এদেশের রাজায় রাজায় ভারি কাজিয়া-কোন্দল। কোটি কোটি মানুষকে রক্তাক্ত করে তাদের বুকের উপর দিয়ে ছড়িয়ে পড়ে কাঁটাতার। নির্ধারিত হয় তিন দেশের সীমান্ত। ভারত, পূর্ব-পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তান। তবু, সুরের তো দেশ নেই, রাজধানী নেই। না আছে জেলা, মফসসল আর ঝাঁ-চকচকে শহুরে ঘরবাড়ি। সেখানে সবই মুক্তাঞ্চল। সকলের অবাধ বিচরণ। তাই হয়তো ২০ বছর বয়সে পার্টিশনের ধাক্কায় রাজস্থান ছেড়ে পাকিস্তান চলে গেলেও সুর মেহদি হাসানকে ছেড়ে যায়নি।
‘কেসরিয়া বালম, আও রি, পাধারো মারে দেস।’
রাজস্থানি মাঢ়ে সুর লাগালেন শেহেনশা-এ-গজল। মরু দেশের রুখা জমিন। রাত চাঁদনি হলে চারিদিক ধুয়ে যায় দুধসাদা জ্যোৎস্নায়। বালির ওপার থেকে শোনা যায় মৃদু রাবণাত্মার সুর। সেসব রাতে রাজস্থানের লুনা গ্রামে হানা দেয় এক সদ্য কিশোর। নাম মেহদি। কণ্ঠস্বরে বয়ে নিয়ে আসে এক আস্ত মহাফেজখানা। সেখানে কতশত ‘ব্যথা বিচ্ছেদের কাহিনি ধূসর’। সারি সারি ট্রেন ছুটে যায়। তার চারিদিকে মানুষ। পরিবার-পরিজন নিয়ে তারা চলেছে ইতিহাসের এক মহাচক্রান্তে শামিল হতে। নাম তার, পার্টিশন।
এদেশের রাজায় রাজায় ভারি কাজিয়া-কোন্দল। কোটি কোটি মানুষকে রক্তাক্ত করে তাদের বুকের ওপর দিয়ে ছড়িয়ে পড়ে কাঁটাতার। নির্ধারিত হয় তিন দেশের সীমান্ত। ভারত, পূর্ব-পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তান। তবু, সুরের তো দেশ নেই, রাজধানী নেই। না আছে জেলা, মফসসল আর ঝাঁ-চকচকে শহুরে ঘরবাড়ি। সেখানে সবই মুক্তাঞ্চল। সকলের অবাধ বিচরণ। তাই হয়তো ২০ বছর বয়সে পার্টিশনের ধাক্কায় রাজস্থান ছেড়ে পাকিস্তান চলে গেলেও সুর মেহদি হাসানকে ছেড়ে যায়নি।
নতুন দেশে সীমাহীন ভালোবাসার পরিবর্তে দেখা দিল প্রবল অর্থকষ্ট। তবু বাঁচার লড়াই তো থেমে থাকে না! মোটর মেকানিকের কাজ করে দিন গুজরান করতে লাগলেন মেহদি। কিন্তু গানের চর্চা বজায় রইল পুরোদমে। কলাবন্ত পরিবারের সন্তান তিনি। তালিম পেয়েছেন ধ্রুপদ, খেয়াল আর ঠুমরির। তার চর্চায় বিন্দুমাত্র খামতি দেখা দেয়নি কোনও দিন।
অবশেষে বিস্তর পরিশ্রমের পর ১৯৫৭ সালে তিনি ডাক পেলেন রেডিও পাকিস্তানে। সুরজগৎ পেল তার গজল শেহেনশাকে। তবু কৈশোর তাঁর মধ্যে ছিল, আজীবন। খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে ভরা প্রেক্ষাগৃহে যখন তিনি গেয়েছিলেন রাজস্থানের লোকসংগীত, ‘কেসরিয়া বালম’, তখন পশ্চিম অঙ্গের যাবতীয় তান-কর্তব নিয়ে লাহৌরের সকল রাস্তাঘাট যেন যোধপুরে গিয়ে মিশেছিল। শুরু হল সুধা আর অমলের জীবন্ত কথালাপ। মেহদির বাল্যকালের রাজস্থান যেন সুধার মতো মনে রেখে দিয়েছিল তাঁকে। বার্ধক্যে এসে সেই স্মৃতিই সুর হয়ে ঝরে পড়ল।
আসলে সুরের তো কোনও সীমান্ত নেই। না আছে ধর্মের ভেদাভেদ। একবার এক সাক্ষাৎকারে উস্তাদ রশিদ খাঁ গেয়ে শুনিয়েছিলেন রাগ দুর্গার এক বন্দিশ, ‘এ মেরে দুর্গা মাতা, দর্শন দিয়ো আপনে ভগৎ কো’। সে বন্দিশ রচনা করেছিলেন আগ্রা ঘরানার উস্তাদ লতাফৎ হুসেন খাঁ।
এমন ঘটনা নতুন নয়। ভারত এমনই এক দেশ যেখানে মুসলমান ওস্তাদদের হাতে রচিত হয়েছে হিন্দু দেবদেবীদের নিয়ে বন্দিশ। এ দেশে বাস করেই উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খাঁ পাহাড়ি রাগ গেয়েছিলেন, ‘হরি ওম তৎ সত’। সে গান শুনে কট্টর হিন্দুত্ববাদী, এক কথায়, মুসলমান বিদ্বেষী, পণ্ডিত ওঙ্করনাথ ঠাকুরের চোখেও জল চলে এসেছিল। উস্তাদ আমির খাঁ মালকোশ রাগের বিলম্বিতে গেয়েছিলেন, ‘জিনকে মন রাম বিরাজে’।
যে কোনও সৃষ্টিই আসলে ধর্ম বা সীমান্তের বেড়াজালকে অতিক্রম করে যায়। তাই উস্তাদ শরাফত হুসেন খাঁ থেকে আরম্ভ করে উস্তাদ খাদিম হুসেন খাঁ পর্যন্ত সকলেই ইমনকল্যাণ রাগে গান, ‘দরশন দেহো শঙ্কর মহাদেব।’ হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে টোরি রাগে গাওয়া হয়, ‘অব মোরি নইয়া পার করো তুম, হজরত নিজামুদ্দিন অউলিয়া’। নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ রচনা করেন উর্দু ভাষার প্রথম নাটক, ‘রাধা কনহাইয়া কা কিসসা’। রাজস্থানে হিন্দুর দ্বারা রচিত হয় মর্সিয়া, ‘মহারাজা সুরাট সিনঝি রা মারাসিয়া’।
মেহদি হাসানের সুরে মিলেছিল দুই দেশের আত্মা। ভারত-পাকিস্তানের আপাত বিচ্ছেদ ভুলিয়ে তাদের এক সুরক্ষেত্রে এনে ফেলেছিলেন তিনি। কিন্তু এ কারবার হয়ে আসছে জন্ম-জন্মান্তর ধরে, প্রাকৃতিক নিয়মে।
বাল্যকালের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘জ্যোতিদাদা তখন প্রত্যহই প্রায় সমস্ত দিন ওস্তাদি গানগুলোকে পিয়ানো-যন্ত্রের মধ্যে ফেলিয়া তাহাদিগকে যথেচ্ছ মন্থন করিতে প্রবৃত্ত ছিলেন। তাহাতে ক্ষণে ক্ষণে রাগিনীগুলির এক-একটি অপূর্ব মূর্তি ও ভাবব্যঞ্জনা প্রকাশ পাইত।’
বেমানান যন্ত্রের এমন অপ্রত্যাশিত সুরের সন্ধান ‘In Search of Theatre’ নামে উৎপল দত্তর এক তথ্যচিত্রেও মেলে। হেরেসিম লেবেদেফ সেখানে সদ্য কেদার শিখে পিয়ানোতে তার চর্চা করছেন। রিডের চাপে আলোর মতো এলিয়ে পড়ছে মধ্যম আর পঞ্চম সম্মিলিত ধৈবত। কেদার যেন তখন খাস বিলিতি ধুন। দেশি ছাপ রেখে গেছে শুধু ধৈবতের মীর।
আবার যাঁরা আফ্রিকান গায়ক, আলি ফরকা তুরের গান শুনেছেন, তাঁরা জানবেন তাঁর কিছু গানে কী অনায়াসে ছায়া পড়ে বৃন্দাবনী সারংয়ের। হয়তো তিনি কোনও দিন শোনেননি সে রাগ। অথচ তার এলাকার লোকগানের চলনে সে জুড়ে আছে।
‘Morphology of The Folktale’ গ্রন্থে ভ্লাদিমির প্রপ বলছেন কিছু আদি আখ্যানের কথা। তাদের থেকেই নাকি জন্ম নিয়েছিল পৃথিবীর যাবতীয় গল্পগাথা। তেমনই সুরেরও রয়েছে কিছু আদি। মানুষের জন্মলগ্নে তারা ছিল। তারপর ছড়িয়ে পড়ল, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। কোথাও মালকোশ হয়ে। কোথাও পেরুর লোকসংগীত হয়ে।
১৯৭৪ সালে উত্তর ইথিওপিয়ায় আবিষ্কৃত হয় এক অস্ট্রালোপিথেকাসের কঙ্কাল। বৈজ্ঞানিকরা তাকেই মানবজাতির প্রথম মা বলে মনে করেন। অচিরেই বিটলস-এর একটি গান থেকে ধার করে এই অস্ট্রালোপিথেকাসের নাম রাখা হয় লুসি। সুরেরা আসলে আমাদের প্রথম মা, লুসির মতো। যার দুধের গন্ধ আমাদের প্রত্যেকের মুখে লেগে আছে। যতদিন বাঁচব, থাকবে। সুরের দেশভাগ হয় না।