মল্লিকা সেনগুপ্তর লেখা যদি ছাতাপড়া সমাজের কানে তুলে দিতে পারি, সে-ই হবে যথার্থ কাজ
Published by: Robbar Digital
Posted on: March 26, 2024 9:34 pm
Updated: March 26, 2024 9:34 pm
মল্লিকা সেনগুপ্তর কবিতার জাদুশক্তি– অন্তর্নিহিত গূঢ় কথা ছাপিয়ে তার আবেদন সকলের কাছে চলে যায়। চলে যায় রান্নাঘরে, শোওয়ার ঘরে ও মেয়েদের মজলিশে। মেয়েলি হাসিকান্নায় মিশে যায় লেখাপত্রগুলি। যা কখনও কবিতা, কখনও বা কাব্যনাটক। সোশিওলজির ছাত্রী ছিল সে। অধ্যাপিকাও। তাই কত মিথ, কত সোশ্যাল কনটেন্ট, পুরাণ থেকে নেওয়া সাবটেক্সট চমৎকারভাবে লিঙ্গরাজনীতির অন্ধকার মেখে নতুন করে লেখা হয়েছে ওর কলমে।
চৈতালী চট্টোপাধ্যায়
জেন অস্টেন-এর লেখায় পড়েছি, I hate to hear you talk about all women as if they were fine ladies instead of rational creatures. None of us want to be in calm waters all our lives.
মনে পড়ল। এমনিই মনে পড়ল, মল্লিকা সেনগুপ্তর কবিতার লাইন আমি আবার উচ্চারণ করতে বসলাম যখন। ‘তোমার কাঁটা আমি শরীর পেতে নেব শর্ত একটাই বলার আছে/ আমার ইচ্ছায় কখনও বাধা দিলে জলের মাছ আমি ফিরব জলে।’
কবিতা, কবিতাগুলো পড়তে পড়তে হারিয়ে যেতে হয়। ছন্দ, কন্টেন্ট, শব্দচয়ন– ঘোর ভেঙে, নিজেকে তারপর ফিরিয়ে আনলাম নিজের লেখাটির মধ্যে। মল্লিকা সেনগুপ্ত মনস্বিনী, মেধাবী ও প্রখর কবি– এসব বিশেষণ ওর আঁচলে গিঁটবাঁধা ছিল মৃত্যু অবধি। আর, এসব আভরণ ছাপিয়ে মল্লিকা আমার কাছে, বন্ধু, কৌতূকপ্রবণ, রন্ধনপটিয়সী, বেদম সংসারী। আমরা একসঙ্গে লেখালেখি শুরু করেছিলাম এটা বলা চলে নিশ্চয়ই। ভৌগোলিক অবস্থান সামান্য দূরে দূরে ছিল, যদিও। আনন্দবাজার দপ্তরে সুনীলদার টেবিলে পৌঁছে, প্রায়ই শুনতাম ও এসেছিল। তারপর আমরা মল্লিকার কথা বলতাম, খানিক।ওর সঙ্গে দেখা হয়নি তখনও। পরে, ধীরেসুস্থে দেখা হল। বন্ধুত্ব হল। সেই বন্ধুতার রেশ জড়িয়ে, হাসপাতালের বেডে শুয়ে মল্লিকা তার কলেজ-কলিগদের সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দেবে, আমরা একসঙ্গে লিখতে এসেছিলাম…
মল্লিকা বলবে, ‘মেয়েদের মতো ভালোবাসা ছেলেরা শেখেনি। কথামানবী বিশ্বাস করে সে কথা। দেখুন, নর্মদাও মেয়ে আর মেধা পাটকরও মেয়ে। নর্মদাকে বাঁচানোর জন্য মেধার মতো আর তো কেউ করেনি।’
মল্লিকার সঙ্গে আমি একই ঘর শেয়ার করে থেকেছি চিলকাতে সাহিত্যানুষ্ঠানে গিয়ে। আর, বেগুন রান্নার রেসিপি থেকে শুরু করে, ফেশিয়ালের নতুন কিছু, জাঙ্ক জুয়েলারি কোথায় ভালো মেলে– গপ্পো করেছি আমরা। সেই সঙ্গে মুখরোচক পরচর্চাতেও মেতে গেছি। ভুললে চলবে না, ততদিনে মল্লিকার কলম আগুন ঝরাচ্ছে। ‘মাটি জল বায়ু অগ্নি এবং মানুষ/ ভারতবর্ষ তোমাকে প্রণাম করেই/ সেই ইতিহাসে কোণঠাসা নারী আমরা/ শুরু করলাম কথামানবীর ভাষ্য।’
মল্লিকা বলবে, ‘মেয়েদের মতো ভালোবাসা ছেলেরা শেখেনি। কথামানবী বিশ্বাস করে সে কথা। দেখুন, নর্মদাও মেয়ে আর মেধা পাটকরও মেয়ে। নর্মদাকে বাঁচানোর জন্য মেধার মতো আর তো কেউ করেনি। প্রকৃতিও নারী, সীতাও নারী। শ্রীরামের ধ্বংসলীলা থেকে অরণ্য প্রকৃতিকে বাঁচাতে সীতার মতো প্রার্থনা আর কেউ করেনি। সারা পৃথিবীতে যত সবুজের আন্দোলন, পশুপাখি বাঁচাও আন্দোলন, অস্ত্রবিরোধী আন্দোলন তার সিংহভাগ জুড়ে আছে মেয়েরা। আমরা মেয়েরা তো কোনও দিন কুঠার হাতে নিয়ে গাছ কাটিনি। এ কে ফর্টিসেভেন বন্দুক নিয়ে গণহত্যায় মেতে উঠিনি, বীরত্বের দম্ভে ধরাকে সরা জ্ঞান করিনি, তাই আমরা ভালোবাসতে শিখেছি ’…
বিভিন্ন রিচুয়াল (স্বভাবত পিতৃতান্ত্রিক), যা মেয়েদের পদে পদে বন্দি করে রেখেছে, অপমান ঝরিয়েছে, সেসব নিয়ে ঝলসে উঠেছে মল্লিকার কলম। ‘পুরুষ আমি তো কখনও তোমার বিরুদ্ধে হাত তুলিনি/প্রথম যে দিন সীমন্ত চিরে রক্তচিহ্ন দিয়েছ/ আমার সেদিন ব্যথা লেগেছিল, বলিনি তোমাকে বলিনি…’
কাজের মাসিটির দুরবস্থা নিয়েও মল্লিকার ‘উইটি’ কলম শ্রেণিবৈষম্যকে কী নিপুণভাবে নান্দনিক স্তরে পৌঁছে দিয়েছে। ‘শুধু এই বিবেকবাবু মাঝেমাঝে নাড়ছে ঘেটি/ ওকে নয় ডলার গুনে কিনে নিক অ্যামনেস্টি’।
মেয়েদের জন্য বারুদভর্তি কবিতার পাশে প্রেমও উঠে এসেছে ওর কবিতায়। স্বাভাবিক। কারণ, জীবনের অনেকখানি নিয়ে আছে মল্লিকার সন্তানস্নেহ। আছে স্বামীর প্রতি প্রেম। ভয়ানক অত্যাচারিতার কথা লেখার পাশাপাশি সে মেধা ও হৃদয় দিয়ে গেঁথে তোলে অপরূপ সোহাগশর্বরী। ‘হংসদম্পতির আজ এইখানে সোহাগশর্বরী/ চার হাত ভরে মাটি তুললাম, গাঁথা হল ভিত,/ তির-ধনুকের চিহ্ন আঁকলাম মাটির দেয়ালে,/ দ্বীপ জন্ম নেবে আছ শ্বেত ও প্রবাল ঘূর্ণিস্রোতে।’
মল্লিকার লেখাপত্রের অনেকটাই জুড়ে আছে ইতিহাসচেতনা। আছে পুরুষতান্ত্রিক সব সাবভার্সনকে ডিকনস্ট্রাক্ট করে অসামান্য নির্মাণশিল্প, পুনরায়। আমি তো বলব, সবই রাজনৈতিক কবিতা। শিল্পের মোড়কে মোড়া। ‘আমি ও আমেরিকা’ কবিতার সামনে থেমে আছি আমি এখন। পড়ছি, ‘আমার ছেলের ঘরে মার্কিন পুতুল/ খায় দায় গান গায় বিষলি ধুঁধুল/ ওই বিষ ঢুকে যাবে ছেলের শরীরে/ হিংসার জয়গান বিষমাখা তিরে।’
সম্প্রতি ঢাকা গেছিলাম। আড়ং নামের ডিপার্টমেন্টাল স্টোরটিতে, ওদের মেয়েদের উইংয়ে ঢুকে বিদ্যুচ্চমক খেলল মাথায়। মাথার ওপর জ্বলজ্বল করছে লেখা, ‘হার স্টোরি’। তবে কি মল্লিকা সেনগুপ্তর লেখা কবিতার অভিঘাত সেখানেও পৌঁছে গেছে? মনে আছে, সেই তীব্র পঙক্তিটি?
‘পূর্ব পুরুষেরা একা, একা একা উত্তরপুরুষ/ উত্তরমানুষ নেই, পূর্বনারী নেই আমাদের;/ হিস্ট্রি তো শৌর্যবীর্যে ভরা ‘হিজ স্টোরি’/ আমরা বুঝেছি নারী ছিল না তখন;’
মল্লিকার কবিতার জাদুশক্তি এই এখানেই। অন্তর্নিহিত গূঢ় কথা ছাপিয়ে তার আবেদন সকলের কাছে চলে যায়। চলে যায় রান্নাঘরে, শোওয়ার ঘরে ও মেয়েদের মজলিশে। মেয়েলি হাসিকান্নায় মিশে যায় লেখাপত্রগুলি। যা কখনও কবিতা, কখনও বা কাব্যনাটক। সোশিওলজির ছাত্রী ছিল সে। অধ্যাপিকাও। তাই কত মিথ, কত সোশ্যাল কনটেন্ট, পুরাণ থেকে নেওয়া সাবটেক্সট চমৎকারভাবে লিঙ্গরাজনীতির অন্ধকার মেখে নতুন করে লেখা হয়েছে ওর কলমে। কার্ল মার্কস ও মেয়েদের অবহেলিত তুচ্ছ জীবনযাপনের কী মেধাবী কেমিস্ট্রি বানিয়ে তুলেছিল মল্লিকা, যা আজও মুখে মুখে উচ্চারিত হয়।
‘কখনও বিপ্লব হলে/ পৃথিবীতে স্বর্গরাজ্য হবে/ শ্রেণীহীন রাষ্ট্রহীন আলোপৃথিবীর সেই দেশে/ আপনি বলুন মার্কস, মেয়েরা কি বিপ্লবের সেবাদাসী হবে?’
মল্লিকাকে নিয়ে লিখতে বসে ভাবি, ওর লেখা অনেক অনেক কবিতা যদি পাতায় ঢেলে দিতে পারি, ছাতাপড়া সমাজের কানে, জোরালো কিংবা ভালনারেবল মেয়েদের চেতনায় তুলে দিতে পারি, সে-ই হবে যথার্থ কাজ। রাজলক্ষ্মী দেবী, রাধারানী দেবী, নবনীতা দেবসেন, কবিতা সিংহ, বিজয়া মুখোপাধ্যায়, দেবারতি মিত্র– এঁদের উত্তরনারী মল্লিকা কবিজীবনের উত্তরাধিকার বহন করে নিয়ে চললেও নিজের স্বাতন্ত্র্য বরাবর বজায় রেখেছে। পরবর্তী নারীকবিরা ওর হাত থেকে মশাল তুলে নিয়ে নিজ নিজ রঙের আগুন জ্বেলেছে বটে, কিন্তু মল্লিকা একক। চিন্তনে মননে আলাদা একদম।
আরেকটা কবিতা এখানে পড়ার লোভ সামলাতে পারছি না আমি। আপনারা দেখুন, কেমন হালকা মিষ্টি চালে চলেছে কবিতাখানি। অথচ দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় পাঠের পর কেমন থম মেরে যেতে হয়।শক্ত হয়ে আসে নান্দনিক চোয়াল আমাদের!
‘পাখি এক পাখি দুই/ কংক্রিটের ঘরে এক পাখিলতা প্রহরী আমার/ সারাটা দুপুর একা সন্ধে একা ভাবি বয়ে যাব/ ভাবি নষ্ট মেয়েদের মতো ইশারা ছড়িয়ে দেব জানলায়/ রাত্রি দশটায় বাড়ি আসবে যে মানুষটা রাজ্য জয় করে/…সাজানো জীবনটাকে এলোমেলো করে ওকে বুঝিয়ে ছাড়ব/ দেখো, আমিও মানুষ/ আমিও তরুণী আজও/ আমারও জঙ্গল ভালো লাগে/ পাখি এক পাখি দুই/ দুলে দুলে ঘণ্টা নেড়ে আমার মরণজেদ হাল্কা করে দেয়/…পাখি এক পাখি, দুই দুলে উঠে বলে–/ ওই তোর বর এল রাজ্য জয় করে।’
স্টেফানি ওঁর লেখায়, মেগান রাপিনো-কে দিয়ে বলিয়েছেন, ‘‘we know exactly what’s in a contract every time a man signs it. we never know what women make, why is it? because they’re not something to be proud of. we need to change the narrative.’’
এ কথাগুলো ঘুরেফিরে মনে হয়, মল্লিকা সেনগুপ্তর লেখা পড়ি যখন। এই পরিবর্তিত ন্যারেটিভের কথা। মল্লিকার কবিতা পাঠ্যবইতে স্থান পায়। গবেষক গবেষণা করে। পণ্ডিতেরা অ্যাকাডেমিক আলোচনা চালায়। আমি শুধু ওর লেখা পড়ি বসে বসে। জীবন ও সমাজের সঙ্গে মিলিয়ে নিই বারবার।
আমরা বন্ধু ছিলাম। লেখক মল্লিকাকে আমার অভিবাদন। আর বন্ধুটির জন্য জড়ো করে রেখেছি অনেক আদর। হয়তো একদিন আবার দেখা হবে আমাদের।
ও বলবে, দুষ্টু মিষ্টি হাসি হেসে বলবে, ‘চৈতালী, তুমি যে…’
স্পেশাল ইভেন্টগুলো খুব উপভোগ করতাম, যেমন, নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে সেকেন্ড চ্যানেলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, দিনটি ছিল ১৯ নভেম্বর, ইন্দিরা গান্ধীর জন্মদিন। সেবারের অনুষ্ঠানে কলকাতার বহু নামী শিল্পী যেমন ছিলেন, তেমন ছিলেন বম্বের অনেক নামজাদা সঙ্গীতশিল্পী।