ঈশ্বরের তৈরি প্রথম মেয়েই ঈশ্বরকে অসম্মান করেছে। আজও যারা পুরুষ-সমাজের নিষেধ ও আজ্ঞাকে মেনে চলছ, জেনে রেখো সেই প্রথম মেয়ের উত্তরাধিকার আমরা। আমাদের কৌতূহলই আমাদের চেতনার উৎস। অগম্যগমনই আমাদের একমাত্র পথ। আমরাই ঈশ্বরের প্রথম অপমান। যে কোনও পুরাণেই প্রথম নারীর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে পাপ ও স্খলনের ইঙ্গিত, যুদ্ধের কুমন্ত্রণা, মৃত্যুর সম্ভাবনা। সে লিলিথ হোক কি ইভ, প্যান্ডোরা হোক কি হেলেন, বা আমাদের মনসা।
একটা বাক্স আদতে রহস্যই। যতক্ষণ না তা খোলা হয়। ততক্ষণ সম্ভাবনাময়, ততক্ষণ জেগে থাকা, ততক্ষণই আশাবাদ। তাই বাক্সটা খুলতেই হবে, জানতে হবে কোন ইশারা তাতে লুকনো রয়েছে। তর্কের খাতিরে না হয় ধরেই নিলাম সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা ভেঙেচুরে বেরিয়ে আসবে দুঃসময়, ভয়, মৃত্যুমুখী প্ররোচনা, ঈশ্বরের অনীহা। তবুও বাক্সটা খোলা দরকার ছিল। কারণ সমস্ত নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে একটি মেয়ে সেদিন সেই বাক্সটা খুলেছিল। ঈশ্বর-সৃষ্ট প্রথম মেয়ে এই সাহস দেখিয়েছিল। প্রথম অবাধ্যতা। প্রথম ঈশ্বর-পুরুষের বিরুদ্ধতা। প্রথম নারীচেতনা। প্রথম স্বাধীনতা। প্রথম আলোয় ফেরা।
তাই বাক্সটা খোলার দরকার পড়েছিল। আর বাক্স থেকে বেরিয়ে পড়েছিল ভয়হীন তর্জনী। যা তাক করেছিল পুরুষের সাজানো সংসারের দিকে, তাদের লীলাক্ষেত্রে। সত্যিই তো, পুরুষের যাবতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষা সেদিন ভেঙেচুরে গেছিল। নারীহীন সমাজে, প্রশ্নহীন সমাজে, যুক্তিহীন সমাজে, হৃদয়হীন সমাজে নির্দ্বিধায় বেঁচে ছিল পৌরুষের অহংকার। মেনে নিয়েছিল কোনও এক সর্বশক্তিমানের কর্তৃত্ব। বাক্সটা খুলে ফেলায় দুঃসময় এসে হাজির হয়। কারণ অনন্ত প্রশ্ন ও দ্বন্দ্ব নিয়ে এসেছিল একটি মেয়ের কৌতূহল। যে কৌতূহলের তাড়নায় প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতার কাঠামো নড়ে গেছিল। উঠে এসেছিল জ্ঞানের ক্ষুধা। না-জানার প্রতি তীব্র আকর্ষণ। ভয় ধরিয়েছিল চিরাচরিত স্থিতিশীলতায়। সর্বশ্রেষ্ঠ, আজ তোমার ভয় পাওয়ারই কথা, কত যত্নে সাজিয়েছিলে বাগান, কৌতূহলকে বাক্সবন্দি করে, তোমার প্রশ্নহীন ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেছিলে। সৃষ্টিকর্তা, তোমার নিরাপদ নকশায় আজ ধুম লেগেছে।
জিউসের প্রিয় সৃষ্টি, প্রথম মেয়ে, প্যান্ডোরা, আজ বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। প্রমিথিউস যখন স্বর্গ থেকে আগুন চুরি করে এনে মানুষকে দেয়, ক্রুদ্ধ জিউস তাকে শাস্তি দিতে মনঃস্থির করে। শুধু প্রমিথিউসকেই নয়, সমগ্র মানবজাতিকেই। তাই জিউস তৈরি করেন প্যান্ডোরাকে, প্রথম নারীকে, মানবজাতির শাস্তিস্বরূপ। প্রমিথিউসকে পাথর দিয়ে বেঁধে রাখা হয়, এবং এক ঈগলকে পাঠানো হয় তাকে ঠুকরে ঠুকরে খেয়ে ফেলার জন্য। আর নারীকে তৈরি করা হয় পুরুষের জন্য। প্যান্ডোরাকে পাঠানো হয় প্রমিথিউসের ভাই এপিমিথিউসের সঙ্গিনী হিসেবে। প্যান্ডোরা এপিমিথিউসের কাছে গেছিল একটা বাক্স নিয়ে, যা তাকে উপহার দিয়েছিলেন জিউস নিজে। জিউস জানতেন যে এই বাক্সটা না-খোলার সাবধানবাণী পুরুষেরা মেনে চলবে, কিন্তু প্যান্ডোরার মনের হদিশ পাননি জিউস। কারণ অবাধ্যতার হিসেব তাঁর কাছে স্পষ্ট ছিল না। কোনও কারণ ছাড়াই, কারও প্ররোচনা ছাড়াই, কারও মন্ত্রণা ছাড়াই যে প্যান্ডোরা একদিন স্রেফ কৌতূহলের বশে বাক্সটা খুলে ফেলবে, এমন পূর্বচেতনা এমনকী ঈশ্বরেরও ছিল না। আনুগত্যে অভ্যস্ত ঈশ্বর আসলেই বোকা বনে গেছিলেন। ঈশ্বরের তৈরি প্রথম মেয়েই ঈশ্বরকে অসম্মান করেছে। আজও যারা পুরুষ-সমাজের নিষেধ ও আজ্ঞাকে মেনে চলছ, জেনে রেখো সেই প্রথম মেয়ের উত্তরাধিকার আমরা। আমাদের কৌতূহলই আমাদের চেতনার উৎস। অগম্যগমনই আমাদের একমাত্র পথ। আমরাই ঈশ্বরের প্রথম অপমান। যে কোনও পুরাণেই প্রথম নারীর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে পাপ ও স্খলনের ইঙ্গিত, যুদ্ধের কুমন্ত্রণা, মৃত্যুর সম্ভাবনা। সে লিলিথ হোক কি ইভ, প্যান্ডোরা হোক কি হেলেন, বা আমাদের মনসা।
তো বাক্স থেকে সেদিন যা বেরিয়েছিল, তা নিয়ে লোকে কী বলে, থুড়ি মিথ কী বলে? বলে প্যান্ডোরা সেদিন জিউসকে অমান্য করে বাক্সটা খুলেছিল বলেই পৃথিবীর ভারসাম্য নষ্ট করে উঠে এসেছিল পাপ, স্থিরতাকে নাড়িয়ে দিয়ে ব্যাপ্ত হয়েছিল প্রকাণ্ড নৈরাজ্য, নিঝুম পাড়ায় অচেনা চিৎকার শোনা গেছিল, নীরবতা ভেঙে খানখান হয়ে গেছিল, গাঢ় অন্ধকারে মিলিয়ে গিয়েছিল সূর্য। কিন্তু কবি তো বলেই গিয়েছেন গ্রহণের সূর্যের দিকে তাকানো সহজ। সেদিন আসলে সূর্যগ্রহণ শেষ হয়ে পূর্ণ সূর্য উঠেছিল, নতুন সূর্য, নতুন উপাখ্যান। যে মেয়েকে সব দোষের ভাগীদার করা হল, সেই মেয়ে ছিল নারীবাদী আখ্যানের প্রথম বাক্য। সে ইতিহাস যাই বলুক, এতদিনে আমরা তো জেনে গেছি ইতিহাস আসলে একপাক্ষিক, পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি, ক্ষমতার ভাষ্য, পুঁজিবাদের ধারক-বাহক, কোম্পানির দাস। তাই নিজেদের ইতিহাস নিজেরা লিখতে চলে এসেছি আমরা। স্খলনের দায় গর্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছি। বেশ করেছি ওয়ার্ল্ড অর্ডার ভেঙেছি। ওই বাক্সেই ছিল নারীর জ্ঞান, জ্ঞানের ক্ষুধা, অন্য দৃষ্টিভঙ্গি, একটি মেয়ের কামনা-বাসনা, প্রশ্নহীন ক্ষমতাকে অবজ্ঞা করা, পুরুষ-শোভিত দেশের একঘেয়েমিতে বিরক্ত হওয়া, আরেক পা বাড়ানোর স্বাভাবিক দায়।
তাই ইতিহাসের মোড় ঘোরানো সব আবিষ্কারের মূলসূত্রে রয়েছেন মেয়েরা, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁদের কাছেপিঠে থাকা পুরুষেরা তার কৃতিত্ব নিয়ে বিস্ময়ের তালিকায় নাম লিখিয়েছে। সেই তালিকা খতিয়ে দেখা হচ্ছে আজকাল। তাই ভেরা রুবিন, মার্গারেট নাইট, গ্রেস মারি হপারদের কথা, কাজ ও হারিয়ে যাওয়া-গুলো জানতে পারছি। কয়েকজনের নাম জানা গেছে। আরও কত নাম জানা বাকি। কত ‘চিরাচরিত’ ইতিহাস পালটে যেতে পারে যে কোনও মুহূর্তে।
জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী ভেরা রুবিন প্রথম বায়ুমণ্ডলে ডার্ক ম্যাটারের সন্ধান পান, কিন্তু ছয়ের দশকে তাঁর কথা শোনার মতো কেউ ছিল না। এস্থার লেডারবার্গ জিন কীভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় তা জানিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর বিজ্ঞানী স্বামী এই কৃতিত্ব নিয়ে ১৯৫৮-এ নোবেল পুরস্কার পান। জোসেলিন বেল বার্নেল অনিয়মিত রেডিও পাল্সের সন্ধান পেয়ে তাঁর অধ্যাপকদের জানান, যেখান থেকে নিউট্রন স্টারের খোঁজ পাওয়া যায়। কিন্তু তাঁর দুই অধ্যাপক ১৯৭৪-এ এজন্য নোবেল পুরস্কার পান। ম্যানহ্যাটন প্রোজেক্টে ইউরেনিয়ামকে আলাদা করার উপায় আবিষ্কার করেন বিজ্ঞানী শিয়েন শিউং উ। তাঁর পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ইন্টার্যাকশন নিয়ে পরীক্ষা সফল হয়। ১৯৫৭ সালে তাঁর দুই সহকর্মী এই সাফল্যের জন্য নোবেল পুরস্কার পান। ১৮০০ সালে আদা লাভলেস প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামের নির্দেশাবলি লেখেন। কিন্তু এক বিরাট মাপের অঙ্কবিদ সেটা হাতে-কলমে করায় তাঁর নামেই প্রচারিত হয় এই সাফল্য। ক্যাথরিন জনসন ১৯৬১ সালে মহাকাশযান ফ্রিডম ৭-এর নিখুঁত আকাশপথ বাতলে দিয়েছিলেন। পরে অ্যাপোলো-১১ ওই পথেই ১৯৬৯-এ চাঁদে অবতারণ করে। কিন্তু তাঁর পুরুষ সহকর্মীরা সে খবর বাইরে বেরতে দেয়নি। বরং নিজেরা সেই কৃতিত্ব নিয়েছে। মেরি অ্যান্ডারসন গাড়ির উইন্ডশিল্ড আবিষ্কার করেন, ১৯০৩ সালে তাঁর এই আবিষ্কার তিনি নানা কোম্পানিকে বিক্রি করার চেষ্টা করেন, কিন্তু তাঁকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। ৫০ বছর পর আরও দ্রুত গাড়ি এসে যাওয়ায় দরকার পড়ে ওই উইন্ডশিল্ডের। কিন্তু ততদিনে মেরির পেটেন্ট অতিক্রান্ত। অনেক পরে এক পুরুষ আবিষ্কারক সেই পেটেন্ট নিয়ে নেয় ও হাততালি কুড়োয়। জেলডা ফিটজেরাল্ডের লেখা নিজের নামে চালিয়ে তাঁর স্বামী একসময় বিরাট খ্যাতি পেয়েছিল। কিন্তু জেলডা ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নন, একদিন প্রকাশ্যে সে কথা জানান ও আইনি পদক্ষেপ নেন। মার্গারেট কিনের আঁকা ছবিগুলো নিজের নামে বিক্রি করত তাঁর স্বামী। শেষমেশ কোর্টে বিচারকের সামনে ছবি এঁকে প্রমাণ করতে হয় শিল্পী আসলে তিনিই।
কত নাম… কত আবিষ্কার… কত পথ হারিয়ে গেছে শুধু তা মেয়েদের কৃতিত্ব বলে। ইতিহাস নতুন অক্ষরে লেখার চেষ্টা শুরু হয়েছে যখন, তখন নিশ্চয়ই সব হারিয়ে যাওয়া মেয়েদেরই খোঁজ পাওয়া যাবে। কিন্তু কত কত মেয়েকে তো সুযোগই দেওয়া হয়নি। কত মেয়েকে বাড়িতে আটকে রাখা হয়েছে। আজও। যদি প্যান্ডোরার কৌতূহলকে মান্যতা দেওয়া যেত, তাহলে হয়তো এই পৃথিবীর অর্জিত জ্ঞান কোনও নাগরিককে ‘বেআইনি’ তকমা দিত না। নারীর জ্ঞান কখনও ফসলি খেতে কারখানা বানাত না, নারীর জ্ঞান খনিজ সম্পদ ধ্বংস করত না, পাহাড় কেটে খাদান বানাত না, জঙ্গল কেটে, বন্যপ্রাণী মেরে কোম্পানিকে বিক্রি করত না, মানুষ কখনও সংখ্যালঘু হত না, কোনও মানুষ অচ্ছুত হত না, সাংবাদিক খুন হত না, মেয়েরা নিজেদের হীনমন্য ভাবত না, মেয়েরা পণ্যায়িত হত না। ফিলিস্তিনি শিশুর লাশের পাপ তো প্যান্ডোরার নয়, প্যান্ডোরার সৃষ্টিকর্তার, প্যান্ডোরার ওপর কর্তৃত্ব ফলানো পৌরুষের। নারীর অর্জিত জ্ঞান সৃষ্টির পক্ষে, গঠনের পাশে, মাঠভরা ফসলের পক্ষে, দূষণহীন বাতাসের পক্ষে, সহাবস্থানের পক্ষে, প্রকৃতির কাছে সমর্পণের পক্ষে।
বলা হয়, প্যান্ডোরার বাক্সে নাকি এখন শুধু প্রত্যাশা রাখা আছে। কিন্তু কেউ বাক্সটা খোলে না। কেউ সাহস দেখায় না। যে পুরাণকথা শেষ হয় একটি মেয়ের জানার খিদেকে নিয়ন্ত্রণ করে, সেই পুরাণকথার বিশেষ দ্রষ্টব্যে যদি আশাবাদ থেকে থাকে, তবে সেই বাক্স এখনও খোলা হয়নি কেন? তার মানে এতদিন যে গল্প বলা হয়েছে, সেটা আদ্যন্ত মিথ্যে।
পুরাণ তবে প্রোপাগান্ডা। মিথ তবে বিকৃত। ইতিহাস তবে পূর্বপরিকল্পিত। ভবিষ্যৎ তবে বোমারু বিমানের ওড়াউড়িতে নিহিত।
……………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………….