আমার ১১ বছর বয়সে বাবা মারা যান। তখন আমার মায়েরও বয়স খুবই কম। সামাজিক নিয়ম মেনে আমার মা সাদা শাড়ি পরতে শুরু করেন। একদিন দেখি, দুপুরবেলা আমাদের বাড়ির সামনে একটা রিকশা এসে দাঁড়াল। সেই রিকশা থেকে নামলেন মোহরদি। মোহরদি আমার মায়ের হাতে দু’টি রঙিন শাড়ি দিয়ে বললেন, আজ থেকে তুমি আর সাদা শাড়ি পরবে না।
আজ মোহরদির জন্মশতবর্ষ। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় আমারও ‘মোহরদি’ আমার মায়েরও ‘মোহরদি’। এত সাদাসিধেভাবে শান্তিনিকেতনে থাকতেন, এত সহজভাবে মেলামেশা করতেন, আমরা ছোটবেলায় হয়তো বুঝেও উঠতে পারিনি তিনি কত বড় মাপের মানুষ। তা বোঝার মতো বয়স আমাদের ছিল না, সেই দূরত্বটুকুও ছিল না।
কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় এমন একজন মানুষ, যাঁর দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। অমন মমতাময়ী চেহারা, অসম্ভব সুন্দর দেখতে। এই ছিল কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে আমার প্রথম ধারণা। এরপর নানা সময়ে পাঠভবনের ছাত্রী হিসাবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য গান শেখার সুযোগ হয়েছে। কখনও গাছতলায়, কখনও ঘণ্টাতলায়। ছোটদের গান শিখিয়েছেন তিনি বহু সময়। তিনি যখন গান শেখাতেন, অনায়াসে তাঁর পাশে গিয়ে বসতাম। পাশে বসে থেকেই কত কিছু শিখেছি। তিনি হয়তো কখনও বড়দের ক্লাস নিচ্ছেন, আমরা পাশে বসে শুনছি। এই সহজ-সরল যাতায়াতটা কিন্তু তখন খুব স্বাভাবিক ছিল।
এরপর যখন পাঠভবনের ছাত্রী হিসাবে উঁচু ক্লাসে উঠলাম, একটু-আধটু অনুষ্ঠানে গাওয়া শুরু করলাম, সিনিয়রদের অ্যাসিস্ট করার সুযোগ পেলাম, তখন দেখতাম মহড়ায় মোহরদি ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। দাঁড়িয়ে থাকতেন নীলিমা সেন, মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো শিল্পীও। বরিষ্ঠ শিল্পীরাও মনোযোগ দিয়ে ছোটদের রিহার্সাল শুনতেন, এবং শুধরে দিতেন। এঁদের সঙ্গে অবশ্যই নাম করতে হয় অশেষ বন্দ্যোপাধ্যায়, অনাদি দত্ত-র। অশেষ বন্দ্যোপাধ্যায়, যাঁর বিশ্বজোড়া নাম, তিনি আমাদের সঙ্গে বসে এসরাজে সঙ্গত করতেন। এই সরল দিনযাপনের মধ্য দিয়েই আমরা এমন বড় মাপের মানুষদের সঙ্গ পেয়েছি। আমরা যে কত সৌভাগ্যবান, সেটা তখন বুঝিনি। আজ বুঝতে পারি।
আমার মা-কে খুব স্নেহ করতেন মোহরদি। একটা শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল দু’জনের মধ্যে। শুধুমাত্র গানেই সেটা সীমাবদ্ধ ছিল না। কারণ আমার মা গানের শিল্পী নন, কিন্তু তৎকালীন শান্তিনিকেতন ছিল একটা বিরাট বড় পরিবার। একটা ছোট্ট ঘটনা বলি, আমার ১১ বছর বয়সে বাবা মারা যান। তখন আমার মায়েরও বয়স খুবই কম। সামাজিক নিয়ম মেনে আমার মা সাদা শাড়ি পরতে শুরু করেন। একদিন দেখি, দুপুরবেলা আমাদের বাড়ির সামনে একটা রিকশা এসে দাঁড়াল। সেই রিকশা থেকে নামলেন মোহরদি। মোহরদি আমার মায়ের হাতে দু’টি রঙিন শাড়ি দিয়ে বললেন, আজ থেকে তুমি আর সাদা শাড়ি পরবে না। সেই শাড়িদুটো যেন আমাদের জীবনের আশীর্বাদের নমুনা। ছিঁড়ে গেছে শাড়িদুটো, তবুও রয়ে গেছে। বড় দিদি হিসাবে মোহরদি মাকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন, দায়িত্ব পালন করেছিলেন বড় দিদির।
আজ বুঝি, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমরা ঘরোয়াভাবে পেয়েছিলাম। সব সময় খবর নেওয়া আমরা ঠিক আছি কি না, খেয়েছি কি না, মাঝে মাঝে মজা করা, পিছনে লাগা– এগুলো যতটা উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে, ততটাই উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে তাঁর কালজয়ী গানগুলি। মোহরদি যতটা ব্যপ্ত, ততটাই আমার আত্মীয়। যেন একই পরিবারের আমরা। যতটুকু গানই গেয়েছি, ওঁর অনুপ্রেরণা পেয়েছি, প্রশংসা পেয়েছি, আরও ভালো করার ইচ্ছে তৈরি হয়েছে আমাদের মধ্যে।
কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পোর্ট্রেট: অর্ঘ্য চৌধুরী