ জীবনের মূল্য, এই মূল্য কে দেবে ? দেবে জীবনই, জীবনের মাঝে একটা অন্য আরেকজন আছেন, তিনিই তো বোঝেন জীবন মানে তা সমগ্র মানব জাতির প্রবাহ। আজও আমার আকর্ষণ এই যে প্রকৃতি, তার কাছে গিয়ে চুপ করে বসে থাকা। এ হল জীবনের সমগ্রকে অনুভব করার একটা সত্তা। এখানে কোনও দুঃখ নেই। আমি এখন মনে মনে সেই প্রকৃতির কাছে বসে থাকি। কত অজানারে জানায়ে যায় কত গভীরে গিয়ে খুঁজে পায় আপনারে– এ কখনও ব্যাখ্যা করা যায় না। নিজের আমি জেগে থাকলেই উপলব্ধি হয়। এর পরেও আমাদের রবীন্দ্রনাথই প্রয়োজন।
সমুখে শান্তি পারাবার
জীবনের শেষদিকে একবার ডেকে পাঠালেন । সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ফোন করে জানিয়েছিলেন সে-কথা। যখনই শান্তিনিকেতনের পঁয়তাল্লিশ মোড়ের কাছে যেতাম, তার আগে সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি হয়ে তারপর কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে যেতাম। সেবারও গেলাম, কিন্তু অনেক দিন পর। সোমেন্দ্রনাথ তাঁর বাড়ির বারান্দায় বসে আছেন স্থির হয়ে। বললাম কিছু হয়েছে? এমন মুখখানা যে ! মাসিমা বললেন, ‘মোহর ভাল নেই । যাও দেখা করে এসো।’ দ্রুত অস্থির মনে তাঁর বাড়ির গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই সামনের দরজা খুলে গেল। চোখের সামনে, দেখলাম কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে স্ট্রেচারে করে নিয়ে আসা হচ্ছে। আমি স্থির হয়ে শুধু দেখলাম । হঠাৎ আমার সামনে এসে দাঁড়াল একটা অ্যাম্বুল্যান্স। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সেই অ্যাম্বুল্যান্সে তোলা হল আর নিমেষে ধুলো উড়িয়ে চলে গেল তা।
ভাবিনি আর কোনও দিন দেখা হবে না তাঁর সঙ্গে।