রথের মেলায় এবার একা গিয়েছি। আগে মা-বাবার সঙ্গে যেতাম, তারপর বন্ধুরা, এখন নিজে নিজে অনেক সময় নিয়ে ঘুরি। প্রতিদিনের অভাব-অনটন থেকে মুক্তি, আনন্দরসের মুক্তির পতাকা এই রথযাত্রার মেলা। একজন বসে বসে পাঁপড় ভাজছে, কঞ্চিতে ইলেকট্রিক ডুম লাগানো, গরম তেলে পাঁপড় ছড়িয়ে যাচ্ছে, একরকমের নকশা হচ্ছে, পাশের পেতল গামলাতে চুড়ো করা জিলিপি। আমি পাঁপড় কিনছি, একজন খদ্দের বলছে– সনাতনদা, রঙের কাজে যাচ্ছ না কেন? সংসারে মন দাও, বাড়িতে এতগুলো পেট, দেখতে হবে তো!
বর্ষার আকাশের দিকে তাকিয়ে রঙের স্তর ও হাওয়ার বয়ে চলা দেখে বোঝা যেত আজ বৃষ্টি হবে কি না, হলে কতক্ষণ স্থায়ী হবে ইত্যাদি। বলতে পারতেন একটু বয়স্ক মানুষজন। কত সমবেত মানুষের তাকিয়ে তাকিয়ে প্রকৃতিকে বোঝার চেষ্টার ধারবাহিক স্মৃতি এঁরা বহন করতেন। এখন এমন অল্প কিছু মানুষই বেঁচে আছেন। তবে জন্মের পর ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠার সময়েই আমরা বুঝে গিয়েছিলাম এইসব মানুষের সংস্পর্শে থাকতে থাকতে, গঙ্গাপুজো ও রথযাত্রা দুটো দিন বৃষ্টি হবেই। এ হল মেঘবাদলের দিন।
সকাল থেকে আকাশ কালো হয়ে আসবে। বেলা বাড়লেও আলো বোঝা যাবে না। মা রান্না করতে করতে বলবে–
‘ওই পাড়ার এক ময়নাবুড়ো
রথ করেছ তেরোচূড়ো
রথ দেখতে যাবি
পয়সা কোথায় পাবি?’
পুরী বা মাহেশের রথযাত্রা আমার দেখা হয়নি। আমি মন দিয়ে দেখেছি বর্ধমান জেলার দাঁইহাটের রথ। পূর্বনাম ইন্দ্রাণী পরগনা। পাশে দিয়ে বয়ে যেত নদী, এখন সরে গেছে। এই নদী দিয়েই ধনপতির সিংহলযাত্রা, ভাস্কর পণ্ডিতের ঘাঁটি, খানিক এগিয়ে কাটোয়ায় নিমাইয়ের সন্ন্যাস গ্রহণের স্থান। ভাগীরথী এখন সরে গেছে বহুদূর। তবু সেই পুরনো পাথরে বাঁধানো স্নানঘাটের পাশে জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রা মন্দির। আষাঢ় মাসে রথযাত্রার বিকেলে ভিড় উপচে পড়ে। তবে প্রতি বছর নিয়ম করে আর বৃষ্টি হয় না। কাঠের সুউচ্চ রথ দাঁড়িয়ে আছে, সারা গা দেবদারু পাতা দিয়ে সাজানো।
…………………………………………………………………………………………
সনাতন বেসনের হাত কাপড়ে মুছে খানিকক্ষণ চুপ। তারপর বলে, দাদা, বাড়ির সবাই মিলে সিমেন্ট গুলিয়ে চুমুক দিয়ে খেয়ে পেটে সিল মেরে নিয়েছি। আর খিদা নাই, চিন্তা নাই। এই কথা বলে আকাশখোলা হাসি।
………………………………………………………………………………………….
ছোটবেলায় দেখতাম মেলায় একজন বৃদ্ধ মানুষ ঝুড়ি ভর্তি করে বিভিন্ন গাছ বিক্রি করত। মূলত ফুল ও ফল গাছ। অঙ্কুরিত বড় নারকেলও। একজন পাড়া ঘরের মহিলা পাশে কাঁঠাল রেখে বলছিল– লেবুচারা ঠিক দেখে দাও বাবা, এই গাছ আমি বাড়িতে নিয়ে গিয়ে মানুষ করি।
গাছ এখন বিক্রি হয় না। গলির দু’ধারে মেলা বসে। দমঠাসা ভিড়। রাত বাড়লে পাতলা হয়, বিকেলের আলোতেও বোঝা যায় না, ভিড় জমে সন্ধ্যাবেলা। আমি ঘুরে ঘুরে মানুষজনের কথা শুনি, বিভিন্ন মানুষজনের মুখের দিকে তাকাই, দৃশ্যগুলি অনুবাদ করার চেষ্টা করি। এ আমার একলার খেলা।
গতকাল মেলায় গিয়েছি একা। আগে মা-বাবার সঙ্গে যেতাম, তারপর বন্ধুরা, এখন নিজে নিজে অনেক সময় নিয়ে ঘুরি। প্রতিদিনের অভাব-অনটন থেকে মুক্তি, আনন্দরসের মুক্তির পতাকা এই রথযাত্রার মেলা। একজন বসে বসে পাঁপড় ভাজছে, কঞ্চিতে ইলেকট্রিক ডুম লাগানো, গরম তেলে পাঁপড় ছড়িয়ে যাচ্ছে, একরকমের নকশা হচ্ছে, পাশের পেতল গামলাতে চুড়ো করা জিলিপি। আমি পাঁপড় কিনছি, একজন খদ্দের বলছে– সনাতনদা, রঙের কাজে যাচ্ছ না কেন? সংসারে মন দাও, বাড়িতে এতগুলো পেট, দেখতে হবে তো!
সনাতন বেসনের হাত কাপড়ে মুছে খানিকক্ষণ চুপ। তারপর বলে, দাদা, বাড়ির সবাই মিলে সিমেন্ট গুলিয়ে চুমুক দিয়ে খেয়ে পেটে সিল মেরে নিয়েছি। আর খিদা নাই, চিন্তা নাই। এই কথা বলে আকাশখোলা হাসি।
ছোটবেলা থেকে যেভাবে দেখেছি, এখন পুতুল সংখ্যা কমে গিয়েছে। আগে সার বেঁধে আসত মাটির পুতুল বিক্রি করা মানুষেরা। বিভিন্ন রকমের পুতুল। কৃষ্ণনগরের মতো নিপুণ বা শো-পিস সাজানোর মতো নয় কিন্তু, ছাঁচে ফেলে গড়ে তোলা আঁকাবাঁকা পুতুল।
এই পেশার মানুষেরা উদ্বাস্তু পরিবারের। সাধারণত বাড়ির মহিলারা বসে বসে পুতুল গড়েন। রাধেকৃষ্ণের নৌকাবিলাস, হরগৌরী, মাটির টিয়াপাখি, ময়ূর, ঘাড় নড়া বুড়ো, জগন্নাথ, বাঁকুড়ার পোড়া মাটির ঘোড়ার কায়দায় তৈরি ঘোড়া।
এইসব পুতুলে এক ধরনের সহজ লাবণ্য আছে। একই পুতুল বিভিন্ন পরিবারের লোকেরা গড়ছে বলে পুতুলের চোখ, নাক, মকুটের রং ও আলপনা যাচ্ছে বদলে। প্রাণ কুঁদে গড়ে তোলা জিনিস এইসব।
এখন বাজার হারাচ্ছে এইরকম পুতুল। প্লাস্টিকজাত জিনিসে বাজার ছেয়ে যাচ্ছে। পরবর্তী প্রজন্ম মাটির জিনিস গড়তে চাইছে না। প্রতিটি মেলা, এইসব পুতুল, ছাঁচ, মাটি, রঙের সংরক্ষণ হওয়া প্রয়োজন।
……………………………………………..
পড়ুন পিনাকী ভট্টাচার্যের লেখা: বাঙালির স্নানযাত্রায় সুখ আছে, সংকোচ নেই
……………………………………………..
আমার চোখের সামনে দেখা একজন মহিলার শাড়ির পাড়ের নকশা, যা রাধার কাপড়ের পাড়ে, সেই এক নকশা বুনে রেখেছেন তিনি। আমি মন দিয়ে বসে বসে অনেকক্ষণ দেখলাম বয়স্কা এই শিল্পীকে।
বনকাপাসির শোলার কাজে সাজানো বিগ্রহ দেখে ফিরছি, দেখি, একজন ভুট্টা পোড়াচ্ছে আগুনে আর টাটকা কিছু পেয়ারা ডাঁই করে রাখা। এখন বড় কাঁঠাল দেখা যায় না। চেঁচিয়ে বলছে, জ্যান্ত পেয়ারা খলবল করছে, নিয়ে যান, নিয়ে যান– জ্যান্ত পেয়ারা! বাংলা ভাষাকে নিয়ে এইসব অপূর্ব নির্মাণকাজ শুনে মন ভরে উঠে।
তবে এই বছর সোজারথ-উল্টোরথ মিলিয়ে শ্রেষ্ঠ শোনা কথা হল একজন ঘুগনি বিক্রেতার। থিকথিক করছে ভিড়। নানা বয়সের নারীপুরুষ দাঁড়িয়ে।
একজন ভদ্রঘরের মহিলা বলল, এখানে কিনিস না রমা, কেমন বাসি বাসি লাগছে…
দোকানি প্রায় লাফ দিয়ে উঠে বলে– এহনি ছ্যাপ ফেইলা ডুইব্যা মরুম বাসি অইলে।
বোঝা গেল দোকানির বক্তব্য। ঘুগনি বাসি হলে রাস্তায় থুতু ফেলে তাতে ডুব দিয়ে সে মরে যাবে। এই অসম্ভব কল্পনার গায়ে সে করুণ সুরের বাতাস লাগিয়ে দিয়েছিল এবং কিছুটা আত্মবিশ্বাস। এই বছরের রথের মেলা দু’হাত ভরে আমাকে এইসব কথকতা দিল।
আকাশ আবার মেঘে ভার হয়ে আসে। বাংলার ভাষার কারুকাজ শুনে মন পূর্ণ করে ঘরের পথ ধরি, বিভিন্ন মেলাতেই এইসব হরেক দৃশ্য ও বিচিত্র কথার জন্ম হয়।