পাই কী শুধু বিজ্ঞানেই কাজে লাগে? অনেক গল্প উপন্যাস বা সিনেমাতে পাই এসেছে, অবশ্য কল্পবিজ্ঞানেই বেশি। বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানপ্রচারক কার্ল সাগানের লেখা একমাত্র উপন্যাস ‘কন্টাক্ট’–এ পাই–এর এক বড় ভূমিকা ছিল। টেলিভিশন সিরিয়াল ‘স্টারট্রেক’–এ এক পাগল কম্পিউটারকে সামলাতে মিস্টার স্পক তাকে পাই-এর শেষ অঙ্কটি বার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, তা করতে গিয়ে সে কার্যত অচল হয়ে পড়েছিল। ‘দি লাইফ অফ পাই’–তে মুখ্য চরিত্র নিজের ডাকনাম দিয়েছিল পাই।
আমেরিকানদের মতো মাসকে তারিখের আগে লিখলে মার্চ মাসের ১৪ তারিখকে লিখব ৩.১৪। ছোটবেলাতে আমরা সবাই পড়েছি যে বৃত্তের পরিধি ও ব্যাসের অনুপাত হল গণিতের সব থেকে পরিচিত ধ্রুবক– ‘পাই’। পরিধিকে গ্রিক ভাষায় বলে পেরিফেরি, তাকে সংক্ষেপে যেভাবে লেখা হত, সেখানে থেকেই এই চিহ্ন এসেছে। পাইয়ের মানকে দশমিক পদ্ধতিতে খুব ছোট করে লিখলে ওই ৩.১৪ সংখ্যাটাই আসে, তাই আজকের দিনটাকে বলা হয় ‘পাই দিবস’। ১৯৮৮ সাল থেকে এই দিবস পালন শুরু হয়েছে, শুরু করেছিলেন সান ফ্রান্সিসকোর এক মিউজিয়ামে কর্মরত বিজ্ঞানী ল্যারি শ।
বিজ্ঞানে কত জায়গায় যে পাইয়ের ব্যবহার হয় লিখে শেষ করা যাবে না। গণিতজ্ঞরা পাই-কে বলেন তুরীয় সংখ্যা, অবশ্য তার বিশদ ব্যাখ্যাতে যাওয়ার দরকার আমাদের নেই। আপাতত একটা কথা মনে রাখলেই হবে, পাই-কে দুটো পূর্ণ সংখ্যার অনুপাত হিসেবে প্রকাশ করা যায় না; দশমিকে লিখলে শেষ হবে না, বা একই রকম কয়েকটা অঙ্কের (digit) প্যাটার্ন ফিরে ফিরে আসবে না। অবশ্য কাজের জন্য আমাদের কয়েক ঘর পর্যন্ত লিখেই ক্ষান্ত দিতে হয়, যেমন দশমিকের পরে ছ’ ঘর পর্যন্ত লিখলে পাইয়ের মান হবে ৩.১৪১৫৯২৬…।
পাই হল, আমাদের জানা প্রাচীনতম ধ্রুবক। হিসাবের সুবিধার জন্য অনেক সময়েই পাইকে ৩ ধরে নেওয়া হত, বাইবেল বা মহাভারতের ভীষ্ম পর্বে তার উদাহরণ আছে। তবে তার অনেক আগেই পাই-এর অপেক্ষাকৃত নিখুঁত মান নির্ণয় করা হয়েছিল। খ্রিস্ট জন্মের প্রায় দু’হাজার বছর আগে ব্যাবিলনের এক ট্যাবলেট থেকে দেখা যায় পাইয়ের মান ৩.১২৫, আবার তার ১২০০ বছর পরে ‘শতপথ ব্রাহ্মণ’-এও একই মানকে দেখতে পাই। মনে হয় বৃত্তের পরিধি ও ব্যাসের অনুপাত মেপে এই মাপগুলো বের করা হয়েছিল। পাইয়ের মান নির্ণয়ের সব থেকে পুরানো গাণিতিক পদ্ধতি প্রাচীন যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আর্কিমিডিসের লেখাতে পাওয়া যায়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
স্মৃতি থেকে পাইকে কত নিখুঁত ভাবে বলা যায়, তারও রেকর্ড রাখা হয়। ১৯৮১ সালে রাজন মহাদেবন স্মৃতি থেকে পাইয়ের ৩১,৮১১টি অঙ্ক মুখস্থ বলেছিলেন; ২০০৫ সালে লু চাও বলেছিলেন ৬৭,৮৯০টি অঙ্ক! আর ২০১৫ সালে রাজবীর মিনা ৭০,০০০টি অঙ্ক ঠিকঠাক বলে ‘গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’–এ নিজের নাম তুলেছেন। এমন বইও আছে যাতে শুধু পাইয়ের প্রথম দশ লক্ষ অঙ্ক ছাপানো হয়েছে। পাইয়ের প্রতি এই ধরনের আকর্ষণকে কেউ কেউ ‘পাইম্যানিয়া’ বলে থাকেন।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
পাই ভারতীয় গণিতবিদদের আকৃষ্ট করেছিল। আর্যভট্ট পঞ্চম শতাব্দীতে দশমিকের পরে তিন ঘর পর্যন্ত পাইয়ের মান বের করেছিলেন, তবে সেটা প্রাচীন যুগের রেকর্ড নয়, কারণ তার কয়েক বছর আগেই চিনের গণিতজ্ঞ ঝু চংঝি সাত ঘর পর্যন্ত সঠিক মান বার করেছিলেন, সেই মানটাই আগের অনুচ্ছেদে লেখা আছে। চংঝি-র পরে সেই রেকর্ড সত্যিই ভারতীয়দের দখলে গিয়েছিল। চতুর্দশ শতাব্দীতে সংগ্রামগ্রামের (বর্তমান কেরালার ইরিঞ্জালকুড়া) বিখ্যাত গণিতজ্ঞ মাধব অসীম শ্রেণি ব্যবহার করে পাইয়ের মান দশমিকের পরে দশ ঘর পর্যন্ত ঠিকঠাক পেয়েছিলেন; তার ২০০ বছর পরে জার্মান গণিতজ্ঞ গটফ্রিড লাইবনিজ্ একই পদ্ধতি আবার আবিষ্কার করেছিলেন। মাধব ও তাঁর অনুসারীরা গণিতের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু আবিষ্কার করেছিলেন, ক্যালকুলাসের বেশ কিছু আদি নমুনা তাঁদের কাজের মধ্যে পাওয়া যায়। তবে তা ইউরোপের গণিতবিদদের প্রভাবিত করেছিল কি না সে-বিষয়ে এখনও কোনও নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়নি।
মনে হতেই পারে দশ ঘরই যথেষ্ট, তার থেকে বেশি যাওয়ার কী দরকার? বিজ্ঞানীরা অবশ্য আরও অনেক নিখুঁত মান চান, তবে সেই প্রয়োজনেরও সীমা আছে। কিন্তু তাতে সকলের মন ওঠে না। তাই পাই-এর আরও নিখুঁত মানের জন্য প্রতিযোগিতা চলে, সুপার-কম্পিউটার ব্যবহার করা হয়। গত বছর দশমিকের পরে এক কোটি কোটি অঙ্ক নির্ণয় করা গেছে। এর জন্য কম্পিউটারে যে চুডনোভস্কি অ্যালগরিদম লেগেছিল তার সঙ্গেও আমাদের দেশের যোগ আছে; তা শ্রীনিবাস রামানুজনের গবেষণার ওপর নির্মিত।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: একজন লেখকের অঙ্ক শেখা দরকার, বলেছিলেন কমলকুমার
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
স্মৃতি থেকে পাইকে কত নিখুঁত ভাবে বলা যায়, তারও রেকর্ড রাখা হয়। ১৯৮১ সালে রাজন মহাদেবন স্মৃতি থেকে পাইয়ের ৩১,৮১১টি অঙ্ক মুখস্থ বলেছিলেন; ২০০৫ সালে লু চাও বলেছিলেন ৬৭,৮৯০টি অঙ্ক! আর ২০১৫ সালে রাজবীর মিনা ৭০,০০০টি অঙ্ক ঠিকঠাক বলে ‘গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’–এ নিজের নাম তুলেছেন। এমন বইও আছে যাতে শুধু পাইয়ের প্রথম দশ লক্ষ অঙ্ক ছাপানো হয়েছে। পাইয়ের প্রতি এই ধরনের আকর্ষণকে কেউ কেউ ‘পাইম্যানিয়া’ বলে থাকেন। এই লেখাটা হয়তো তার একটা ছোট্ট নমুনা।
পাই কী শুধু বিজ্ঞানেই কাজে লাগে? অনেক গল্প উপন্যাস বা সিনেমাতে পাই এসেছে, অবশ্য কল্পবিজ্ঞানেই বেশি। বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানপ্রচারক কার্ল সাগানের লেখা একমাত্র উপন্যাস ‘কন্টাক্ট’–এ পাই–এর এক বড় ভূমিকা ছিল। টেলিভিশন সিরিয়াল ‘স্টারট্রেক’–এ এক পাগল কম্পিউটারকে সামলাতে মিস্টার স্পক তাকে পাই-এর শেষ অঙ্কটি বের করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, তা করতে গিয়ে সে কার্যত অচল হয়ে পড়েছিল। ‘দি লাইফ অফ পাই’–তে মুখ্য চরিত্র নিজের ডাকনাম দিয়েছিল পাই। পাইয়ের অঙ্কগুলো মনে রাখার জন্য কবিতা লেখা হয়েছে, সেই কবিতাকে বলা হয় ‘পিয়েম’ (piem)। গায়িকা কেট বুশ এক গানের কথার মধ্যেই পাইয়ের প্রথম ১০০টি সংখ্যা ঢুকিয়ে দিয়েছেন।
শেষে বলি ১৮৯৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা প্রদেশের প্রতিনিধি সভাতে পাস হওয়া ২৪৬ নম্বর বিলের কথা। যাতে ঠিক করে দেওয়া হয়েছিল, পাইয়ের মান হবে ৩.২। হিসাবের সুবিধার জন্য নয়, এক শখের গণিতজ্ঞের কথাতে পাইয়ের এর আসল মানকেই পাল্টে দেওয়া হয়েছিল। সৌভাগ্যক্রমে এক গণিতের অধ্যাপক খবরটা জানতে পেরে আপত্তি করেছিলেন, ফলে ইন্ডিয়ানা সেনেট তা অনুমোদন করেনি।
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মৌলিক কাঠামোর ওপর মানুষের আইন চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টার এর থেকে বড় উদাহরণ আমার জানা নেই।