নন্দন-এর প্ল্যান ও ডিজাইন করেছিলেন ‘সেনগুপ্ত অ্যান্ড সেনগুপ্ত কোম্পানি’। এবং তত্ত্বাবধান করে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পিডব্লিউডি বিভাগ। এদের অধীনে কলকাতার ডি. পি. কুমার বাড়ি তৈরির কাজটি শেষ করেন। এই যে চারিদিকে জল, এটা কিন্তু শুধু সৌন্দর্য বৃদ্ধি নয়, এর একটা প্রয়োজনীয় ব্যবহারিক কারণও আছে। শিশির মঞ্চ, রবীন্দ্র সদন আর এই সেন্টার নিয়ে যে, একটা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র তৈরি হয়েছে, তার একটাতেও হঠাৎ কোনও কারণে যদি আগুন লাগে, তার প্রয়োজনীয় জল পাওয়ার কথা ভেবেই এমন জল সংরক্ষণের ব্যবস্থা।
১৯৮৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর, পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে একটি স্বর্ণোজ্জ্বল দিন। সেদিন বিকেলে উদ্বোধন হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ চলচ্চিত্র কেন্দ্র, ‘নন্দন’-এর। ১৯৭৮-এ বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পরই তখনকার তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কতকগুলো প্রস্তাব গ্রহণ করেন। তার তিন নম্বর প্রস্তাবটি ছিল, শহরের কেন্দ্রস্থলে একটি আর্ট থিয়েটার নির্মাণ। প্রস্তাবটি নতুন করে ঠিক হয়, শুধু আর্ট থিয়েটার নয়, নির্মিত হবে আর্ট থিয়েটার ফিল্ম কমপ্লেক্স। সত্যজিৎ রায়কে চেয়ারম্যান করে গঠিত হয় একটি কমিটি। বাংলা চলচ্চিত্র জগতের গুণী মানুষদের সহযোগিতায় ১৯৭৯ থেকে শুরু হয় কমপ্লেক্সের কাজ। ঠিক হয় কমপ্লেক্সে তিনটি ছোট-বড় হল থাকবে, থাকবে লাইব্রেরি, ফিল্ম ভল্ট, ভিডিও রুম অতিথিশালা এবং প্রদর্শনী ঘর। কমপ্লেক্সটি শুধু পশ্চিমবঙ্গের নয়, হয়ে উঠবে ভারতের গৌরব– এহেন মত দিয়েছিলেন অনেকেই।
শুরু থেকে নন্দনের সঙ্গে কিঞ্চিৎ জড়িয়ে ছিলাম। নন্দন তৈরির প্রস্তাব হওয়া থেকেই বিষয়টির প্রতি আগ্রহ আমার। কীভাবে প্ল্যান হল, তৈরি শুরু হল– সব কিছুই খুঁটিয়ে দেখতাম। ‘খবর’ হলে কেটে রাখতাম। সময়-সুযোগে কতদূর কাজ এগলো, দেখতে যেতাম। দেখেছি, কীভাবে একটা পুকুর আর জলা জায়গা ক্রমশ দৃষ্টিসুখ অভিনব স্থাপত্য হয়ে উঠল।
ইউরোপের প্রায় প্রত্যেকটি দেশের বড় বড় শহরে একাধিক আর্ট থিয়েটার রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও তাই। এইসব প্রেক্ষাগৃহতে অবাণিজ্যিক পরীক্ষাধর্মী ফিল্মগুলি দেখানো হয়। সত্যি বলতে, প্যারিসের সিনেমা থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘লিঙ্কন সেন্টার’ বা লন্ডনের ‘ন্যাশনাল ফিল্ম থিয়েটার’-এর সমকক্ষ আমাদেরই এই নন্দন।
স্থাপত্যের দিক থেকে নন্দনের নকশার গুণগত অভিনবত্ব অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। চারিদিকে জল, মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই চলচ্চিত্র কেন্দ্রটি। উপর থেকে বিহঙ্গ দৃষ্টিতে দেখলে মাছ বলে ভ্রম হতে পারে। জলের উপর সাঁকোর আকারে পথ রয়েছে তিনটি। একটি ভিআইপিদের জন্য, আর দু’টি সাধারণের জন্য। এই চমৎকার বাড়িটির প্ল্যান ও ডিজাইন করেছিলেন ‘সেনগুপ্ত অ্যান্ড সেনগুপ্ত কোম্পানি’। এবং সমস্ত কাজটি তত্ত্বাবধান করেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পিডব্লিউডি বিভাগ। এদের অধীনে কলকাতার ডি. পি. কুমার বাড়ি তৈরির কাজটি শেষ করেন। এই যে চারিদিকে জল, এটা কিন্তু শুধু সৌন্দর্য বৃদ্ধি নয়, এর একটা প্রয়োজনীয় ব্যবহারিক কারণও আছে। শিশির মঞ্চ, রবীন্দ্র সদন আর এই সেন্টার নিয়ে যে, একটা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র তৈরি হয়েছে, তার একটাতেও হঠাৎ কোনও কারণে যদি আগুন লাগে, তার প্রয়োজনীয় জল পাওয়ার কথা ভেবেই এমন জল সংরক্ষণের ব্যবস্থা।
প্রায় ২০ হাজার বর্গফুট নিয়ে তৈরি কেন্দ্রটিকে তিনটি ব্লকে ভাগ করে নেওয়া যেতে পারে। সব মিলিয়ে এই চলচ্চিত্র কেন্দ্রটিতে প্রেক্ষাগৃহে সংখ্যা তিন। এই চলচ্চিত্র কেন্দ্রটির ‘নন্দন’ নামকরণের সঙ্গে সঙ্গেই নামাঙ্কনটিও সত্যজিতের সৃষ্টি। সেই দিন নন্দন উদ্বোধন করতে এসেছিলেন সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন এবং তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। ভবনটি উদ্বোধন করে সত্যজিৎ রায় বলেন, ‘যাঁরা ভাল ছবি দেখতে চান, যাঁরা চলচ্চিত্রকে ভালবাসেন এবং যাঁরা এতদিন মনে করতেন চলচ্চিত্রের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কিছু করা উচিত, তাঁদের কাছে আজকের দিনটি স্মরণীয়।’
তিনি ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট এবং ন্যাশনাল ফিল্ম থিয়েটারের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘বিদেশে এই ধরনের চলচ্চিত্র কেন্দ্র থাকলেও ভারতে পশ্চিমবঙ্গ চলচ্চিত্র কেন্দ্রের মতো আর দ্বিতীয় কোনও চলচ্চিত্র কেন্দ্র নেই, যেখানে ফিল্ম তৈরি ছাড়া আর সব বিষয় আর সব কিছু পরিকল্পনা রয়েছে। একথা সত্য, ফিল্ম দেখানোটাই শুধু এখানকার কাজ হবে না। ফিল্ম নিয়ে আলোচনা হবে গড়ে উঠবে ফিল্ম সংক্রান্ত লাইব্রেরি।’
এর অনেকটাই কিন্তু পূরণ হয়েছিল। আমার মনে আছে, নন্দন উদ্বোধন এবং সেই উপলক্ষে প্রদর্শনী ও সেরা ভারতীয় আঞ্চলিক ছবির উৎসব আগ্রহীদের মন ভরিয়ে দিয়েছিল। সেই দিনেই প্রথম দেখেছিলাম, ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির তৈরি তথ্যচিত্র ‘বাংলা ছবির চালচিত্র’।
‘বাংলা চলচ্চিত্রশিল্পের ক্রমবিকাশ’ নামের প্রদর্শনীটি ছিল সত্যিই অসাধারণ! চলচ্চিত্রের নানা দুষ্প্রাপ্য যন্ত্রপাতি আর ছবি দিয়ে সাজানো হয়েছিল সেই প্রদর্শনী। দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন তার অন্যতম কিউরেটর। যেচে গিয়ে আলাপ করেছিলাম তাঁর সঙ্গে। বলেছিলাম, এটার একটা স্থায়ী প্রদর্শন করে রাখা দরকার। সে আর হয়নি। সেসব দুর্মূল্য ছবিগুলোও কোথায় গেল, কে জানে!
নন্দনের শুরু থেকেই কলকাতার নিজস্ব আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের কথা ভাবা হয়েছে। ১৯৯৫ থেকে সেই উৎসব শুরু হয়। বিশ্বের সেরা চলচ্চিত্রই শুধু নয়, অতিথি হিসেবে আসতেন বিদেশের খ্যাতনামা পরিচালক ও অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। ইটালির মাইকেল্যাঞ্জেলো অ্যান্তোনিওনি, অস্ট্রেলিয়ার পল ককস বা পোলিস পরিচালক জানুসির মতো ব্যক্তিকে দেখেছি কলকাতার চলচ্চিত্র উৎসবে। এসেছিলেন বুনুয়েলের চিত্রনাট্যকার জাঁ-ক্লদ কারিয়ের। নন্দনকে ঘিরে বার্ষিক চলচ্চিত্র উৎসব এই কেন্দ্রটিকে অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল। ১৯৯৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত এই উৎসবের সূচনা ও সমাপ্তি অনুষ্ঠান এবং ছবির প্রদর্শনী নন্দনের মূল প্রেক্ষাগৃহেই হত। দর্শক অত্যন্ত আগ্রহ নিয়েই সেই অনুষ্ঠান দেখতেন। এখন সেই অনুষ্ঠান হয় নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে। ছবি দেখতে নয়, সেখানে দর্শক ভিড় করেন বলিউডের তারকা দেখতে।
এই চলচ্চিত্র উৎসব নিয়ে একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। ২০০৫ সাল, সেবারে উৎসবে আদুর গোপালকৃষ্ণনের বেশ কয়েকটি ছবি দেখানো হয়েছিল। সেই বছরে তৈরি তাঁর নতুন ছবিটি দেখার জন্য লাইন দিয়েছি। বেশ লম্বা লাইন। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি। লাইনের সামনের ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হল। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোলোরাডো ইউনিভার্সিটির ফিল্ম স্টাডিসের প্রধান। সত্যজিৎ রায়ের ওপর বই লিখেছেন। ইচ্ছে, আদুর গোপালকৃষ্ণনের ছবি নিয়ে কাজ করার। তাঁর ছবিগুলি দেখতেই কলকাতায় ছুটে আসা। তাঁর নাম সুরঞ্জন গাঙ্গুলি। ঘটনাটি বললাম, শুধু কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের তাৎপর্যটুকু বোঝাতে।
পিটার ব্রুকের মহাভারত নাটকের চলচ্চিত্র সংস্করণের কয়েকটি শো হয়েছিল নন্দন দুই-এ। গিয়ে দেখি, ওই নাটকের বিভিন্ন দেশের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নাট্যব্যক্তিত্ব প্রেক্ষাগৃহের সামনের চত্বরে শতরঞ্জি পেতে তার ওপর ওয়ার্কশপ করছেন। উদয়শঙ্করের শতবর্ষে তাঁকে নিয়ে অসাধারণ প্রদর্শনী এবং ‘কল্পনা’ ছবিটি দেখতে নন্দনে উপস্থিত হয়েছিলেন রবিশঙ্কর, শম্ভু মিত্র আর সত্যজিৎ রায়। বিভিন্ন সময়ে চার্লি চ্যাপলিন, সত্যজিৎ রায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, চিদানন্দ দাশগুপ্ত, ঋতুপর্ণর ঘোষের মতো চলচ্চিত্রকারদের ওপর ভিত্তি করে অসাধারণ সব প্রদর্শনী নন্দনকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে। নন্দনের লাইব্রেরি শহরের সেরা চলচ্চিত্র বিষয়ক গ্রন্থাগার হয়ে উঠেছিল। সে লাইব্রেরি আর নেই। তেমনই গৌরবের ছিল সত্যজিৎ রায় আর্কাইভ। নির্দিষ্ট ঘরটি এখন অন্য কাজে ব্যবহৃত হয়। তবুও নন্দন আমাদের গর্ব।
ছবিঋণ: লেখক