আজ রফিকুন নবীর জন্মদিন। একজন বাঙালি চিত্রশিল্পী, যিনি আদ্যন্ত রাজনৈতিক, যিনি একইসঙ্গে কার্টুনিস্ট, প্রচ্ছদশিল্পীও। যাঁর আঁকা ছবি ফিরিয়ে নিয়ে যায় পুরনো বাংলাদেশে, যাঁর আঁকা কার্টুনচরিত্র টোকাই প্রশ্ন করে বহমান বাংলাদেশকে, হকের কথা বলে। আজ তাঁর ৮০তম জন্মদিন।
‘কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয়’। দৃশ্য, দৃশ্য আর দৃশ্য। চারপাশ জুড়ে দৃশ্য। চোখ খুললে দৃশ্য। চোখ বুজলে অদৃশ্য। অদৃশ্যও কোনও না কোনও দৃশ্য। ইমেজ আমাদের ঘিরে থাকে। ইমাজিনারিকে জড়িয়ে আমরা থাকি। এই ইমেজ বা দৃশ্য চলে যাচ্ছে চোখের সামনে দিয়ে। সময়ের মতো। স্রোতের মতো। আর কিছু কিছু জমা হচ্ছে মনে। ঢেউ লাগছে হৃদয়ে। পাড় ভাঙছে দৃশ্য-অদৃশ্য জগৎ জুড়ে।
তিনি পিছন ফিরে দেখেন। অতীতের ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে ছবি আঁকেন। শৈশব এঁকে চলছেন সমগ্র শিল্পী জীবন ধরে। আমরাও তাঁর সঙ্গে স্মৃতি খুঁড়ে সুড়ঙ্গ পথে ফিরে যাচ্ছি কখনও গরুর গাড়িতে, কখনও মহিষের গাড়িতে কখনও স্টিমারে করে অন্য এক বাংলাদেশে।
শিল্পী রফিকুন নবীর তুলি গড়িয়ে জলই রং হয়ে ওঠে ক্যানভাসে। সীমিত রেখায় জলরঙে আঁকা কুচকুচে কালো মহিষ নিয়ে যায় আমাদের সবুজ মাঠে। টোকাইয়ের বিদ্রুপ অভিব্যক্তিতে আমরা ফিরে আসি রাজনীতির কালো রেখায়। আবার ফিরে যাই ‘একটি সুখী গ্রীষ্মের দুপুরের গল্পে’। কলমের কালো কালির লাইনে লিখে চলেন ছয়-সাত দশকের খোলামেলা ঢাকাকে। তিনি আঁকছেন এদেশের গাঁও-গেরাম, শহর, ঘর-গেরস্থালির জীবন, মানুষ আর নাগরিক বসতি জীবন। আঁকছেন শ্যামল বাংলার ভূ-দৃশ্য, নদী, মাছ, জাল, জেলে, নৌকা, রঙিন ডানার পাখি।
তিনি যতটা চিত্রশিল্পী, ততটাই কথাশিল্পী আর তাঁর সৃষ্ট চরিত্র টোকাই এতটাই জনপ্রিয় যে তিনি চরিত্রশিল্পীও। নিজেকে নিয়ে তৈরি করে নিয়েছেন। নিজের সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে নিজেকেও সৃষ্টি করেছেন। রফিকুন নবী থেকে ‘রনবী’ নামেই অধিক পরিচিতি লাভ করেছেন বাংলাদেশের শিল্পকলা ইতিহাসে।
শিল্পী রফিকুন নবী। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের চাঁপাইনবাগঞ্জে নানাবাড়ি ‘ঢোঁরবোনা’ গ্রামে ২৮ নভেম্বরের ১৯৪৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পদ্মা, পাগলা, মহানন্দা নদীর জল হাওয়া জড়িয়ে রয়েছে শিল্পীর শৈশব। শৈশবে রফিকুন নবীর ডাক নাম ছিল ‘ওফা’। ‘ওফা’ নামের অর্থ বিশ্বাসী।
দাদা-বাবা দু’জনেই পুলিশে চাকরি করতেন। বাবার বদলিপ্রবণ চাকরির সুবাদে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় বাস করতে হয়েছে সপরিবার। বাংলাদেশকে দেখেছেন খুব ভেতর থেকে। গরুর গাড়ি, মহিষের গাড়ি, নৌকা, লঞ্চ, স্টিমার রেলগাড়িতে ভ্রমণ করতে হয়েছে বিস্তর। এইসব ভ্রমণই এঁকে যাচ্ছেন এই শিল্পী জীবনের পুরো সময়কাল জুড়ে।
বাবা– রশিদুন নবী পুলিশে চাকরি করলেও অবসর সময়ে ঘরে বসেই জলরঙে ছবি আঁকতেন। পড়তে চেয়েছিলেন কলকাতা আর্ট স্কুলে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সঙ্গে পূর্বপরিচয় ছিল রশিদুন নবীর। তাঁরা একসঙ্গে কলকাতা আর্ট কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলেন। কিন্তু বাবার হঠাৎ মৃত্যু হওয়ায় বাবার পেশায় পুলিশ বিভাগে যোগদান করতে হয় রশিদুন নবীকে। কিন্তু শিল্পী হওয়ার ইচ্ছা ছেড়ে যায়নি। ছবি আঁকা ছাড়তে পারেননি। নিজের এই শিল্পী হওয়ার ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটান বড় ছেলে রফিকুন নবীকে আর্ট কলেজে ভর্তি করিয়ে।
মা– আনোয়ারা বেগম ছিলেন সূচিশিল্পী। নিজের ঘরে নিজেদের মতো করে একটা শিল্প চর্চার পরিবেশ ছিল।
নদীপ্রধান বাংলাদেশ। জল আর জমির আইল দেখে দেখে শিখে নিয়েছেন রেখা আর রঙের ব্যবহার। মায়ের হাতের নকশীকাঁথা জড়িয়ে ওম নিতে নিতে জেনে গেছেন ছয় ঋতুর বাংলাদেশকে।
১৯৫১ সালে মানিকগঞ্জের তেওতা জমিদার বাড়ির স্কুলে ভর্তি হন দ্বিতীয় শ্রেণিতে। ‘৫২-র শেষদিকে চলে আসেন ঢাকায়। ১৯৫৩ সালে ভর্তি হন ঢাকার জগন্নাথ কলেজ সংলগ্ন পোগোজ স্কুলের চতুর্থ শ্রেণিতে। এই থেকে মোটামুটিভাবে ঢাকায় থিতু হলেন তাঁদের পরিবার। শুরু হল নাগরিক জীবনের যাত্রা।
ফুলবাড়িয়া রেল স্টেশন, সদরঘাট, ঘোড়ার গাড়ি, গাড়োয়ান, বুড়িগঙ্গা নদী, নৌকা তাঁর ছবির বিষয় হয়েছে বারবার। যেভাবে তাঁর ছবির বিষয় হিসেবে এসেছে ‘বরেন্দ্র প্রকৃতি’, ‘সাঁওতাল’, ‘বেদে নৌকা’, ‘রাখাল’, ‘জেলেরা’, ‘নদীর পাড়’ ‘পাখি’, ‘স্মৃতির নৌকা, ‘দুটি সুখী মোষ’ এবং ২০১৩ সালে জলরঙে আঁকা একটি ছবি রয়েছে বাবা-ছেলে গরুর গাড়িতে চড়ে চলেছেন গ্রাম পথ ধরে নাম রাখলেন ‘যাত্রা’। তাঁর ছবিতে গ্রাম আর নগর একই সঙ্গে এসেছে। আর এভাবেই সমৃদ্ধ করেছেন আমাদের শিল্পকলার জগৎকে।
১৯৫২-র ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ’৬৯ সাল পাকিস্তান বিরোধী গণআন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। একটা স্বাধীন দেশের ইচ্ছে জনগণের হৃদয়ে আঁকা হতে থাকে। আমাদের রাজনীতির নতুন সমীকরণে যুক্ত হতে থাকে নতুন নতুন পর্ব। পাকিস্তান থেকে খুব দ্রুতই আমরা যাত্রা শুরু করি স্বাধীন বাংলাদেশের দিকে। স্বাধীনতার দিকে।
১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের শুরু আগের দুই বছর বাংলাদেশের রাজনীতির অগ্নিগর্ভ সময়। ‘৬৯-এর আইয়ুব খান ও ইয়াহিয়া খান বিরোধী আন্দোলনে সময়ে শিল্পী রফিকুন ও বন্ধু শাহাদাত চৌধুরী মিলে প্রকাশ করেন ‘ঊনসত্তুরের ছড়া’ নামে একটি বই। এই বই লেখক কবি চারু শিল্পীদের মধ্যে একটা বড় প্রভাব রাখে। এই বই সরকার বিরোধী সম্মিলিত আন্দোলনের একটা ইশতেহারের মতো কাজ করে। যা আমরা দেখতে পাই পরবর্তী সময়ে ১৯৭১-র শুরুতে ‘বাংলা চারু ও কারুশিল্পী সংগ্রাম পরিষদ’–এর রাজপথের মিছিলে শিল্পীদের অংশগ্রহণ। এইসব মিছিলের জন্যই রফিকুন নবী প্রথম শুরু করেন রাজনৈতিক কার্টুন সংবলিত ব্যানার, পোস্টার।
ছবি নিয়ে তাঁর লেখা ‘স্মৃতির পথরেখায়’ গ্রন্থে বলছেন রফিকুন নবী, ‘নিজের ছবি সম্বন্ধে বলতে গেলে যা ইচ্ছা হয় তার বেশিরভাগই সেই গ্রাম সম্পর্কিত। ছাত্রজীবনে তো গ্রাম থেকেই ভালোলাগার নির্যাসটুকু অর্জিত।… তবে শহর যে নেই তা নয়। শহর অন্য এক ভিন্নতা দিয়েছে আমাকে তৈরি হতে।
ছবিতে রস সৃষ্টিই অন্যতম প্রধান দিক। আমি অন্তত তা-ই মনে করি। তেমনটাই অনুশীলন করে থাকি নিজ চর্চায়।
জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়াদি নিয়ে কাজ করি। মাঠ-ঘাটের মানুষ যে সবকে খুঁটি ধরে দিন যাপন করে, বাঁচে, সেসবকে বিষয় করি। গ্রামের মানুষদের হাসি-কান্নার সঙ্গে যা কিছু জড়িত তা আঁকতে পারলে স্বস্তি পাই।
তবে কালো মোষ, কালো ছাগল এবং কালো মানুষ আমার খুব প্রিয় বিষয় চিরকালই। কালো রঙের মাহাত্ম্যই আলাদা। বিদেশে বসে ইউরোপীয় মেমসাহেবদের ন্যুড আঁকাআঁকি কম করিনি। সুযোগ ছিল বলে অঢেল এঁকেছিলাম। মনে আছে ইংরেজ শিল্পী অগাস্টাস জনের আঁকা প্রতিকৃতিগুলোর কথা। বেশিরভাগ মডেলই নিগ্রো। বোঝাই যায় যে সেসব এঁকে মজা পেতেন। দারুণ মজা করে সেই প্রতিকৃতি আঁকতে কালো রংকে সামলাতেন। কালো মানুষের রং আয়ত্তে আনতে অন্যান্য কত রংই না ব্যবহার করেছেন। ‘রিফ্লেকটেড’ রং হিসেবে নীল, এমনকী বেগুনিও লাগাতেন অদ্ভুত দক্ষতায়। আরো অনেক আগে রেমব্র্যান্ট ব্যাপারটা দেখিয়ে গেছেন। রুশো, পল গগ্যাঁও কালো মানুষ এঁকেছেন নিজ নিজ রকমসকম রেখে। এমনিতেও কালো রেখার ব্যবহারে ছবি ভিন্ন মাত্রা পায়। জয়নুল তাঁর দুর্ভিক্ষের ড্রয়িংগুলোতে তা দেখিয়ে গেছেন। একটা মজার কথা মনে পড়ল। ক্রোকুইস্ট নিবে কালো কালি দিয়ে ইলাস্ট্রেশন এবং কার্টুন আঁকা নিয়ে অগ্রজ শিল্পী নিতুনদা ঠাট্টা করে বলতেন, ‘বেশ আছিস! কালি আর ক্রোকুইস্ট নিব দিয়ে দিব্যি কামিয়ে নিচ্ছিস টু-পাইস।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো ছবি চর্চার স্বল্প কয়েক বছরে কালোকেই বেছে নিয়েছিলেন মূল রং হিসেবে। এভাবে আধুনিক চিত্রকলার নিজস্ব একটি ধরনই সৃষ্টি করে গেছেন।”
দেশ স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন। কিন্তু রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য আজও লড়াই করে যাচ্ছেন। সৃষ্টি করেছেন একটি রাজনৈতিক কার্টুন চরিত্র নাম ‘টোকাই’। শিল্পী রফিকুন নবীর এই ‘টোকাই’ চরিত্র আমাদের বলে দেয় তিনি আজন্ম লড়াকু সৈনিক। একজন রাজনীতি সচেতন শিল্পী।
১৯৫৯ সালে তৎকালীন বাংলাদেশ কলেজ অব আর্ট অ্যান্ড ক্র্যাফটস ( বর্তমানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা অনুষদ) বিভাগে ভর্তি হন। এ বাদে তিনি এথেন্স স্কুল অব ফাইন আর্টসে ১৯৭৩-‘৭৬ সাল পর্যন্ত প্রিন্ট মেকিংয়ে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট করেন। পরবর্তী সময়ে এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের অঙ্কন ও চিত্রায়ণ বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইমেরিটাস অধ্যাপক হিসেবে যুক্ত রয়েছেন।
কবি শামসুর রাহমান ভাষায়, ‘‘স্বদেশের প্রতি রফিকুন নবীর ভালবাসা প্রবল এবং অকৃত্রিম। এই ভালবাসার পরিচয় তাঁর চিত্রমালায় বিধৃত। স্থূলভাবে নয়, সূক্ষ্ম শৈল্পিক সুষমায়। বাংলাদেশের নিসর্গ তাঁর রূপদক্ষ রেখা ও রঙের বিন্যাসে-বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। জীবনানন্দ দাশের ‘রূপসী বাংলা’ পড়ে আমাদের যে নান্দনিক অভিজ্ঞতা হয়, কিছুটা সে-ধরনের অভিজ্ঞতা আমরা লাভ করি রফিকুন নবীর কিছু ছবি দেখে।’’
শিল্পী রফিকুন নবীর ৮০তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে চলছে শিল্পীর রেট্রসপেকটিভ প্রদর্শনী। শাহবাগে অবস্থিত জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী গ্যালারি এবং ধানমন্ডিতে অবস্থিত গ্যালারি চিত্রকে।
ছাত্রাবস্থায় চারুকলায় তৃতীয় বর্ষে থাকাকালীন কাজ শুরু করেন অলংকরণ শিল্পী হিসেবে ‘চলন্তিকা’ পত্রিকা। এই পত্রিকার মাধ্যমেই শুরু হয় মুদ্রণ ও প্রকাশনা শিল্পের সঙ্গে কাজের সম্পর্ক। গাজী শাহাবুদ্দিন সম্পাদিত ‘সচিত্র সন্ধ্যানী’তে নিয়মিত কার্টুন আঁকেন, আব্দুল গনি হাজারীর কলাম ‘কালপেঁচার ডাইরি’তে অলংকরণ করেন প্রতি সপ্তাহে। মাসিক বেতনে খণ্ডকালীন চাকরিও শুরু করেন সেই সময়ে ‘সাপ্তাহিক পূর্বদেশ’ ও ‘চিত্রালী’তে। বন্ধু শাহাদত চৌধুরীর সঙ্গে যুগলবন্দি হয়ে জড়িয়ে থাকেন। ১৯৭৭ সাল থেকে ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’ পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক ২০০০’ পর্যন্ত পত্রিকার কার্টুন আঁকা লেখা ও প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে।
টোকাই চরিত্র সৃষ্টির ইতিহাস পেয়ে যাই তাঁর রচিত গ্রন্থে,
“ষাটের দশকের প্রায় শেষের দিকে চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হান, আলমগীর কবির এবং গাজী শাহাবুদ্দিন ‘এক্সপ্রেস’ নামে একটি ইংরেজি পত্রিকা বের করেন। তাঁদের অনুরোধে তাতে নিয়মিত কার্টুন আঁকতে থাকি ইংরেজি ডায়ালগ ব্যবহার করে। পকেট কার্টুন ছিল সেসব। খানিকটা হাস্যরসাত্মক ‘গ্যাগ’, খানিকটা সিরিয়াসধর্মী ব্যাপারও ছিল।
‘৭৬-এর শেষে দেশে ফিরলাম। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে নিহত হওয়ার নির্মম ঘটনার পর দেশে অন্য রকম রাজনৈতিক হাওয়া-আবহাওয়া চলছে তখন। দেখলাম পরিচিত অনেকেই বেমালুম বদলে ফেলেছে নিজেদের ভাবনাচিন্তা। কেমন যেন পাকিস্তানি পাকিস্তানি ভাবও। পঁচাত্তরের ঘটনাবলি নিয়ে কারোরই মুখে কথা নেই। এড়িয়ে যাওয়াটা অভ্যাস করে ফেলেছে। মুখে কুলুপ আঁটা ।
মনে হয়েছিল, দেশে ফিরে এসে বোধহয় ভুলই করে ফেলেছি। কলেজে জয়েন করতে গিয়ে দেখি আমার চাকরিটাও নেই। আমার কাগজপত্র ঠিক থাকা সত্ত্বেও যোগ দিতে পারছি না। বইপুস্তক, পত্র-পত্রিকার জগৎ দূরে সরে গেছে। এসব নিয়ে বিদেশে ফিরে যাওয়ার কথাও মনে ডাক দেওয়া শুরু করেছে যখন তখন দেশ, পরিবার, আত্মীয়-পরিজন, বন্ধুবান্ধব, আপন পরিবেশে ভালো-মন্দকে সঙ্গী করে থাকার বোধটিই জয়ী হল। থিতু হয়ে গেলাম দেশেই।
আটাত্তরে ‘টোকাই’ আঁকা শুরু করলাম। কার্টুনটা জনপ্রিয় হল। ”টোকাইটা যেহেতু আমার অত্যন্ত প্রিয় মাধ্যম ছিল, তাই ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’ বন্ধ হয়ে যাবার পর সম্পাদক বন্ধু শাহাদাত চৌধুরীর অনুরোধে তাঁর নতুন পত্রিকা ‘সাপ্তাহিক ২০০০’-এ আবার শুরু করেছিলাম। আবার সেটা পাঠকপ্রিয়তাও পেয়েছিল।
এই দীর্ঘ পথযাত্রায় কত কিছুই না দেখলাম। আর শুধু ছবি আঁকাই নয়, আরো কত কী-ই না করতে হলো। এটা-ওটা ছুঁয়ে ছুঁয়ে এতদূর আসা। ব্যাপারটা সময়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ভারত ভাগ, বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা, ফলে বাহান্নতে রক্তপাত, ভাষার জন্য শহীদ হওয়া, উদ্ভ্রান্ত সামরিক অভ্যুত্থান, বাঙালি সংস্কৃতিকে সমূলে উৎপাটনের চেষ্টা, তারপর ঊনসত্তরের গণআন্দোলন হয়ে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, আবার রাজনৈতিক সহিংসতা, পঁচাত্তরের নৃশংসতা ইত্যাদি কত কিছুই না পথচলতিতে দেখা হলো। ভাবতে বসলে মনে পড়ে শিল্পকলার শিল্পীদের পক্ষে ঘোরতর অশান্ত পরিবেশে নিজেদের ইচ্ছামাফিক শুধুই সৃষ্টিশীল কিংবা নিরীক্ষাধর্মিতায় নিবেদিত থাকা পঞ্চাশ-ষাটের দশকে সহজ ছিল না। চাওয়া-পাওয়ায়, দাবি আদায়ের নিমিত্তে মিছিলে নামা আন্দোলনকারী জনগণের পাশে থাকার, শিল্পকলাকে ব্যবহার করে সহায়ক হওয়ার দায়িত্বও পালন করতে হয়েছে। আমিও তা থেকে দূরে থাকিনি। থাকা যায়নি মনের তাগিদেই।”
ছাত্রাবস্থায় ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত বন্ধু-লেখক বুলবুল ওসমানের কিশোর উপন্যাস ‘কানামামা’ বইয়ের প্রচ্ছদ দিয়ে প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে যাত্রা শুরু করেন। প্রথম প্রচ্ছদের জন্যই পেয়ে যান সেইবছর ‘ন্যাশনাল বুক সেন্টার’ কর্তৃক শ্রেষ্ঠ প্রচ্ছদের পুরস্কার। এই পর্যন্ত কয়েক হাজার বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদ করেছেন। সেরা প্রচ্ছদের জন্য পেয়েছেন ১৩বার ‘জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র’ থেকে পুরস্কার।
যেখানে শিল্পের হাতেখড়ি নিলেন আর যেখানে অনেকগুলো প্রজন্মেকে শিল্পের হাতেখড়ি দিলেন সেই বিদ্যাপিঠের জয়নুল গ্যালারিতে শুরু হচ্ছে নতুন আরেকটি প্রদর্শনী— ‘কার্টুন, প্রচ্ছদ ও পোস্টার প্রদর্শনী’। প্রদর্শনী চলবে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
শিল্পী রফিকুন নবীর ‘স্মৃতির পথরেখায়’ বিরামহীন চলা। এই বিরামহীন চলাচল অব্যহত থাকুক। বাংলার চিত্রকলার অন্যরকম এক শীতকাল। তাঁর ছবি আমাদের ওম দেবে, তাঁর ছবি থেকে নতুন প্রজন্ম নেবে তাপ-উত্তাপ।
শুভ জন্মদিন শিল্পী রফিকুন নবী। শুভ জন্মদিন সকলের প্রিয় ‘রনবী’।
ছবি: লেখক
এ দেশে প্রসূতিসদন থেকে নবজাত শিশু ও প্রসূতিকে ছেড়ে দেওয়ার পরও স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে বেশ কয়েক মাস ধরে নিয়মিত একজন চিকিৎসক বাড়িতে এসে তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে যান। এটা ছিল এখানকার জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার একটি অপরিহার্য অঙ্গ।