হরিয়ানার গ্রাম থেকে গুরগাঁও-এর কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টারে এসে পৌঁছে দেখেছি চিত্র কিছুই আলাদা নয়। ‘খোল দো’র শোয়ের পর সেখানকার শিক্ষিকা এবং ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আলোচনা শুরু হওয়ার মুহূর্তের মধ্যেই ক্লাসের মধ্যে পরিস্কার দুটো ভাগ হয়ে গেল। ছেলেরা বলতে লাগল, ‘ম্যাডাম কাজটা ভালো কিন্তু এসব আগেকার কথা। এখন এসব হয় না, মেয়েরা এখন অনেক স্বাধীন, অনেক অগ্রসর হয়ছে’। একেবারে সামনের সারিতে বসে থাকা একজন তরুণ শিক্ষিকা, ছেলেদের কথাগুলো শেষ হতে না হতেই, উঠে দাঁড়িয়ে জানিয়েছিলেন, ‘খোল দো’ দেখে তাঁর মনে হচ্ছে, এসব তিনি রোজই দেখেন।
জুন মাসের গরমে মাটি শুকিয়ে কাঠ। পা রাখা যাচ্ছে না। সন্ধে ছ’টা। ভারতের এই দিকের অঞ্চলে গরমকালে সূর্যাস্ত হয় আরও খানিকটা বাদে। গ্রামের মহিলারা মাথায় কলসি নিয়ে জল আনতে বেরিয়েছেন। তাঁদের জল আনার পথে আরও কিছুটা সময় বের করে একটি নাটক দেখতে আসার অনুরোধ করা হয়েছে তাঁদের। আগে থেকে অনেক বলে-কয়ে রাখায় বেশ কয়েকজন এসে জড়ো হয়েছেন গ্রামের মোড়ের মাথায় আম্বেদকর ভবনে। এঁদের বেশিরভাগই দলিত সম্প্রদায়ের। কয়েকটি ছোট বাচ্চা আছে, আর আছেন হাতে গোনা ৪-৫ জন পুরুষ। গ্রামের নাম চিড়ি-চাঁদনি। হরিয়ানার গ্রাম।
কী নাটক?
সাদাত হাসান মান্টোর গল্প ‘খোল দো’ অবলম্বনে করা আমার একটা ২০ মিনিটের ছোট কাজ।
পারফরম্যান্সের পর দু’-তিনজন মহিলা ব্লাউসের মধ্যে থেকে ১০ টাকার নোট বের করে দিচ্ছেন আমায়। কয়েকজন আবার কলসি নিয়ে রওনা দিচ্ছেন বাড়ির দিকে। এরই মধ্যে একটি ১২-১৩ বছরের মেয়ে তার মায়ের কাছে গিয়ে বলল, ‘দিদি যদি কলকাতা থেকে আসতে পারে আমাদের নাচ-নাটক দেখাতে, তাহলে আমি নাচলে বাবা আমায় বারণ করে কেন?’ মনে হল কেউ যেন আমায় আপাদমস্তক একটা ঝাঁকুনি দিয়ে গেল!
১৯৪৭-এর দেশভাগ-স্বাধীনতার পটভূমিকায় লেখা যে গল্প, ধর্ষণ নিয়ে লেখা যে গল্প, যে গল্পের জন্য অশ্লীলতার দায়ে আদালতে যেতে হয়েছিল মান্টোকে, সে গল্প ৭৫ বছর পেরিয়ে, ২০২২-এর জুন মাসে হরিয়ানার গ্রামের একটি বাচ্চা মেয়ের কাছে কী অভিঘাত আনতে পারে, সেটা দেখে সব হিসেব, সব প্রস্তুতি গুলিয়ে গেছিল। সেই গুলিয়ে যাওয়া থেকে অনেক শিক্ষা আর সাহস সঞ্চয় করতে পেরেছিলাম, যেটা হয়ে উঠেছিল ‘খোল দো’-র শো নিয়ে বাকি পথ চলার পাথেয়। আমার মাথায় যখন ঘুরছে দেশভাগ, বিস্থাপন, ট্রমা, যৌন নিগ্রহ, পিতৃতন্ত্র, সাম্প্রদায়িকতা, তখন সেই বাচ্চা মেয়েটার আপাত সারল্যে জানানো তার নাচ করার গভীর ইচ্ছার কথা শুনে থমকে গেছিলাম কয়েক মুহূর্ত। কিছুটা থিতু হয়ে বুঝতে পেরেছিলাম, আসলে সে পিতৃতন্ত্রের কথাই বলছে, নিগ্রহের কথাই বলছে, বিস্থাপনের কথাই বলছে। এটা ধরতে সময় লেগেছিল কারণ, আমার নাচ শেখা (মূলত কথক), শেখানো, পারফরম্যান্স, গবেষণা, বিভিন্ন শিল্পীদের সঙ্গে কাজ, এসব মিলিয়ে যে চর্চা, তার থেকে দর্শকের ‘প্রতিক্রিয়া’ বলতে আমি যা সাধারণত বুঝি, সেই খোপের বাইরে সেই বাচ্চা মেয়েটির ইচ্ছের কথাটা! কারণ পারফরমারের স্কিল থেকে পিতৃতন্ত্রের বিরোধিতা, লিঙ্গ বৈষম্য, হায়ারার্কি এর’ম প্রভৃতি যে সংজ্ঞা এবং ভোকাবুলারি নিয়ে আমার যাপন, তার অনস্বীকার্য ‘শ্রেণির’ পরিসরের বাইরে যে বিশাল একটা দুনিয়া, সেখানে এইসব সংজ্ঞা আর ভোকাবুলারির চেহারাটা ঠিক কীরকম তার থেকে, আমি-আমরা কতটা বিচ্ছিন্ন, চিড়ি-চাঁদনির বাচ্চা মেয়েটা আমায় বুঝিয়ে দিয়েছিল।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
‘দুধ কিনতে যাব, এখন সময় নেই’ বলে যে বৃদ্ধা নাটকের আগে হুড়মুড়িয়ে হাঁটছিলেন, তিনি কোন এক অন্ধকার গলি থেকে বেরিয়ে এসে আমার হাতে দশ টাকা দিয়ে বলেন, ‘ভালো থেকো মা’। আবার তড়িঘড়ি চলে যান। তাঁর দুধের ক্যান তখনও খালি! সলিডারিটি আর সিস্টারহুড নতুন ভাষা পায়!
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
প্রতিটা পারফরম্যান্সের তো কিছু প্রস্তুতি থাকে– একটা কাজ সে কীভাবে তৈরি করবে? কেন সেই কাজটা সে করছে? কী সে বলতে চায়? কাদের কাছে পৌঁছতে চায়? এসব নানা বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে যেতে যেতে তৈরি হয় একটা কাজ এবং পাশাপাশি একজন পারফরমার। ‘খোল দো’র গোড়ার দিকে এই শো-টি আমার এই বোঝাপড়ায় একটি গভীর ছাপ রেখে গেছে। ২০২২-এর মে থেকে শুরু করে ২০২৪-এর জানুয়ারি পর্যন্ত যে ২৫টা শো আমি করেছি দিল্লি, হরিয়ানা, চেন্নাই, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি জায়গায়, সেই সব শো-এর বিভিন্ন দর্শকের প্রতিক্রিয়াগুলো জড়ো করে যে আকর তৈরি হয়েছে, তা আমার কাছে বিশাল পাওনা। তার থেকে কয়েকটি প্রতিক্রিয়া এই লেখায় উল্লেখ করব। মান্টোর ক্ষুরধার লেখার শক্তি এবং সফলতা যে কতখানি, কতখানি গভীর যে পর্যবেক্ষণ এবং সাত দশক পেরিয়েও তাঁর প্রাসঙ্গিকতা, ‘খোল দো’ নিয়ে সফর করার সূত্রে আমার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে বারবার এসে জমা হয়েছে সেসব অনুভূতি, যার কিছুটা পাঠকদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাইছি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: সফদর মারা গেছে, কিন্তু ধমনীতে সে বেঁচে
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
মান্টোর মৃত্যুবার্ষিকীতে লেখার অনুরোধ করা হয়েছে আমায়। কিন্তু মান্টোর নাম দেশভাগের সাহিত্যের সঙ্গে ওতপ্রোত হলেও তাঁর আফসানা, তাঁর প্রেমের গল্প, ফিল্মের গল্প, সব মিলিয়ে মান্টো বিচিত্র, বিস্তৃত। আমি প্রায় দু’বছর ধরে ‘খোল দো’ করার সূত্রে যে মান্টোকে দেখেছি, বুঝেছি তারই কিছু কথা থাকবে এই লেখায়।
হরিয়ানার গ্রাম থেকে সোজা গুরগাঁও-এর কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টারে এসে পৌঁছে দেখেছি চিত্র কিছুই আলাদা নয়। ‘খোল দো’র শোয়ের পর সেখানকার শিক্ষিকা এবং ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আলোচনা শুরু হওয়ার মুহূর্তের মধ্যেই ক্লাসের মধ্যে পরিস্কার দুটো ভাগ হয়ে গেল। ছেলেরা বারবার আমায় বলতে লাগল, ‘ম্যাডাম কাজটা ভালো কিন্তু এসব আগেকার কথা। এখন এসব হয় না, মেয়েরা এখন অনেক স্বাধীন, অনেক অগ্রসর হয়ছে’। একেবারে সামনের সারিতে বসে থাকা একজন তরুণ শিক্ষিকা, ছেলেদের কথাগুলো শেষ হতে না হতেই, উঠে দাঁড়িয়ে জানিয়েছিলেন, ‘খোল দো’ দেখে তাঁর মনে হচ্ছে, এসব তিনি রোজই দেখেন। বোধ করি অনেকদিনের চাপা অপমান আর রাগ উগড়ে দিতে দিতে বলছিলেন, বাড়ি থেকে জোর করে তাঁকে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। তিনি নাছোড়বান্দা– শিক্ষকতা করবেনই। তাই তিনি তাঁর বাড়ি ছেড়ে সেই কম্পিউটার সেন্টারে পড়াতে এসেছেন। কিন্তু সেখানে তিনি ‘মহিলা’ বলে বেশিরভাগ লোক তাঁর ক্লাসে যায় না! ক্লাসে কয়েক মুহূর্ত নীরবতা।
তারপরেই ছেলেগুলো আরও তীক্ষ্ণ আক্রমণ শুরু করল। শোয়ের পর প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে চলেছিল বাগবিতণ্ডা– রিজারভেশন পলিসি, বাসে-ট্রেনে মহিলা সিটের ব্যবস্থা থেকে মেটার্নিটি লিভের প্রয়োজনীয়তা– কত কি না উঠে আসে সেদিন কথনবার্তায়! সূত্র সেই ‘খোল দো’। আরেকবার পরিস্কার হয়ে ওঠে আমার কাছে গল্পে বর্ণিত ‘হিংস্রতা’র স্তর কত গভীর, তার প্রকাশ আর পরিসর কত জটিল আর ব্যাপ্ত। তাই দেশভাগের সময় লেখা যে গল্প, আপাতভাবে আমাদের থেকে দূরের ইতিহাস, তার কথা ‘খোল দো’-তে দেখেশুনে অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ২০-২১ বছর বয়সি ছাত্রী আমার হাতটা ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলছিল, ‘আমার ঠাকুমা এখনও মাঝরাতে চিৎকার করে ওঠে, কেঁদে ওঠে। আমি বড় হয়ে জেনেছি উনি দেশভাগ ভুলতে পারেননি।’ সেই একই নাটক, গাজিয়াবাদের বহুজন সমাজবাদী মঞ্চের সদস্যদের সামনে করার পর একজন পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তি বলেছিলেন, ‘ম্যাডাম, আপনার এই কাজটা দেখে মনে হচ্ছে আমার স্ত্রীকে আমি কোনও দিন তো সকালে চা খেতে দেখিনি! কিন্তু সে চা খায়। তাহলে কখন খায়? সে শুধু আমায় চা দেয়, খাবার দেয়, টিফিন দেয়। রোজ দেখি। আমি তাকে বিদেশে বেড়াতে নিয়ে গেছি, কিন্তু সকালে চা খেতে দেখিনি!’ পিতৃতন্ত্র, লিঙ্গবৈষম্য, হায়ারার্কি এইসব শব্দের নানা পরত খুলে যায় আমার সামনে একটি শো থেকে আরেকটি শো তে…
বৈদ্যবাটির চাঁপসরাতে যখন রাস্তার তেমাথায় ৬ ডিসেম্বরের সন্ধেবেলায় নাটকটা করি, সামনে বিছানো তেরপলে বাচ্চারা বসে। তাদের মায়েরা সবাই আছেন, যে যার বাড়ির দালানে, দূরের রোয়াকে, পাশের গলির মুখে। সামনে ‘দর্শক’ আসনে তাঁরা অনুপস্থিত। কারণ বাড়ির দাদাদের, পাড়ার দাদাদের কড়া নজরদারি সামলে বাঁচতে হয় তাঁদের। প্রাণভয় আছে, ভয় আছে বাচ্চাদের জন্য। কিন্তু শো শেষে সন্তর্পণে এসে ২০-৩০ টাকা রেখে যান তেরপলে। আমার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে জানিয়ে যান তাঁরা দেখেছেন! ‘দুধ কিনতে যাব, এখন সময় নেই’ বলে যে বৃদ্ধা নাটকের আগে হুড়মুড়িয়ে হাঁটছিলেন, তিনি কোন এক অন্ধকার গলি থেকে বেরিয়ে এসে আমার হাতে দশ টাকা দিয়ে বলেন, ‘ভালো থেকো মা’। আবার তড়িঘড়ি চলে যান। তাঁর দুধের ক্যান তখনও খালি! সলিডারিটি আর সিস্টারহুড নতুন ভাষা পায়!
এভাবেই ২৫টা শোয়ের বিভিন্ন দর্শকদের কাছ থেকে সাহস সঞ্চয় করে সঞ্জীবিত হয়ে উঠি আমি। ‘কথক’ নাচের মূলে যে গল্প বলার প্রচলন, নাচের সংগ্রহে যে অভিনয় আর তাল-ছন্দের অপরিসীম রসদ, তাকেই অনুসরণ করে, নিজের চারপাশের গল্প বলব বলে এই কাজের শুরু। চারপাশের পরিস্থিতিতে যখন দমবন্ধ হয়ে আসছে, তখন বিষাদ এবং বিরোধিতা কিছুটা হলেও প্রকাশ করতে পারব এই উদ্দেশ্যেই এই কাজের শুরু। এবং সেই সূত্রে না-বলা, না-শোনা থেকে যায় যে গল্প, সেই সব ‘অন্যদের’ গল্প শুনতে পাব, কিছুটা হলেও একটা নীরবতাকে ভেদ করতে পারব– সেই আশা নিয়েই এই কাজের শুরু। সাফল্যের কথা জানি না, কিন্তু এটুকু সাহসে উপনীত হতে পেরেছি যে, নিজের জানাগুলোকে প্রতিমুহূর্তে ঝালিয়ে নিতে এবং একইসঙ্গে দুমড়ে-মুচড়ে পালটে নিতে সাহায্য করছেন মান্টোর (এই) লেখা।