একদিন দেখলাম, এক বাঙালি ভদ্রলোক এলেন। সঙ্গে এক বিশেষ সম্প্রদায়ের উচ্চপদস্থ লোক। তাঁরা রাজ্যসভায় একটি সদর্থক বিল পাশের বিরুদ্ধে, ইন্দিরার বিরুদ্ধে, ভোট দিতে বাবার কাছে অনুনয় করতে শুরু করলেন। বাবা ব্যাপারটায় বেশ খানিকটা চমকে গিয়েছেন, পর মুহূর্তে রেগে কাঁই, চিৎকার করে বললেন, ‘মানে!’ ওঁরা বললেন, ‘অবশ্যই কিছুর বিনিময়ে।’ বাবা সোজা হেঁটে দরজার কাছে গেলেন। দরজা খুলে আঙুল দেখিয়ে বললেন, ‘শাট আপ, অ্যান্ড গেট আউট!’ এ ঘটনা একেবারে ইন্দিরা গান্ধীর কানেও গিয়েছিল!
বাবা হাঁটছেন। রাত হয়েছে। রাত না ছাই, কলির সন্ধে, ১০টা! কিন্তু সেই ’৬৪-’৬৫ সালে, হাওড়ায় সেইটাই রাত। হাঁটছেন হাওড়া স্টেশন থেকে। অথচ হাঁটাপথ নয় আমাদের বাড়ি। তখন আমরা হাওড়া, কদমতলায় থাকতাম। ব্যাঁটরা থানার ঠিক পিছনে, তিনতলা একটা বাড়িতে। স্টেশন থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার। নকশাল আমল। খুন-ছিনতাই। পশ্চিমবঙ্গ উত্তাল!
হাঁটছেন, কারণ বাস নেই। রাত ১০টার পর কলকাতা লাগোয়া এই আধো মফস্সলে আর বাস চলত না। এমনকী, ডাক্তারও পাওয়া যেত না। কিন্তু ১০টা পর্যন্ত কী করছিলেন বাবা? একান্নবর্তী পরিবারের সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে চান-টান করে সাতসকালে বেরিয়েছেন, পাক্কা ৬টায়! প্রথমে ভবানীপুর, দুটো টিউশন। তারপর বিদ্যানগর কলেজ। ’৬৬ সালের পর এই রুটিনে ফিরতি পথে আবার ভবানীপুর জোড়ে। আশুতোষ কলেজের পাশের গলিতে এক খ্যাতনামা ডাক্তারের বাড়িতে মিটিং। রাজনৈতিক। বাংলা কংগ্রেসের। সেখান থেকে হাওড়া স্টেশন। এবং এই হাঁটা।
ফিরছেন যখন, আমি গাঢ় ঘুমে। সোম থেকে শনি– এই এক নিয়ম, কঠোর নিয়ম। আমার বাবা, তাঁকে আমি তাই দেখতে পেতাম সপ্তাহে একদিন, মাসে চারবার। রবিবার, শুধু রবিবার।
‘আজ গোলমাল করো না, বাবা আছে’, মা’র সতর্কবাণী। দাবা খেলতে ভালবাসতেন বাবা। বাড়িতে বেশ বড়সড় একখানা ক্যারাম বোর্ড ছিল। বাবার বন্ধুরা– বিশ্ববিদ্যালয়ের, রাজনীতিরও– আসতেন। আমি আশপাশে ঘুরঘুর করতাম। উনি বলতেন, ‘একবার চা বল তো মাকে’ বা ‘তোর মাকে বল, একটু খাবারের বন্দোবস্ত করতে’। ওই ছেলেবেলায় বাবাকে বাজার যেতে দেখেছি। কিন্তু বাবা একেবারেই ভাল বাজার করতে পারতেন না। মা-ঠাকুরমা রাগারাগি করতেন। আসলে বাবা সামনে যা পেতেন, তাই কিনে নিতেন।
‘বাবা’ শব্দটা বাকিদের কাছে যে অর্থ নিয়ে হাজির হয়, আমার কাছে ছোটবেলায় সেই ‘বাবা’ শব্দটার ব্যাপ্তি ও বিস্তার ছিল অনেক বেশি। আমিও দেখেছিলাম যে, আমার বাবা ঠিক আর পাঁচজন বাবার মতো না। ছোটবেলা থেকেই ঈশ্বরসম শ্রদ্ধা করতাম আমি। বাবা যদি খানিক হেসে কথা বলতেন, মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন, নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হত।
১৯৬৬ সাল। আমার ঠাকুরদা রাজনীতি থেকে পুরোপুরি বিদায় জানিয়েছেন ’৬৪ সালেই। বাংলা কংগ্রেস গঠন করেছেন অজয় মুখোপাধ্যায়। সেই দলে বাবা যোগ দিলেন সাময়িকভাবে। বাবার কাজ দেখে অজয়বাবু বেজায় খুশি। বললেন, ‘তোমাকে ছাড়া যাবে না। এসো, পার্টি জয়েন করো।’ জেনারেল সেক্রেটারির পদ পেলেন বাবা।
একটা সময় এল, বাবা বুঝলেন, এত কিছু একসঙ্গে করা অসম্ভব! অজয় মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘চাকরি ছেড়ে দাও, কীভাবে সংসার চলবে পরে দেখা যাবে।’ বাবাও তাই করলেন। কলকাতা হাই কোর্টে প্র্যাকটিস শুরু করলেন। এলএলবি ছিলেন এবং এনরোলড-ও। ১৯৬৯ সালে একদিন সুশীল ধাড়া আমার ঠাকুরদাকে প্রণাম করে বললেন, ‘দাদা, আমরা প্রণবকে রাজ্যসভায় পাঠাচ্ছি।’ রাজ্যসভায় শপথ নিলেন বাবা। যেদিন শপথ নিলেন, মনে আছে স্পষ্ট, নীল আর্মস্ট্রং সেদিনই পা রাখলেন চাঁদে। ৭টা ২৫-এ দিল্লি থেকে প্রচারিত বাংলা খবর হত একটা। সেখানে প্রথম খবর নীল আমস্ট্রং ও চন্দ্রাভিযান, দ্বিতীয় খবর, বাংলা থেকে সর্বকনিষ্ঠ বাংলা কংগ্রেসের রাজ্যসভার এমপি প্রণব মুখোপাধ্যায়।
তখন পশ্চিমবঙ্গে বাংলা কংগ্রেস ও বামেদের জোটে দু’বার সরকার গঠন হয়েছে। একবার ওই ’৬৭ সালে। আরেকবার ’৬৯-’৭০ সালে। অজয় মুখোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন তখন। কিন্তু ভেঙেও যায় এই জোট। ইন্দিরা ডাক দেন অজয় মুখোপাধ্যায়কে। অজয়বাবুকে ইন্দিরাই বলেন, ‘প্রণবকে আমরা চাই, ওকে ঠিকমতো ব্যবহার করব।’
৭৪ সাউথ অ্যাভিনিউতে, দিল্লিতে থাকতাম আমরা। ঘটনাচক্রে আমিও তখন দিল্লিতে। বাবা, তখন বেশিদিন হয়নি, শুরু করেছেন হাভানা চুরুট খাওয়া। ছোটখাটো মানুষ, ‘পার্সোনালিটি’ আনার জন্য এই কায়দার ধূমপান। উৎকট একটা গন্ধ হত। একদিন দেখলাম, এক বাঙালি ভদ্রলোক এলেন। সঙ্গে এক বিশেষ সম্প্রদায়ের উচ্চপদস্থ লোক। তাঁরা রাজ্যসভায় একটি সদর্থক বিল পাশের বিরুদ্ধে, ইন্দিরার বিরুদ্ধে, ভোট দিতে বাবার কাছে অনুনয় করতে শুরু করলেন। বাবা ব্যাপারটায় বেশ খানিকটা চমকে গিয়েছেন, পর মুহূর্তে রেগে কাঁই, চিৎকার করে বললেন, ‘মানে!’ ওঁরা বললেন, ‘অবশ্যই কিছুর বিনিময়ে।’ বাবা সোজা হেঁটে দরজার কাছে গেলেন। দরজা খুলে আঙুল দেখিয়ে বললেন, ‘শাট আপ, অ্যান্ড গেট আউট!’ এ ঘটনা একেবারে ইন্দিরা গান্ধীর কানেও গিয়েছিল!
একদিন ওঁদের আড্ডার সময় পেয়াদা এসে চিঠি দিয়ে গেল। সেখানে লেখা, ‘অনারেবল পিএম ওয়ান্টস টু মিট ইউ’। প্রথমবার সেই ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বাবার দেখা। ’৭১ সালের প্রথম দিক তখন। ইন্দিরা গান্ধি বাবাকে ইউরোপে পাঠাচ্ছেন, ডেলিগেশন যাচ্ছিল আন্তর্জাতিক সাহায্যের জন্য। ইন্দিরা চাইলেন, এই দলটাকে ‘লিড’ করুন বাবা। অত্যন্ত সফলভাবে তা করেছিলেন। বাবা-ই কিন্তু প্রথম পার্লামেন্টে বলেছিলেন, ভারতই হোক প্রথম দেশ, যারা বাংলাদেশকে ‘স্বাধীন রাষ্ট্র’ হিসেবে দেখবে। এমনকী, বাংলাদেশকে মিলিটারি সাহায্য করার কথাও বলেছিলে তিনিই।
ছোটবেলায় বাবাকে কক্ষনও দেখিনি আমাদের নিয়ে কোথাও বেড়াতে গিয়েছেন। সময়ই ছিল না! ’৭৩ সালের পরে, আমি ও বোন মিলে প্রায় জোর করে বেড়াতে যেতাম। যেখানেই যাই না কেন, এসে পড়তেন রাজনীতির কেউ না কেউ। ’৯৫ সাল পর্যন্ত প্রায় প্রতি বছরই ঘুরতে গিয়েছি আমরা, আমারই জোরজারে।
দ্রুত পড়তে পারতেন বাবা। বাংলা কিংবা ইংরেজি। হিন্দি বলতে বা পড়তে পারতেন না। বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘এরকমটা কেন?’ বাবা বলেছিলেন, ‘আমাদের সময় হিন্দি যাতে চাপিয়ে না দেওয়া হয়, তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীনই আমরা শপথ নিয়েছিলাম যে, বাংলায় কথা বলব। বাংলা কিংবা ইরেজিতে চিঠি লিখব। কিন্তু হিন্দিতে একেবারেই না।’ বাংলা ভাষাকে এতটাই ভালবাসতেন তিনি।
আরেকটা জিনিস, যেটা বাবার থেকে আমি পেয়েছি, তা হল মুড়ি। রাষ্ট্রপতি ভবনেও বাবা যখন ছিলেন, চাইতেন এই গ্রামের মুড়িই। মিল থেকে তৈরি করানো মুড়ি। মুড়ি তো যেতই, সঙ্গে বেশ কিছু ফল-সবজিও। এছাড়াও বাবা খেতে ভালবাসতেন ফিস কাটলেট। বিজলি গ্রিলের ফিস ওরলি। দেশি ডিমভরা কই। কখনওসখনও ইলিশ খেতেন, তেমন প্রিয় ছিল না। দিনে ভাত, এমনকী, রাতেও। খাবার পর একটা মিষ্টি ছিল অবধারিত। পা থেকে মাথা পর্যন্ত বাবা ছিলেন বঙ্গের, ভারতের। নিজের ভাষার প্রতি, শিকড়ের প্রতি ভালবাসা ছিল অসম্ভব।
বাবাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য, লকডাউন ঘোষণার আগে, একটা ফ্যামিলি গেট-টুগেদার করেছিলাম। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে। বাবা অসম্ভব খুশি হয়েছিলেন। হইহল্লা, খাওয়াদাওয়া, গল্পগুজব। ওই শেষবার। কিন্তু এখনও বাল্যের রবিবারগুলো মনে পড়ে। ক্যারাম বোর্ড মনে পড়ে। আর মনে পড়ে, বাবার হাসিভরা মুখ।