নজরুলের কবিতায় রয়েছে রুমি-হাফেজ-সাদির উওরাধিকার। মোহিতলাল বা সত্যেন্দ্রনাথের মতো নজরুল শুধু কবিতায় ফারসি শব্দ ব্যবহার করেননি বরং তাঁর কবিতায় রয়েছে এক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার। সেকারণে নজরুলের কবিতায় প্রাচ্যের প্রতিগ্রহণটিকে বোঝা জরুরি। ইউরোপকেন্দ্রিক আধুনিকতার প্রতিগ্রহণে বাংলা আধুনিক কবিতার যে চেহারাটি তখন ‘মূলধারা’ হিসেবে ছিল নজরুল সেখানে খানিক আলাদা, বেমানানও। প্রায় সমসাময়িক জীবনানন্দকে আধুনিকতার যে বয়ানে আবিষ্কার করা যায়, নজরুলের কবিতা ঠিক একভাবে পড়া যায় না। প্রাগাধুনিক বাংলা কবিতায় আরব-পারস্য সাহিত্যের প্রতিগ্রহণে যে ধারাটি তৈরি হয়েছিল আধুনিক বাংলা কবিতায় নজরুলের হাতে তারই উওরাধিকার বললে কি ভুল বলা হবে?
‘বিদ্রোহী’ কবির পরিচয়েই নজরুল ইসলাম জনপ্রিয়। শাসকের হাতে বাজেয়াপ্ত বই, কারাবরণ এবং সর্বোপরি ‘বিদ্রোহী’র মতো কবিতার স্মৃতি অতিক্রম করে কবি হিসেবে তাঁকে অন্যভাবে পড়ার কথা প্রস্তাব প্রায় অসম্ভব। পরাধীন ভারতবর্ষে দেশাত্মবোধক বাংলা কবিতায় স্বদেশের শ্রেষ্ঠত্ব, গরিমা অথবা ভালোবাসার আত্মনিবেদনের যে ঘরানা, নজরুলের দেশাত্মবোধক কবিতাকে ঠিক তার উত্তরাধিকারী বলা চলে না। একেবারে গোড়ার দিকে নজরুলের ‘হেনা’ ও ‘ব্যথার দান’-এর মতো প্রেমের গল্পে ‘দেশপ্রেম’ ও ‘আন্তর্জাতিকতা’র যে খোঁজ মুজফ্ফর আহমদ পেয়েছিলেন, তার মধ্যেই নজরুলের কবিতার অভিমুখ অনেকখানি নির্দিষ্ট হয়ে আছে। স্কুলজীবনে বিপ্লবী শিক্ষক নিবারণচন্দ্র ঘটকের সূত্রে স্বদেশি আন্দোলনের প্রতি তাঁর আগ্রহের সূচনার আভাষ মেলে ‘কুহেলিকা’ উপন্যাসে যেখানে বিপ্লবী শিক্ষক প্রমত্তর খবর স্কুলের কয়েকজন বিপ্লবী ছাত্র ব্যতীত ‘বিধাতাপুরুষ জানিতেন না’। তা সত্ত্বেও গুপ্ত বিপ্লবীদের ডেরায় না গিয়ে ১৯১৭ সালে প্রি-টেস্টের পর সেনাবাহিনীতে কেন যোগ দিলেন নজরুল? শুধুই কি বন্ধুর কথায়? কিশোর বয়সের বিপুল অনিশ্চয়তা আর পর-নির্ভরতা কি তাঁকে উন্মুখ করে তুলেছিল জীবিকার জন্য? বিশেষ করে ‘ঘর’-এর সঙ্গে একরকমের বিচ্ছেদের সূচনা যে তখনই হয়ে গিয়েছিল তা খানিক বোঝা যায় তাঁর ‘ঘরে’ না ফিরতে চাওয়ার অভিমানে। মায়ের সঙ্গে বিচ্ছেদের স্মৃতিও এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ। পরবর্তী জীবনেও এই অনিশ্চয়তা আর ‘ঘরের খোঁজ’, ‘ঘর বাঁধতে’ না পারার অভিজ্ঞতা তাঁকে একরকম ‘মুসাফির’ করে তুলেছিল বললে কি খুব অত্যুক্তি হবে? নজরুলের কবিতায় যে ‘প্রতিদানহীন ভালোবাসা’র (unrequited love) আদর্শ বা ‘ব্যথার দান’ গুরুত্বপূর্ণ লব্জ হয়ে উঠেছিল তাও এই অভিজ্ঞতার খুব বাইরে নয়।
………………………………………………………………………………………………………………
সেনাবাহিনীর ৪৯ নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্ট উঠে যাওয়ার পর নজরুল কি পেশাদার লেখক-কবি হওয়ার প্রত্যাশা নিয়েই কলকাতায় এসেছিলেন? প্রবাসে থাকাকালীন সাময়িকপত্রে তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে, এই জোরেই কি আসা সম্ভব ছিল? নিজের প্রথম কবিতা ‘মুক্তি’ প্রকাশের পর কৃতজ্ঞ নজরুল ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’র সহ-সম্পাদককে লেখেন– “সৈনিকের বড্ড কষ্টের জীবন। আর তাঁর চেয়ে হাজারগুণ পরিশ্রম করে একটু-আধটু লিখি। …আপনার পছন্দ হল কিনা, জানবার জন্য আমার নাম-ঠিকানা লেখা একখানা stamped খামও দেওয়া গেল এর সঙ্গে।”
………………………………………………………………………………………………………………
সেনাবাহিনীতে নাম লিখিয়ে তাঁর যুদ্ধে যাওয়ার মধ্যে জীবনীকাররা অনেকেই ব্যক্তিগত প্রেমের প্রত্যাখানের গল্প শুনিয়েছেন এবং করাচি প্রবাসের পর কলকাতায় ফিরে আসার সময় তাঁর সঙ্গে থাকা সামান্য কিছু জিনিসের সঙ্গে প্রেমিকার ‘চুলের কাঁটা’র সূত্রে এর সমর্থন জানিয়েছেন। এই একটিমাত্র কারণই নয়, সম্ভবত যুদ্ধে যাওয়ার মধ্যে ছিল অস্ত্রচালনার গৌরব অর্জনের ইচ্ছে যাকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে কাজে লাগানো যেতে পারে বলে অনেকেই মনে করেছিলেন। ‘রিক্তের বেদন’-এ নজরুল লিখেছেন– “জননী জন্মভূমির মঙ্গলের জন্যে সে কোন অদেখা দেশের আগুনে প্রাণ আহুতি দিতে এ কী অগাধ অসীম উৎসাহ নিয়ে ছুটে চলেছে তরুণ বাঙালিরা, –আমার ভাইরা! খাকি পোশাকের স্নান আবরণে এ কোন প্রাণভরা আগুন চাপা রয়েছে! তাদের গলায় লাখো হাজার ফুলের মালা দোল খাচ্ছে, ওগুলো আমাদের মায়ের দেওয়া ভাবী বিজয়ের আশিস-মাল্য, – বোনের দেওয়া স্নেহবিজড়িত অশ্রুর গৌরবোজ্জ্বল কমহার…।” সেনাবাহিনী ছেড়ে আসার পরেও নিজের ‘হাবিলদার পোশাক’-এর প্রতি ভালোবাসা ও আকর্ষণের স্মৃতিও এখানে স্মরণে রাখা প্রয়োজন।
নজরুলের কবি জীবনের প্রস্তুতিপর্ব হিসেবে সেনাবাহিনীর কর্মজীবন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, আরবি ভাষায় ব্যুৎপত্তি থাকলেও ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে নজরুলের সম্পর্ক এখানেই গভীর হয়। দ্বিতীয়ত, নানা ভাষা-নানা মতের ভারতবর্ষকে চেনার সুযোগ। তৃতীয়ত, দেশ-বিদেশের রাজনীতির খবরাখবরের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ। মনে রাখা দরকার, অনিয়মিত হলেও তখনকার গুরুত্বপূর্ণ বাংলা সাময়িকপত্রের সঙ্গে এখানেই তাঁর যোগাযোগ তৈরি হয়। নজরুলের কবিতা বিষয়ক কোনও প্রস্থান বিবেচনার ক্ষেত্রে এই তিনটি প্রসঙ্গই অপরিহার্য। এটা ঠিকই যে মুজফ্ফর আহমেদের সঙ্গ এবং ‘ধূমকেতু’ থেকে ‘গণবাণী’ পর্যন্ত অভিযাত্রায় নজরুল যে রাজনৈতিক চেতনা অর্জন করেছিলেন সেটাই তাঁর কবিতার প্রধান ভরকেন্দ্র। তাই নজরুলের দেশপ্রেমের কবিতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছিল এক আন্তর্জাতিক বিশ্ববীক্ষা। এখানেই তিনি নতুন, অভিনব। লেখালেখির শুরুর দিকে ‘লাল ফৌজ’ থেকে ‘কামাল পাশা’-র মধ্যে যে বিস্তার প্রত্যক্ষ করা যায় সেটিকে বাদ দিয়ে শুধু তাঁর দেশপ্রেমের কবিতা পড়া অসম্ভব!
সেনাবাহিনীর ৪৯ নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্ট উঠে যাওয়ার পর নজরুল কি পেশাদার লেখক-কবি হওয়ার প্রত্যাশা নিয়েই কলকাতায় এসেছিলেন? প্রবাসে থাকাকালীন সাময়িকপত্রে তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে, এই জোরেই কি আসা সম্ভব ছিল? নিজের প্রথম কবিতা ‘মুক্তি’ প্রকাশের পর কৃতজ্ঞ নজরুল ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’র সহ-সম্পাদককে লেখেন– “সৈনিকের বড্ড কষ্টের জীবন। আর তাঁর চেয়ে হাজারগুণ পরিশ্রম করে একটু-আধটু লিখি। …আপনার পছন্দ হল কিনা, জানবার জন্য আমার নাম-ঠিকানা লেখা একখানা stamped খামও দেওয়া গেল এর সঙ্গে।” প্রত্যুত্তরে নিজের ওপর একরকমের প্রত্যয় জন্মাতে শুরু করেছিল বলেই লিখতে পেরেছিলেন– “আপনার এরূপ উৎসাহ বরাবর থাকলে আমি যে একটি মস্ত-জবর কবি ও লেখক হব, তা হাতে কলমে প্রমাণ করে দিব…।” শুরুর দিকে নজরুলের লেখালখির যে খুব তারিফ জোটেনি এবং রবীন্দ্রনাথের লেখার ‘অক্ষম’ অনুকরণের অভিযোগের কথাও অনেকে তুলেছিলেন সেকথা স্মৃতিকথায় কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন। ‘সবুজপত্র’-এ পাঠানো তাঁর হাফেজের অনুবাদ না ছাপানোর কথা পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন। এইরকম পরিস্থিতিতে কবি হিসেবে নজরুল ইসলামের স্বীকৃতির পিছনে মুসলমান বাঙালির আত্মপরিচয়ের ইতিহাসের খোঁজ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। এসব খুব একটা খেয়াল করা হয় না যে, ১৩২৬ শ্রাবণ থেকে ১৩২৮ চৈত্রের মধ্যে নজরুলের রচনার অধিকাংশই প্রকাশিত হয়েছিল ‘নূর’, ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’ ও ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায়। ‘ভারতবর্ষ’, ‘বঙ্গবাণী’, ‘নারায়ণ’, ‘সাধনা’ প্রভৃতি পত্রিকাতেও স্বল্প কিছু কবিতা প্রকাশিত হয়। নবোদ্ভূত শিক্ষিত মুসলমান বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্যোগে সাহিত্য-সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে যে নবচেতনা প্রকাশ ও প্রচারের আয়োজন দেখা যায় সেখানে পত্রপত্রিকাগুলির ভূমিকা ছিল অপরিসীম। উনিশ শতকের শেষ কয়েক দশক থেকেই ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদী’ বয়ানের বিপরীতে বিকল্প বয়ান রচনার পাশাপাশি মুসলমান সমাজের নিজস্ব সমাজ-সংস্কৃতির পরিচয় তুলে ধরার চেষ্টা শুরু হয়। যদিও শুরুতে মুসলমান সমাজের বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগ ও হিন্দুর বয়ানে মুসলমান সমাজের নেতিবাচক যেসব বিবরণ দীর্ঘসময় ধরে দেওয়া হয়েছিল তারই প্রত্যুত্তর দেওয়ার কাজে ব্যাপৃত থাকতে হয়েছিল লেখক-কবিদের। ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ’-এর প্রতিষ্ঠানে মুসলমান বাঙালি যে ‘অনাহূত’ সেই খেদোক্তিও শহীদুল্লাহকে করতে হয়েছিল। এই পরিণামেই ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’র সূচনা। কার্যত নামে ‘মুসলমান’ শব্দটি জুড়ে থাকলেও ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’ যে একটি অসাম্প্রদায়িক পত্রিকা হিসেবে ‘হিন্দু সমাজের কাছে’ ‘মুসলমান সমাজের ইতিহাস, সাহিত্য, সংস্কৃতি’-র কথা তুলে ধরতে চায় সেকথা সংগঠকরা নিজেরাই লিখেছেন। কাজেই নজরুল ইসলামের মতো কবি-লেখককে পেয়ে তাঁরা যে আহ্লাদিত হবেন, তা বলাই বাহুল্য। তাছাড়া মুদ্রণ সংস্কৃতির যুগে মুসলমান বাঙালির রেপ্রেসেন্টেশনই বা কোথায়? যেটুকু ছিল তার সিংহভাগই নেতিবাচক। সেখানে না আছে মুসলমান বাঙালির সমাজ-পরিবারের ছবি, না আছে তাঁর সাংস্কৃতিক উওরাধিকারের কোনও চিহ্ন। নজরুলের প্রথম দিকের আখ্যানে মুসলমান বাঙালি সমাজের প্রতিবেশ আর চরিত্রদের উল্লেখ কি একরকমের আত্ম-অণ্বেষণ নয়?
যে বাঙালি যুবকের কাছে প্রেমিকার স্মৃতির সঙ্গেই জুড়ে ছিল ‘লাল ফৌজ’ সেও তো আসলে নিজের ক্ষুদ্র ‘আমি’কে ছাপিয়ে নতুন বিশ্ববীক্ষার মন্ত্রে পরিচিত হতেই উৎসুক। ‘শাতইল আরব’, ‘মোহারম’, ‘কোরবাণী’র মতো কবিতায় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রসঙ্গগুলি শতকরা সেই প্রায় পঞ্চাশ ভাগ মানুষের অনালোচিত, অনুল্লেখিত ইতিহাসের দিকে আমাদের ফিরিয়ে দেয় না? মনে রাখতে হবে ১৮৭২ অবিভক্ত বাংলার সেন্সাস রিপোর্টে হিন্দু-মুসলমানের আনুপাতিক হার প্রায় সমান-সমান হলেও আধুনিক মুদ্রিত সাহিত্যে তার কোনও ছাপই ছিল না। নজরুলের এইসব কবিতা অনেকাংশেই ইতিহাসের এই দায়িত্ব পালন করেছে। ‘সওগাত’ সম্পাদক নাসিরুদ্দিনের স্মৃতিকথায় নজরুলের বয়ানে প্রগতিশীল তরুণ মুসলিমদের রুচির ওপর ভরসা করে পত্রিকাকে চিত্র সম্বলিত আধুনিক করে তোলার বাসনার মধ্যেই এই ইতিহাসবোধের ইঙ্গিত আছে। তাছাড়া নজরুলের কবি হিসেবে আত্মপ্রতিষ্ঠা ‘সওগাত’ ছাড়া যে প্রায় অসম্ভব ছিল, অনেক পরে পত্রিকার রজত জয়ন্তী বর্ষের সভাপতির ভাষণে কথাটা তিনি নিজেই বলেছিলেন। এটা যে অত্যুক্তি নয় সেটা বোঝা যায় জনপ্রিয় বাজেয়াপ্ত বইগুলো থেকে একপয়সা রয়ালিটি না পাওয়ার দিনে বিপর্যস্ত কবির পাশে দাঁড়ানোর মধ্য দিয়ে। যদিও রক্ষণশীলদের ‘ইসলাম দর্শন’, ‘ইসলাম প্রচারক’-এর মতো পত্রিকাগুলি নজরুলের ব্যক্তিগত জীবন ও কবিতার দোহাই দিয়ে তাঁকে ‘কাফের’ বলতে কসুর করেনি। ১৯২৫ সালে ‘মোসলেম জগত’-এর মতো পত্রিকা ব্যাপারটাকে হিন্দু-মুসলমান বিরোধের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। দেশবন্ধুর আকস্মিক প্রয়াণের স্মৃতিতে লেখা ‘ইন্দ্রপতন’ কবিতায় পয়গম্বরের সঙ্গে চিত্তরঞ্জনের তুলনাই এর কারণ। নজরুল যে প্রথম এ কাজ করলেন তা নয়; প্রাগাধুনিক বাংলায় ‘নবীবংশ’, ‘রসুলচরিত’-এর মতো রচনায় নবী বা রসুলের প্রসঙ্গে উপমান ব্যবহারে হিন্দু পৌরাণিক দেবতাদের দৃষ্টান্ত অনেক। নিজের রাজনৈতিক বিশ্বাসেও নজরুল বরাবরই হিন্দু-মুসলমানের মিলিত ঐক্যেই গুরুত্ব দিয়েছেন। দেশবন্ধুর ‘বেঙ্গল ইমপ্যাক্ট’ তাঁর কাছে আদর্শ ছিল। কংগ্রেসের পলিটিক্যাল লাইনে ‘বেঙ্গল ইমপ্যাক্ট’ বাতিল হওয়ার ঘটনা এবং দেশবন্ধুর মৃত্যু তাঁকে প্রবল বিচলিত করেছিল। যদিও পরের দিকে লেখা ‘মন্দির ও মসজিদ’, ‘হিন্দু-মুসলমান’ প্রভৃতি রচনায় নজরুল সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরোধিতা করে হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যেই সারাজীবন গুরুত্ব দিয়েছেন। একদিকে ভারতীয় দর্শন, অন্যদিকে ইসলামি সুফি দর্শন মিলিয়ে দারা শিকোহর ‘মাজমা ‘উল বাহরায়েন’-এর নজরুল কৃত যে অনুবাদের সন্ধান অধ্যাপক আবুল হাসনাত ‘দুই সমুদ্রের মিলন’-এর মধ্যে দেন তাকে বাদ দিয়ে নজরুল পড়া অসম্ভব।
নজরুলের কবিতায় রয়েছে রুমি-হাফেজ-সাদির উওরাধিকার। ১৯১৯ সালের ‘ব্যথার দান’-এই সাদির গোলেস্তান, বোস্তান-এর উল্লেখ পাই আর হাফেজ তো ‘শিরাজের বুলবুল’। ‘রিক্তের বেদন’-এর ‘সালেক’ আসলে হাফেজের এক গজলেরই কাহিনিরূপ। এরকম উদাহরণ অজস্র। আসল কথা হল মোহিতলাল বা সত্যেন্দ্রনাথের মতো নজরুল শুধু কবিতায় ফারসি শব্দ ব্যবহার করেননি বরং তাঁর কবিতায় রয়েছে এসবের এক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার। সেকারণে নজরুলের কবিতায় প্রাচ্যের প্রতিগ্রহণটিকে বোঝা জরুরি। ইউরোপকেন্দ্রিক আধুনিকতার প্রতিগ্রহণে বাংলা আধুনিক কবিতার যে চেহারাটি তখন ‘মূলধারা’ হিসেবে ছিল নজরুল সেখানে খানিক আলাদা, বেমানানও। প্রায় সমসাময়িক জীবনানন্দকে আধুনিকতার যে বয়ানে আবিষ্কার করা যায় নজরুলের কবিতা ঠিক একভাবে পড়া যায় না। প্রাগাধুনিক বাংলা কবিতায় আরব-পারস্য সাহিত্যের প্রতিগ্রহণে যে ধারাটি তৈরি হয়েছিল আধুনিক বাংলা কবিতায় নজরুলের হাতে তারই উওরাধিকার বললে কি ভুল বলা হবে? তাঁর কবিতায় আরবি-ফারসির শব্দ ব্যবহারের মূল রহস্য পরিপ্রেক্ষিত জ্ঞান। আসলে ফারসি কবিতার যে ‘এসেন্স’ সেটাই নজরুলের কাব্যাদর্শ। ‘প্রতিদানহীন ভালোবাসা’ যা অন্যের প্রতিদানে ধন্য হয় না বরং আঘাত আর ‘ইনতিজার’-এই সে ধন্য হয়ে ওঠে। নিজেকে যে ‘মরু মুসাফির’ বললেন তাও কি এই দর্শন-লব্ধ নয়? ভারতীয় কবিতার উত্তরাধিকারকেও বোধহয় বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। প্রসঙ্গত ওমর খৈয়ামের প্রভাবের কথা অনেকেই উল্লেখ করেছেন। কাজেই ‘অশিক্ষিত’, ‘হুজুগে কবি’-র তকমা দেওয়ার আগে ইতিহাসলগ্ন হয়ে এই নান্দনিক বোধের কথা ভেবে দেখা একবার প্রয়োজন। শুধু তাই কেন, বাংলা কবিতায় ভারতীয় ও প্রাচ্য কবিতার বিপুল সম্ভারকে উন্মুক্ত করে নজরুল একরকমের ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন। আজকের দিনে সংস্কৃতির এই উত্তরাধিকার বোঝার ও বহন করার দায় কি আমাদের একেবারেই নেই?
ঋণস্বীকার: অধ্যাপক আবুল হাসনাত