২০০১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর পরিকল্পনা মতো তৈরি হল কোরাস রেপার্টরির নিজস্ব থিয়েটার ঘর। এর মধ্যে রতন মণিপুরের নিজস্ব স্থাপত্যরীতির সঙ্গে মিলিয়ে দিলেন বৃহত্তর ভারতের, মায়নামার বা থাইল্যান্ডের স্থাপত্যশৈলী। কারা তৈরি করবেন এই থিয়েটার? না, বাইরে থেকে কোনও মিস্তিরি আনিয়ে নয়, এই অভিনয়ক্ষেত্র তৈরি করবেন এই রেপার্টরির সদস্যরাই, তাঁদের শ্রমদানে গড়ে উঠেছে এই পরিসর। যেখানে সংস্কৃত নাট্যচার্যদের আদর্শ অনুসরণ করে নৃত্য, নৃত্ত আর নাট্যের মধ্যে একটা সমন্বয় তৈরি করা হচ্ছে।
সে অনেক কাল আগেকার কথা। দিল্লির ‘আইফ্যাক্স’ প্রেক্ষাগৃহে ‘বহুরূপী’র অভিনয়। দুটো ট্রাঙ্ক লিফটে করে ওপর তলায় তুলতে হবে। আছি তিনজন। মানে এক একটা ট্রাঙ্ক তো দু’জনে মিলেই ধরতে হয়, বাকিটা একজনে কী করে তুলবে? সাদা শার্ট ঘিয়ে রঙের প্যান্ট পরা এক নেপালি ভদ্রলোক এগিয়ে এসে পরিষ্কার বাংলায় বললেন, ‘দাও, আমি ধরছি।’ আমরা একটু কিন্তু-কিন্তু করে পরাভূত হলাম। লিফটে করে মাল উঠল, ভদ্রলোক হাতে ধরে নামাতে সাহায্য করছেন, বহুরূপী-র সম্পাদক কালীপ্রসাদ ঘোষ হাঁ-হাঁ করে ছুটে এলেন। ‘আরে, এ কী, তোমরা রতন সাহেবকে দিয়ে মাল বওয়াচ্ছ?’ এই স্মৃতিকে কি খুব ‘তুচ্ছ’ বলা যায়? তখনই রতন থিয়াম ভারতীয় থিয়েটারে এক গুরুত্বপূর্ণ নাম। থিয়েটারে নতুন আমি বা আমার বন্ধুরা তখন জেনে গিয়েছি, নাট্য বা থিয়েটার নিয়ে আমাদের যা ধারণা, এই মানুষটি তাকে সম্পূর্ণ মুছে দিয়ে অন্য একটা ধারা তৈরি করবার ক্ষমতা নিয়ে এসেছেন। সম্পূর্ণ অচেনা দুটো ছেলেকে মাল বয়ে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন যিনি, তাঁর স্বভাবের ধরনটা কি এর থেকে বুঝতে পারা যাচ্ছে না?
থিয়েটারকে আমরা জেনে এসেছি সর্বশিল্পের সমন্বয় বলে। রতন থিয়াম ছিলেন তার জলজ্যান্ত উদাহরণ। কী জানতেন না তিনি? নাটক লেখা আর অভিনয়ের কথা বাদ দিচ্ছি, তার বাইরে মণিপুরের বিখ্যাত নৃত্যগুরু থিয়াম তরুণকুমার আর থিয়াম বিলাসিনী দেবীর ছেলে, সেই সূত্রে নাচের সঙ্গে জন্মাবধি সম্পর্ক। শুধু নাচ কেন, বাবা তাঁকে নাচের বাইরেও শিখিয়েছিলেন মণিপুরী আচার-অনুষ্ঠানের নানা খুঁটিনাটি, শিখেছেন মণিপুরী মার্শাল আর্ট থাংতা। গান শুধু জানতেন, তাই নয়, গানের ব্যাপারে একজন বিশেষজ্ঞ বলা যেত তাঁকে। খুব ভালো ছবি আঁকতে পারতেন, আলোক পরিকল্পনা এবং প্রক্ষেপণে দক্ষ, স্থাপত্যশিল্পে প্রগাঢ় জ্ঞান, কবিতা-উপন্যাস লিখতেন। এতগুলো ক্ষমতা নিয়ে যিনি থিয়েটারে আসবেন, থিয়েটার তো তাঁর সাহচর্যে সমৃদ্ধ হবেই। বস্তুত, রতনের প্রযোজনা কীভাবে এইসব উপকরণকে ব্যবহার করতে হয়, তার এক একটা নিদর্শন হয়ে থাকত আমাদের কাছে। আধুনিক কালে বিদেশের যেসব বিদেশি নাট্য প্রযোজকের নাম আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারণ করি, তাঁদের দলে এই মণিপুরী মানুষটিও পড়েন– একথা ভেবে বুক আনন্দে, গর্বে, ভরে ওঠে। গর্বটা আরও বেশি করে হয় যখন ভাবি, রতন জন্মেছিলেন এই বাংলায়, খোদ নবদ্বীপে, যে কারণে বাংলায় তাঁর চমৎকার দখল ছিল।
কিন্তু থিয়েটারের মানুষ হিসেবে তাঁর জোরের জায়গা কোনটা? ইংরেজিতে একটা কথা আছে– ইউরো-সেন্ট্রিক। আমাদের শিল্প, সাহিত্য, চারুকলা, থিয়েটার তো বটেই– এখনও তাদের উৎকর্ষ-অপকর্ষের ব্যাপারটা ঠিক করা হয় সাধারণভাবে সেটা কতটা বিদেশি ধাঁচাকে ঠিক ঠিক মতো অনুসরণ করতে পেরেছে, তাই দিয়ে। যদি আমাদের নাট্যের কথা ভাবি, যাকে ‘থিয়েটার’ বললেই বেশি করে চেনা বলে মনে হয়, সে ব্যাপারটা তো অনেকখানি বিদেশি-অধ্যুষিত। অথচ, আমাদের যে নিজস্ব থিয়েটার ছিল না তা তো নয়। সংস্কৃত নাটকের একটা সম্পন্ন ঐতিহ্য ছিল, লোকনাটকের ব্যাপ্ত ঐতিহ্য ছিল, সাহেবদের নকল করে আমরা সেই ধারাবাহিকতাকে ছিন্ন করে দিলাম। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে রতন জাতীয় নাট্য বিদ্যালয় বা ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামায় থিয়েটার নিয়ে প্রশিক্ষণ নিতে ঢুকলেন। তাঁর সামনে একটা দরজা খুলে গেল, এবং এ ব্যাপারে তিনি গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেছেন ইব্রাহিম আলকাজির নাম, যিনি সেই সময় জাতীয় নাট্য বিদ্যালয়ের পরিচালক ছিলেন। নিজে একেবারেই ইউরোপীয় বাস্তববাদী নাটকের মানুষ, কিন্তু, রতন বলছেন, তিনিই ছাত্রদের পরিচয় করিয়ে দেন দেশ-বিদেশের কিছু লোকনাট্যের সঙ্গে। এই শিক্ষা পরে রতনকে প্ররোচিত করবে গোটা ভারত ঘুরে ঘুরে নানা অঞ্চলের লোকনাট্যের সঙ্গে পরিচিত হতে। যাই হোক, জাতীয় নাট্যবিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে নিজের দেশ মণিপুরে ফিরে এলেন রতন, ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে ইম্ফলে তৈরি করলেন কোরাস রেপার্টারি থিয়েটার। একেবারে পেশাদারি থিয়েটার। প্রায় দু’-একরের বেশি জমি নিয়ে তৈরি, সেই দিক থেকে দেখলে একে তো একটা নাট্যগ্রামই বলতে হবে।
নিজস্ব জমি নিয়ে নিজস্ব থিয়েটার। তার মধ্যে মণিপুরের মেইতেই ভাষায় নাটক হচ্ছে, সংস্কৃত অথবা ইংরেজি ভাষায়। কিন্তু থিয়েটারে তো ভাষাটা সব সময়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়, অন্তত রতন যে ধরনের থিয়েটার তৈরি করতে চাইছেন সেখানে নয়। সেখানে শরীর একটা খুব সর্বব্যাপী উপাদান। যদি আমাদের লোকনাট্যের দিকেও তাকান, দেখবেন একটা সামূহিক ব্যাপার আছে তার মধ্যে, সবাই মিলে একটা থিয়েটার তৈরি করতে চাইছে। এই ধারাকে আমাদের শহুরে নাট্য খুব ব্যাপকভাবে গ্রহণ করেনি। রতন তা করলেন, কারণ তাঁর থিয়েটার তো আসলে একটা অনুসন্ধান, আমাদের দেশজ প্রকাশকলার অনুসন্ধান, খুব সহজ কথায় বলতে গেলে আমাদের শিকড়ের অনুসন্ধান। এবং তার মধ্যে মিশে যাচ্ছে বিদেশের, বিশেষ করে প্রাচ্যের নানা প্রাচীন প্রকাশকলা। এবং সেই সঙ্গে, রতন বিশ্বাস করেন, থিয়েটার শুধুমাত্র কোনও পারফরমেন্সটুকু নয়, তা একটা অভিযাত্রা, এবং মানুষের যে কোনও মহান অভিযাত্রা শেষপর্যন্ত যেখানে গিয়ে পৌঁছতে চায়, তাঁর থিয়েটারও তাই করতে চেয়েছে, চলে যেতে চেয়েছে গভীর সত্যোপলব্ধিময় আধ্যাত্মিকতার দিকে।
এই যে অন্য রকমের থিয়েটার নিরীক্ষা, তার জন্যে তো দরকার অন্যরকম পরিসর। রতন নিজে পরিকল্পনা করলেন সেই পরিসর বা মঞ্চের। সে মঞ্চের নাম আর কী হতে পারে, শ্রাইন থিয়েটার (Shrine Theatre) ছাড়া? রতনের থিয়েটার তো আসলে এক মন্দির, এক ধ্যানক্ষেত্র, যেখানে গিয়ে মানুষ আত্মোপলব্ধির সন্ধান পায়। আগেই বলেছি, স্থাপত্যবিদ্যায় দখল ছিল তাঁর, ২০০১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর পরিকল্পনা মতো তৈরি হল কোরাস রেপার্টরির নিজস্ব থিয়েটার ঘর। এর মধ্যে রতন মণিপুরের নিজস্ব স্থাপত্যরীতির সঙ্গে মিলিয়ে দিলেন বৃহত্তর ভারতের, মায়নামার বা থাইল্যান্ডের স্থাপত্যশৈলী। কারা তৈরি করবেন এই থিয়েটার? না, বাইরে থেকে কোনও মিস্তিরি আনিয়ে নয়, এই অভিনয়ক্ষেত্র তৈরি করবেন এই রেপার্টরির সদস্যরাই, তাঁদের শ্রমদানে গড়ে উঠেছে এই পরিসর। যেখানে সংস্কৃত নাট্যচার্যদের আদর্শ অনুসরণ করে নৃত্য, নৃত্ত আর নাট্যের মধ্যে একটা সমন্বয় তৈরি করা হচ্ছে। সেখানে একদিকে যেমন আছে তাল লয় আর পদভঙ্গি দিয়ে নানারকম অঙ্গ সঞ্চালন, সেখান থেকে তাকে অর্থবোধক করে তোলা এবং তার মধ্যে অভিনয়কে মিশিয়ে দেওয়া। বোঝাই যাচ্ছে, কেবলমাত্র অভিনয়কে পার হয়ে এই প্রকাশ আরও বহুদূরে ব্যাপ্ত হতে পারছে, বহু ব্যঞ্জনাকে প্রকাশ করতে পারছে।
নানা ধরনের নাটক করেছেন তিনি, নানা উৎস থেকে গ্রহণ করেছেন সেই সব নাটকের কাঠামো। ভাসের ‘উরুভঙ্গম’, কালিদাসের ‘বিক্রমোর্বশীয়ম্’ বা ‘ঋতুসংহারম্’, শেক্সপীরের ‘ম্যাকবেথ’, মলিয়ের (সতী শেম্বা– ‘দ্য স্কুল ফর ওয়াইভস’), রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা’ (শাকুদবা শাকনাইবা), বাদল সরকার (মী পারেং–মিছিল অবলম্বনে), মোহন রাকেশ (‘নোংমা ইঙ্গাদা’– ‘আষাঢ় কা একদিন’, ‘ইথক্কি কাংঙা’– ‘লেহেরো কা রাজহংস’) গিরিশ রারনাড (‘যযাতি’) এবং সমকালীন বহু নাটককারের রচনা থেকে নিয়েছেন তিনি।
তা বলে এমনটা ভাবা বিপজ্জনক হবে যে রতন থিয়ামের থিয়েটার শুধুমাত্র শৈলীর চর্চাই করে গেছে, আধুনিক মানুষের আনন্দ, কষ্ট বা বিপন্নতাকে প্রত্যাখ্যান করে। প্রাচীন নাট্যশৈলীর মধ্যে যে প্রচণ্ড শক্তি আছে, সেই শক্তি তিনি ব্যবহার করেছেন তাঁর সমকাল বিষয়ে অনুভূতি প্রকাশের কাজে। সেই কবে দেখেছিলাম তাঁর ‘চক্রব্যূহ’ আর ‘অন্ধাযুগ’, ভাষা তো বুঝি না, কিন্তু ধরতে পারি, কী সাবলীলভাবে তার মধ্যে চলে আসছে ভিয়েতনাম যুদ্ধের নৃশংসতা, কম্বোডিয়ার যুদ্ধ, গালফ যুদ্ধ, কী ভাবে সত্য হয়ে উঠছে এই নাটক সম্পর্কে তাঁর নিজের মন্তব্য– ‘Andyayug is the blindness of the age, the age of the blind people, we all are blind.’ এমন উদাহরণ আরও অনেক দেওয়া যায়, কিন্তু তার সুযোগ এই লেখকের নেই।
প্রতিভার যোগ্য সমাদর পেয়েছন মানুষটি। বিশ্ব থিয়েটারের ইতিহাসে রতন থিয়াম একটি ঝলমল-করা নাম। ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান, কোরিয়া, থাইল্যান্ড ইত্যাদি বহু দেশে তাঁর দলকে সসম্মানে আমন্ত্রণ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। International Theatre Institute-এ তিনি ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ‘পদ্মশ্রী’ পেয়েছেন, পেয়েছেন আরও বহু সরকারি-বেসরকারি উচ্চ সম্মান, জাতীয় নাট্য বিদ্যালয়ের পরিচালক হয়েছিলেন তিনি।
একটা খবর দিয়ে শেষ করি। রতনের সঙ্গে বেশ কিছু তরুণ বাঙালি নাট্যকর্মীর সহজ যোগাযোগ ছিল। পশ্চিমবঙ্গের নানা জায়গায় নাট্যগত প্রাণ কিছু মানুষ নাট্যগ্রাম তৈরি করেছেন, যেখানে নানাভাবে নাট্যচর্চা হয়। সেই সব নাট্যজনেরা নিশ্চিতভাবেই রতন থিয়ামকে তাঁদের অগ্রপথিক বলে স্বীকার করে নিয়েছেন।