ধুর বোকা, এরকম মনখারাপ করলে চলে! হাসির মতো দ্রুত, দুঃখের মতো ধীর জীবন ছেড়ে একটু অনস্তিত্বে ডুববি না রে? এখানে কিচ্ছু ধ্রুবক নয়, চরম নয়, তুই যা ভাববি তা-ই গুজব, তা-ই বাস্তব। কোনও মাত্রা নেই এই স্পেসের, চটি পায়ে জানলা দিয়েও বেরিয়ে পড়া যায়, আকাশে তাক করে রুটি ছুড়ে দিলেই আরেকটা চাঁদ, এখানে সংগীত পিছলে যায় সময়বন্ধ থেকে, ওই যে বিঠোফেনের একদম বধিরকালের কম্পোজিশন গ্রস ফু, কিচ্ছু শুনতে পেত না লোকটা, শুধু কল্পনায় কল্পনায় রচনা করে গেল, তাতে কি তা বাজল না বাস্তবে? বাজল তো…
আসলে যে তার নাম কী ছিল, তা আর জানা সম্ভব নয়, কিন্তু আমরা তাকে ‘খ্যানখ্যানানি বুড়ি’ বলেই চিনতাম। পাড়ার রাসমন্দিরের গা-ঘেঁষে ছোট্ট এক ঝুপড়ি, বুড়ির বাস। বয়স ৭০ ছুঁই ছুঁই, কিন্তু শিরদাঁড়া সোজা, হাঁটাচলা নির্বিঘ্ন ৪০। ঘর থেকে হয়তো এমনিই বেরিয়েছে, কোনও কাজে যাচ্ছে, কিংবা সাতসকালে উঠোনে এসে নিমদাঁতন চিবোতে চিবোতে পায়চারি, অদূরে বারোয়ারি কুয়ো থেকে জল তোলা– এই অবধি সব ঠিকঠাক। কিন্তু, এবার দেখা যাবে, বারবার, হুটহাট, আচমকা সে পিছন ফিরে তাকাচ্ছে এবং এক সেকেন্ড আগের শান্ত মানুষটা তুমুল রেগে উত্তম-মধ্যম বাপবাপান্ত করতে একবিন্দুও ছাড়ছে না, কাকে কে জানে, কারণ পিছনে কেউ নেই!
প্রথম প্রথম ভয় লাগত দেখে, ক্রমশ অভ্যস্ত চোখে তা পরিণত হল রগড়ে। আমরা, পাড়ার তৎকালীন কচিকাঁচার দল অশ্লীল খোরাক বানিয়েছিলাম, ক্লাসের মেয়েগুলো ‘বড় একা একা লাগে আমার’ বলে পাগল হয়ে যাচ্ছে, আর এদিকে এই বয়সেও বুড়ির পিছনে পড়ে রয়েছে কোনও এক অদৃশ্য!
………………………………….
যদি উপস্থিতিই না থাকে, অনুপস্থিতিরই বা স্বত্ত্ব কই? যে মানুষ নিঃসঙ্গ, তার কাছে কি পৌঁছনো যায় কখনও, কিংবা নিঃসঙ্গতা দেখতেও পাওয়া যায় কি? দৃশ্যত, যে নিঃসঙ্গ, সে যে-মুহূর্তে বুঝে যায়, আরেকবার হারায় নিজেকে। ঘুমের স্বপ্নে ঘুম ভেঙে যাওয়া। অতুলনীয় বরং, অনস্তিত্ব।
………………………………..
সেদিন শীতের বিকেলবেলা, সবে উইকেট গাঁথা হয়েছে মাঠে, ওদিকে খ্যানখ্যানানি বারোয়ারি কুয়োয় জল তুলতে এসছে। আমাদের কেউ কেউ মুখের সামনে হাত মুঠো করে গলা বদলে ডাক দিচ্ছে বুড়িকে, কিন্তু ভারি অদ্ভুত, খ্যানখ্যানানি পিছন ফিরছে না। দড়ি উঠছে নামছে। চুপচাপ জল তুলে চলেছে খ্যানখ্যানানি। উত্যক্ত করতে না পেরে ছেলেপুলেরাও থেমে গিয়েছে ততক্ষণে, লটারি হয়ে গিয়েছে, শশী ব্যাট করবে আগে। বাকিরা ফিল্ডিং পজিশনে। বাপি বল করতে যাবে, এমন সময় খ্যানখেনিয়ে উঠল বুড়ি, পিছন ফিরে নয়, সামনে কুয়ো লক্ষ্য করে, এবং ঝাঁপ। নিহিত পাতালে। দৌড়ে সেখানে পৌঁছতে পৌঁছতে কুয়ো ততক্ষণে সব গিলে নিয়েছে, মুখ একইরকম হাঁ, কই কিচ্ছু খাইনি তো। কেবল কপিকল নকল করে চলেছে স্বর, খ্যানখ্যান খ্যানখ্যান…
বুড়ির অভিযোগহীন দেহ তুলে আনতে লাগল দু’দিন, আর প্রথম জানা গেল, বিগত ২০ বছর ধরে খ্যানখ্যানানির শ্রুতি মৃত। যেহেতু সামনাসামনি কেউ তার সঙ্গে কথা বলে না, তার কেবল মনে হত পিছনে কেউ কথা বলছে। শ্রুতির স্মৃতি তাকে এভাবে উত্যক্ত করে গিয়েছে অবিরাম, তাহলে শেষবেলায় কুয়োর কাছে সে কি ফিরে পেয়েছিল তার শ্রুতি? সে বিশ্বাস করতে পারেনি? না কি ধ্বনির আগে উচ্চারিত হয়েছিল প্রতিধ্বনি?
মহাপৃথিবী, মহাকাশ রহস্যময় সুতোয় গাঁথা হয়ে কোনও এক সরল অঙ্কের জটিল সমাধান তৈরি করে রেখেছে যে, সেই সুতোর তরঙ্গে তরঙ্গে খ্যানখ্যানানি বুড়ি আমায় প্রথম ধাক্কা দিয়ে গিয়েছিল– উপস্থিতি আদপে অনুপস্থিতির সীমিত বিরতি। একপিস চুটকি। একবার হাসি পায়, আনন্দ লাগে, পায় নাকো আর।
কিন্তু, যদি উপস্থিতিই না থাকে, অনুপস্থিতিরই বা স্বত্ত্ব কই? যে মানুষ নিঃসঙ্গ, তার কাছে কি পৌঁছনো যায় কখনও, কিংবা নিঃসঙ্গতা দেখতেও পাওয়া যায় কি? দৃশ্যত, যে নিঃসঙ্গ, সে যে-মুহূর্তে বুঝে যায়, আরেকবার হারায় নিজেকে। ঘুমের স্বপ্নে ঘুম ভেঙে যাওয়া। অতুলনীয় বরং, অনস্তিত্ব। মিশনে আমার এক বন্ধু ঢকাস-কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ভাই তুই তো দেখতে পাস না, তাহলে স্বপ্নে কী দেখিস? ঢকাসের কথা বলার ধরন অনেকটা, এক মুহূর্তে ফাস্ট ফরওয়ার্ড, পর মুহূর্তে স্লো। মাঠে বসে আছি আমরা। ফুটবল খেলা দেখতে দেখতে ঘাস ছিঁড়ছি আমি, ঢকাস সেই ঘাসে হাত বুলোতে বুলোতে বলল– সুপ্রিয়, তোর কড়ে আঙুল দিয়ে তুই দেখতে পাস? হিক করে হেসে ওঠার পরমুহূর্তে ঘাবড়ে গেলাম! ভাই, তোর কি খারাপ লাগল আমার প্রশ্নে? আরে ধুস, বল না যেটা জিজ্ঞেস করেছি। কড়ে আঙুল দিয়ে আবার কী করে দেখব, এটা কোনও প্রশ্ন হল? ঢকাস এবার হেসে উঠল, তার ছটফটে চোখ দুটো আকাশের দিকে তাক করে নড়ছে। তুই যেমন কড়ে আঙুলে দেখতে পাস না, আমিও তেমনই আমার চোখে দেখতে পাই না। কিন্তু, আমি বুঝতে পারি একটা মাংস নড়াচড়া করছে, তোরা চোখ বলে চিনিস। স্বপ্নকে তোরা যেভাবে জানিস, আমার জানা অন্য। আমাদের একটাই মিল, আমরা কেউই স্বপ্নকে নিখুঁত মনে রাখতে পারি না।
……………………………….
পড়ুন সম্বিত বসুর লেখা: মাস্টার অফ গান
……………………………….
কিন্তু, এই জানাও কি কুসংস্কার নয়? কথাকে গিলে নিয়ে আমরা ফিরে আসি যে যার ভবনে। দৃষ্টিমানদের ভবনে ভবনে ছন্নছাড়া রেগুলেটর মুড়ে ঋতু বদলের খেলা শুরু হয় ইতিউতি, শুধু দৃষ্টিহীনদের হস্টেলে সমস্ত টিউবলাইটের সুইচ বাচালতা শুরু করে দেয়। ঠিক প্রার্থনার প্রথম ঘণ্টা পড়া মাত্র, ধুতি-উত্তরীয় গায়ে চাপানোর আগে, অন্ধজনের দেহ আলো হয়ে ওঠে।
এই বুঝি অন্য দুনিয়ার আলো? যেখানে অন্ধকারও সমার্থক? তুমি কি জানো না বন্ধু– দুটো অন্ধকারও একে-অপরকে আলো দেয়? তবু ঢকাসের ওই কড়ে আঙুলের উপমা আমার চোখ কচলে দেয়। ওই কড়ে আঙুল কি শিশুর মুঠোভরা আশ্রয়? আমাদের সময় সমান নয়, আমাদের স্বপ্ন ভিন্ন স্থান ও পাত্রের ত্রিকোণমিতিতে, এমনকী, অন্ধকারের গতিবেগও আলাদা। তবু, আলো যে সমান গতিতে পৌঁছে যায় আমাদের যার যার কাছে, এ কি কম কথা?
সমস্ত প্রশ্ন ঢকাসের ওই হাসিতে মুচকে যায়। আলোও কি মুচকে যায় না বিপুল অভিকর্ষের কাছে? যাকে দেখা যায় না, সে-ই দেখায়– এই আত্মবিমুখ দর্শন ভূ-পৃষ্ঠ কি আদৌ অনুসরণ করে? আরও আলো, আরও আলোর চাওয়ায় সমস্ত কমন সেন্সই এক অর্থে কুসংস্কার ঠাওর হয়, ঠিক যেভাবে ঢকাস জানত, সকাল হলে রোদের জন্য রুমের জানালাটা খুলে দিতে হবে। সে কি আলোকে শ্রুতি দিয়ে চেনে, গন্ধ দিয়ে বোঝে, স্পর্শ দিয়ে কামনা করে?
ভরদুপুরের উদলা আকাশতলে বসে, ঢকাসের চোখের ছটফটানি নকল করি যেই, ক্রমশ খেলা ঘুরতে শুরু করে। আলোর সরলরেখা পথ কাগজের ভাঁজের মতো দুমড়েমুচড়ে যেতে থাকে। দপদপ করতে থাকে সূর্য, ছায়া তার দ্বিমাত্রিক সিদ্ধান্ত ছেড়ে নিজের পায়ে উঠে দাঁড়িয়েছে, তাকে আর পেষা যাবে না। দূরের গলিতে বেড়ালটা পা রাখার আগেই রাস্তা তাকে পেরিয়ে চলে গেল। বিপরীতে বৃষ্টির সঙ্গে ইতিমধ্যে ঝরে পড়ছে রামধনু। মেঝেয় জমা জলের উপর যা কিছু অসদ্বিম্ব, প্রতিফলন– সব প্রতীয়মাণ হচ্ছে ঘটনার কয়েক শ্বাস আগে। আহ্, তাহলে আর অতীত বলে কিছু নেই, বর্তমান নেই, কেবলই ভবিষ্যৎ আর চোখের সামনে সব ভুলে যাওয়া? নাক বন্ধ হয়ে আসছে, এই বাতাস চিবিয়ে না খেলে প্রশ্বাস সম্ভব নয় আর। সময় এত নরম যে, আর কারও লেট হবে না। চোখের দু’পাতা ফাঁক করার মধ্যেই লুকিয়ে আছে দূরত্বকে কমানো-বাড়ানোর খেলা। শুধু খেয়াল রাখতে হবে চোখে যেন ধুলো না ঢোকে, চোখ কচলে ফেললে নরম সময় বাজে ঘেঁটে যেতে পারে। এই ছটফটে চোখ নিয়ে ছাদে দু’বার পায়চারি করতে গিয়ে একবার অনন্ত পেরলাম, আরেকবার এক কদমও নয়। মাটি-বাতাস মাখা হয়ে দিগন্তরেখা এখন স্পষ্টত খাঁজ, দিক বলে আর কিছু নেই, বাঁকা আলোর মালায় ফালি হওয়া খণ্ড আকাশে পৃথকভাবে ধরা দিয়ে আছে ভিন্ন ভিন্ন ঋতু, নিচ থেকে খবর ভেসে আসছে, দূরে যুদ্ধে কামান-বন্দুক থেকে নিক্ষিপ্ত গোলা ও গুলি কিছু পথ পেরতে না পেরতে ধীর লয়ে ধেয়ে যাচ্ছে মহাশূন্যের দিকে, অতঃপর অজস্র ফুল ফোটার শব্দ ভেসে আসছে কেবল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে। শুধু আলো তার গতিবেগের প্রতিশ্রুতি রাখতে পারল না বলে, এত কিছু ঘটছে রে ঢকাস?
ধুর বোকা, এরকম মনখারাপ করলে চলে! হাসির মতো দ্রুত, দুঃখের মতো ধীর জীবন ছেড়ে একটু অনস্তিত্বে ডুববি না রে? এখানে কিচ্ছু ধ্রুবক নয়, চরম নয়, তুই যা ভাববি তা-ই গুজব, তা-ই বাস্তব। কোনও মাত্রা নেই এই স্পেসের, চটি পায়ে জানলা দিয়েও বেরিয়ে পড়া যায়, আকাশে তাক করে রুটি ছুড়ে দিলেই আরেকটা চাঁদ, এখানে সংগীত পিছলে যায় সময়বন্ধ থেকে, ওই যে বিঠোফেনের একদম বধিরকালের কম্পোজিশন গ্রস ফু, কিচ্ছু শুনতে পেত না লোকটা, শুধু কল্পনায় কল্পনায় রচনা করে গেল, তাতে কি তা বাজল না বাস্তবে? বাজল তো…
পিছন থেকে কানে ভেসে আসছে দুই বন্ধুর কথোপকথন, ফিরে দেখি কেউ তো নেই। এই জমাট বাতাসে কোনও শব্দের তরঙ্গ নেবে না ঢেউটান। কেবল কঠিন পাতলা পাতের ধাতুর মতো দূর বহুদূর থেকে ভেসে আসছে খ্যান খ্যান খ্যান খ্যান। আর কোনও এক্সপানশন-কনট্রাকশন নয়, মহাবিশ্বের কম্পনই বাজে করুণ সুরে, শুধুমাত্র, একদা, সর্বদা। গাছেদের ঘুম চটকে গেছে। ফুল ফুটবে, ফল হবে না– এনার্জি আর লাইফটাইম ফ্রি নয়।
খেলা অনেকটা ঘুরে গিয়েছে, আর উপায় নেই, হাতভর্তি আলোই আছে শুধু। বিস্ফোরণের, বনদহনের মেয়াদ শেষে অকৃত্রিম লাঠির মতো, জিলিপির মতো আলো। এবার শান্তি। এখন শুধু আলো দৃশ্যমান যেহেতু, সে আর দেখাবে না কিছু। আমরা তাকে চোখেই হারালাম।