Robbar

বাসের টিকিট ছাপার প্রেস থেকে ছাপা হয়েছিল মণীন্দ্র গুপ্তর প্রথম কবিতা বই

Published by: Robbar Digital
  • Posted:October 24, 2023 12:14 am
  • Updated:October 25, 2023 11:19 pm  

প্রেসের মালিকের তীব্র অনিচ্ছা সত্ত্বেও কাজের পরে নিয়মিত প্রেসে গিয়ে কম্পোজিটারের পাশে বসে কম্পোজ করিয়ে ট্রেড্‌ল মেশিনে ৪ পাতা ৪ পাতা করে ছেপে মণীন্দ্রবাবুর প্রথম একক কবিতার বই ‘নীল পাথরের আকাশ’ প্রকাশিত হয়েছিল। বছরের পর বছর ধরে, প্রথমে ‘এক বছরের শ্রেষ্ঠ কবিতা’র জন‌্য, পরে ‘আবহমান বাংলা কবিতা’র জন‌্য প্রয়োজনীয় অজস্র কবিতা পাতার পর পাতা কপি করে গেছেন। হাতের লেখা ছিল দেখার মতো! নিজের লেখালিখির চেয়ে সম্পাদনার কাজে তাঁর ছিল অফুরন্ত উৎসাহ। পাশাপাশি পছন্দসই ছবি কেটে স্ক্র‌্যাপ বুক তৈরি করা। আজ মণীন্দ্র গুপ্তর জন্মদিন। 

অরণি বসু

হাঁটতে আমার ভাল লাগে। প্রিয় মানুষের সঙ্গ পেলে তো সেই হাঁটা হয়ে ওঠে মনোরম।
মণীন্দ্র গুপ্তর সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয় হয় সাতের দশকের গোড়ায়, কবি দেবারতি মিত্রর বাড়িতে। কবিতা চর্চার সূত্রে সে বাড়িতে আমরা মাঝেমধ‌্যেই যেতাম। আমাদের চেনা গণ্ডির বাইরে সে বাড়ি। বাগান, মার্বেলের পরি পেরিয়ে প্রবেশ করতাম বসার ঘরে। সেই করেই একদিন দেবারতিদি আলাপ করিয়ে দিলেন একজন মাঝবয়সি ভদ্রলোকের সঙ্গে। নাম মণীন্দ্র গুপ্ত। আমি তখন তাঁকে নামে চিনতাম। ‘পরমা’ পত্রিকার সম্পাদক। এই ভদ্রলোক আমাদের চেনা গণ্ডির বাইরে। পিতৃপ্রতিম তাঁর পরনে জিনসের প‌্যান্ট আর হাওয়াই শার্ট। ওঁরই প্রায় সমবয়সি আমাদের বাবা-জ‌্যাঠারা তখন যেরকম পোশাক পরতেন, তার থেকে অনেকটাই আলাদা। সেই আলাপের পর নানা কারণে দীর্ঘকাল তাঁর সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হয়নি। দেবারতিদির সঙ্গেও। অবশ‌্য পত্রালাপ হয়েছিল। ১৯৭৩ ও ১৯৭৫ সালের ‘এক বছরের শ্রেষ্ঠ কবিতা’য় আমার কবিতা পুনর্মুদ্রণের অনুমতির জন‌্য উনি আমাকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন, আমিও যথাসময়ে সেই চিঠির জবাব দিয়েছিলাম। এই পর্যন্তই। বেশ কয়েক বছর পর সম্ভবত ১৯৭৮ সালে ‘অলিন্দ’ পত্রিকার লেখা সংগ্রহ করতে যাই দেবারতিদির বাড়িতে। তখন অবস্থানগত অনেক পরিবর্তন হয়েছে। মণীন্দ্রবাবুকে বিয়ে করে দেবারতিদি চলে এসেছেন গড়িয়াহাট নন্দলাল বসুর ছেলে বিশ্বরূপ বসুর বাড়ির তিনতলায়, একঘরের ভাড়াবাড়িতে। অনেক দিন পর দেখা হওয়ায় দেবারতিদি হইহই করে উঠলেন। মণীন্দ্রবাবুর সঙ্গে পুনরালাপ হল। সেদিন তাঁর পরনে হাফহাতা গেঞ্জি আর লুঙ্গি। অচিরেই সেই আলাপ জমে ক্ষীর। মণীন্দ্রবাবুকে আমার বেশ পছন্দ হল আর ওঁরও মনে হয় আমাকে।

এরপর হাঁটার কথায় আসি। এমন নয় যে, আমি আর মণীন্দ্রবাবু নিয়মিত হাঁটাহাঁটি করেছি। কিন্তু এই শহরের বিভিন্ন প্রান্তে ছাপাছাপির কাজে বা ডাক্তার দেখানোর বা কারওর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া, রামকিঙ্কর সম্পর্কিত তথ‌্যের সন্ধানে, শান্তিনিকেতনের রাস্তায় বা পুরীর সমুদ্র সৈকতে– যখনই সুযোগ পেয়েছি হাঁটার ওঁর সঙ্গে জুড়ে গেছি। হাঁটতে হাঁটতে উনি অনেকরকম গল্প করতেন। অনেক পুরনো জিনিস ও স্থান চেনাতেন। নানারকম তথ‌্য জানাতেন। তবে খুব ব‌্যক্তিগত প্রসঙ্গ এবং পরচর্চা সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলতেন। বাসের টিকিট ছাপার প্রেস থেকে তাঁর প্রথম বই ছাপার কাহিনি– প্রেসের মালিকের তীব্র অনিচ্ছা সত্ত্বেও কাজের পরে নিয়মিত প্রেসে গিয়ে কম্পোজিটারের পাশে বসে কম্পোজ করিয়ে ট্রেড্‌ল মেশিনে ৪ পাতা ৪ পাতা করে ছেপে মণীন্দ্রবাবুর প্রথম একক কবিতার বই ‘নীল পাথরের আকাশ’ প্রকাশিত হয়েছিল। বছরের পর বছর ধরে, প্রথমে ‘এক বছরের শ্রেষ্ঠ কবিতা’র জন‌্য, পরে ‘আবহমান বাংলা কবিতা’র জন‌্য প্রয়োজনীয় অজস্র কবিতা পাতার পর পাতা কপি করে গেছেন। হাতের লেখা ছিল দেখার মতো! নিজের লেখালিখির চেয়ে সম্পাদনার কাজে ছিল অফুরন্ত উৎসাহ। পাশাপাশি পছন্দসই ছবি কেটে স্ক্র‍্যাপবুক তৈরি করা।
হাতের কাজে তাঁর আগ্রহ ছিল প্রবল। আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হওয়ার পরে ওঁকে আমি স্বতোপ্রণোদিত হয়ে ছবি আঁকতে দেখিনি, কিন্তু তরুণ কবিদের আবদারে প্রায়শই তাঁকে কোলাজ বা ছবির জগতে প্রবেশ করতে হত।

মণীন্দ্র গুপ্ত জীবনযাপনে কোনও বাহুল‌্য বরদাস্ত করতে পারতেন না কিন্তু বই এবং লিট্‌ল ম‌্যাগাজিনের ব‌্যাপারে তাঁর কোনও কার্পণ‌্য ছিল না। তবে সেই খরচ হতে হবে ন‌্যায‌্য এবং যুক্তিসংগত। কোনও পত্রিকায় বা বইয়ে অহংকারের ঝনঝনানি তিনি একদম পছন্দ করতেন না। অর্থাৎ, পত্রিকার জোর থাকবে বিষয়বস্তুতে, ভাষার ব‌্যবহারে। তার মানে এই নয় যে, কাগজ জুড়ে দারিদ্রের চিহ্ন থাকবে। আজীবন লিট্‌ল ম‌্যাগাজিনের বন্ধু ও অভিভাবক মণীন্দ্র গুপ্ত বড় কাগজের চৌহদ্দির বাইরেই নিজেকে পরিচিত করিয়েছিলেন। তারঁ যা কিছু স্বীকৃতি সবই শেষবেলায়। এখন প্রায় এমন কোনও পত্রিকা প্রকাশ হয় না, এমন কোনও সাহিত‌্যসভা হয় না যেখানে কোনও না কোনওভাবে মণীন্দ্র গুপ্তর নাম উচ্চারিত হয় না।

সারাজীবন বই, ছবি, কবিতা ও গদ‌্যরচনায় জীবন কাটানো যাঁর, সম্পত্তি বলতে যাঁর শুধুই নির্বাচিত বইয়ের সংগ্রহ, তাঁকে কখন স্বীকৃতি বা খ‌্যাতির দৌড় নিয়ে মাথা ঘামাতে দেখিনি। ‘অক্ষয় মালবেরি’র মতো গ্রন্থ রচিত হয়েছিল বাতিল ছাঁট কাগজে। কবিতার কথা যদি ছেড়েই দিই ‘অক্ষয় মালবেরি’, ‘রং কাঁকর রামকিঙ্কর’ এবং দু’খণ্ডের গদ‌্যসংগ্রহ বাংলা ভাষার গর্ব। যখন মণীন্দ্র গুপ্তের অক্ষর পরিচয় হয়নি তখন থেকেই তাঁর পুস্তকপ্রীতি তিনি নিজেই লিখে গেছেন ‘অক্ষয় মালবেরি’র ৩৫ নং পাতায়। মায়ের বিয়েতে উপহার পাওয়া বই সাজিয়ে বাবু হয়ে বসে দোকানদার-দোকানদার খেলত শিশু মণীন্দ্র গুপ্ত আর সেই খেলা খেলতে খেলতেই– ‘এক একখানা বই তুলে নিয়ে পাতা উল্টে উল্টে নিজেই ছবি দেখতে থাকি। কিছু কিছু ছবির অর্থ বুঝি না– মনে হয়, তাদের মধ‌্যে যেন একটা ঘটনার রহস‌্য লুকিয়ে আছে– পাশের অক্ষরগুলোর গুপ্ত সংকেতে সেই ঘটনা বলা আছে– কিন্তু তখনও আমি অ আ ক খ জানি না। তবে বহুকাল ধরে ওই দোকান করতে করতে বই কিভাবে নাড়াচাড়া করতে হয় খুব ভাল করে শিখেছিলাম– আমার হাতে পাতার একটি কোণও মচকাত না, সাদা কাগজে ময়লা আঙুলের একটু দাগও পড়ত না!’

১৯৯১ সালে ‘উলুখড়’ থেকে যখন মণীন্দ্রবাবুর প্রথম গদ‌্যগ্রন্থ ‘চাঁদের ওপিঠে’ প্রকাশ করার প্রস্তাব দেওয়া হল উনি তীব্র আপত্তি জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন ‘বই বিক্রি হবে না, তোমরা আর্থিক ক্ষতির মধ‌্যে পড়বে, সেটা আমি মানতে পারি না।’ তখন ভাস্কর চক্রবর্তীর ‘প্রিয় সুব্রত’র প্রকাশক হওয়ার অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। বললাম, ‘চিন্তা করবেন না। আমরা চাঁদা তুলে প্রকাশ করব। অসুবিধে হবে না।’ উনি মানলেন না। শেষ পর্যন্ত ঠিক হল খরচের অর্ধেক অন্তত উনি বহন করবেন। আমরা এখনও শুনতে পাই সেই সময়ের তরুণ কবিদের কাছে বইটি কীভাবে আদৃত হয়েছিল এবং আজও তাই। শুধু অর্ধেক খরচ বহন করা নয়, উনি প্রকাশকের দায়িত্বের অনেকটাই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। অসাধারণ প্রচ্ছদ নির্মাণ করা, প্রুফ দেখা, আমার সঙ্গে প্রেসে যাওয়া এমনকী, সুব্রত বন্দ‌্যোপাধ‌্যায়ের ওয়েলনোন প্রিন্টার্স-এ সারাক্ষণ ট্রেড্‌ল মেশিনের পাশে দাঁড়িয়ে প্রচ্ছদ মুদ্রণ তদারক করেছিলেন। লিখতে লিখতে দেখতে পাচ্ছি ‘ওয়েলনোন প্রিন্টার্স’-এর ট্রেড্‌ল মেশিনের পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা মণীন্দ্র গুপ্তকে। শান্তিনিকেতনে শঙ্খ চৌধুরীর যে বাড়িতে রামকিঙ্কর শেষ জীবনে থাকতেন, সেই বাড়ি বিক্রি হয়ে গেছে কিন্তু যিনি সেই বাড়ি কিনেছেন তিনি এই বাড়ির নাম রেখেছেন ‘রামকিঙ্কর’, চোখ বুজলে আজও দেখতে পাই– সেই বাড়ির গ্রিলের গেট ধরে দাঁড়িয়ে থাকা মণীন্দ্র গুপ্তকে।

যাঁরা মণীন্দ্র গুপ্তর মতো মানুষদের সঙ্গ করেছেন, তাঁরা জানেন এঁরা সহজ মানুষ নন। এঁরা কখনও তাঁদের নামের আগে ‘স্বর্গীয়’ বসাতে দেন না।

আমি যখন একা একা রাস্তা দিয়ে হাঁটি, কোনও সমস‌্যার মধ‌্য দিয়ে হাঁটি, আমি জানি আমি একা নই, আরও ক’জন আছেন আমার সঙ্গে, এক. বাবা পঙ্কজকুমার বসু, দুই. শিল্পী শৈবাল ঘোষ, তিন.কবি সুব্রত চক্রবর্তী এবং অবশ‌্যই মণীন্দ্র গুপ্ত।