করুণা দেবী এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, প্রথমে তিনি সর্বজয়ার চরিত্রটি করতে চাননি। কারণ একটি গ্ৰামের বিবাহিত মহিলার চরিত্রে অভিনয় করা নিয়ে আশঙ্কায় ছিলেন। পরে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে তিনি ভরসা পান এবং চরিত্রটিকে আপন করে নেন। অনেকবার ভেবেছি, এই কথাটি তিনি কোন জায়গা থেকে বললেন। সেই সময় গ্ৰামের বিবাহিত মেয়ে মানে এক প্রকারের দেখার ভঙ্গি প্রচলিত ছিল কী? চলচ্চিত্রে এই ধরনের চরিত্র দেখানো মানে কি চরিত্রটি ‘সাবমিসিভ’ বা শুধুই পেলব? শহরের মেয়ে মানে খোলামনের আর এক প্রকারের আধুনিক? যদিও এইগুলো স্রেফ অনুমান। এর কোনও ছাপ করুণা দেবীর সর্বজয়ায় আমরা দেখতে পাই না।
বিবাহ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে উপস্থিত নানা স্তরের পুরুষতান্ত্রিকতাকে এমনিতে সমাজ ‘স্বাভাবিক’ বলেই মনে করে। যদিও আজকাল কিছু কিছু প্রতিরোধ উঠছে, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। ঠিক এর’ম সময় করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ট্রিবিউট জানিয়ে একটা লেখা লেখার সুযোগ পেলাম। তাঁকে সিনেমা জগতের মায়ের চরিত্রের প্রতীক হিসেবে ঘোষণা করে বাক্সবন্দি করার জন্য নয়, বরং একজন উচ্চশিক্ষিত মহিলা, শহরে পড়াশোনা করে বেড়ে ওঠার পর, একজন দরিদ্র সহনশীল গ্রামের বিবাহিত মহিলার চরিত্রে নিজেকে আত্মসমর্পণ করার জন্য তাঁকে সেলাম জানানোর এ এক ক্ষুদ্র প্রয়াস মাত্র।
প্রথমেই ‘পথের পাঁচালী’ এবং ‘অপরাজিত’-তে তাঁর সর্বজয়া চরিত্রের ভূমিকা মাথায় আসে। যদিও অপরাজিত-তে তাঁর ভূমিকা নাড়া দেয় আরও বেশি। কারণ প্রথমেই নিজের কন্যাসন্তান দুর্গা, তারপর অপরাজিত-য় তাঁর স্বামীকে হারিয়ে, ভিটেমাটি থেকে দূরে ছোট্ট অপুকে নিয়ে সর্বজয়া একজন সার্ভাইভারের প্রতীক হয়ে ওঠেন। বা একজন আন্ডারডগ। করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় চাইলে হয়তো একজন একা মা হিসেবে সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়া চোখে জলভর্তি সর্বজয়ার চিত্রণ বেছে নিতে পারতেন। কিন্তু অপরাজিত ছবিতে তিনি আগের থেকে আরও শক্ত, তাঁর চোখ দুটো স্থির। অপুর ও নিজের জীবন সে কোনওভাবেই ভেস্তে দেবে না– সে যাই হোক। অবশ্যই এর মধ্যে পুরোপুরি সত্যজিৎ রায়ের নির্মাণ দেখা যায়। ‘পথের পাঁচালী’-তে দুর্গা মারা যাওয়ার পর করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় মুষড়ে পড়েছেন, তিনি অসহায়। প্রথম সন্তান হারানোর দুঃখে তিনি আকাশ ভাঙা বিষাদের সামনে বিষণ্ণমূর্তি। অপরাজিত-য় স্বামী হরিহরকে হারানোর পর অভিনেত্রী করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শরীরী ভাষা একজন পারদর্শী যোদ্ধার মতো। জীবনের সংকট সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট ওয়াকিবহাল।
ছোটবেলা থেকে গুরুজনদের থেকে শুনে এসেছি, যদি তোমার অভিনয় দেখে যদি বোঝা যায় তুমি অভিনয় করছ, তাহলে সেটা সক্ষম অভিনয় নয়। করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয় কোথায় শুরু হচ্ছে আর কোথায় শেষ– ধরতে পারা যায় না। অবশ্যই লেজেন্ডদের ক্ষেত্রে এই ম্যাজিকটা উপভোগ করাটাই স্বাভাবিক।
করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, প্রথমে তিনি এই চরিত্রটি করতে চাননি। কারণ একটি গ্ৰামের বিবাহিত মহিলার চরিত্রে অভিনয় করা নিয়ে তিনি ছিলেন আশঙ্কায়। পরে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে তিনি ভরসা পান এবং চরিত্রটিকে আপন করে নেন। অনেকবার ভেবেছি, এই কথাটি তিনি কোন জায়গা থেকে বললেন। সেই সময় গ্ৰামের বিবাহিত মেয়ে মানে এক প্রকারের দেখার ভঙ্গি প্রচলিত ছিল কি? চলচ্চিত্রে এই ধরনের চরিত্র দেখানো মানে কি চরিত্রটি ‘সাবমিসিভ’ বা শুধুই পেলব? শহরের মেয়ে মানে খোলামনের আর এক প্রকারের আধুনিক? যদিও এইগুলো স্রেফ অনুমান। এর কোনও ছাপ করুণা দেবীর সর্বজয়ায় আমরা দেখতে পাই না। শুধু দেখতে পাই, চরিত্রটির প্রতি সম্পূর্ণ সহানুভূতি, তার জীবনে প্রবল দরিদ্রের জন্য কাছের মানুষদের হারানোর বেদনা। সে ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’র লাবণ্য হোক, সর্বজয়া হোক, বা মৃণাল সেনের ‘ইন্টারভিউ’য়ে রঞ্জিত মল্লিকের মা– তিনটে চরিত্রের ক্ষেত্রে তাঁর অভিনয়কে আমরা যাপনে পরিণত হতে দেখি।
এই প্রবল সহানুভূতি, মানুষের সংকট বোঝা, যাপন করার শক্তি হয়তো তাঁর দীর্ঘদিনের থিয়েটারের সঙ্গে সম্পর্কের জন্যও হতে পারে। করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম খুলনায়, ১৯১৯ সালে। তখন ব্রিটিশদের উপনিবেশিক রাজ চলছে। আর ভারতীয় সরকার কংগ্রেসের হাতে। দুর্ভিক্ষ চরম পর্যায়ে। গোটা উপমহাদেশ জুড়ে এবং বাংলায় সংবাদমাধ্যম খুবই উচ্চৈস্বরে ব্রিটিশের অত্যাচারের বিরুদ্ধে গলা তুলছে। তিনি কলকাতায় যোগমায়া দেবী কলেজে পড়াশোনা শেষ করেন। সাংবাদিক সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিয়ে করার পর বোম্বে থাকা শুরু করেন। ওখানে থাকতে থাকতে যোগ দেন ভারতীয় গণনাট্য সংঘে। নিষিদ্ধ দলের সঙ্গে নাটক করা, রিহার্সাল করা– এই যাপনে প্রবেশ করেন। তখন শুরু হয়ে গিয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। করুণা দেবীর পৈতৃক পরিবার কংগ্রেস-বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর স্বামী বিশ্বাসী মার্কসবাদে। তিনিও ক্রমশ সমাজবাদের দিকে এগোতে থাকেন। রাজনৈতিকভাবে সচেতন করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় মানুষের দুর্ভিক্ষ দেখেছেন সামনে থেকে। থিয়েটারের মাধ্যমে তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ ফুটিয়ে তোলা জীবন দিয়ে তিনি এক গৃহবধূ, বিবাহিত গ্রামের মেয়ে সর্বজয়াকে আরও মানুষের কাছাকাছি করে তুলতে পেরেছিলেন।
একটি সিনেমা তৈরি, তার ভাবনা– গোটা পদ্ধতি নিয়ে বিস্তর আলোচনা আমরা পরিচালকদের অনায়াসে করতে দেখেছি। সত্যজিৎ রায় তাঁর সিনেমা নিয়ে বলেছেন। মৃণাল সেন তাঁর ছবির রাজনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থান নিয়ে বলেছেন। করুণা দেবী নিজের লেখকসত্তা থেকে তাঁর করা সিনেমা ও থিয়েটারের জীবন নিয়ে বিস্তর আলোচনা এবং মতাদর্শ তুলে ধরেছেন নৈর্ব্যক্তিকভাবে। করুণা দেবী– অভিনেতা, জীবনদ্রষ্টা, লেখিকা করুণা দেবীকে একসঙ্গে নিজের মধ্যে বহন করেছেন। তাঁর লেখা দু’টি বই: ‘অ্যান অ্যাকট্রেস ইন হার টাইম’ এবং ‘সর্বজয়া’ পড়লেই সে আঁচ মেলে। তাঁর লেখা মৃণাল সেনকে নিয়ে একটি স্কেচও রয়েছে, যেখানে উনি বলেন যে, মৃণাল সেন এমন একজন ব্যক্তি যিনি তাঁর আশপাশের সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে ভীষণই সংবেদনশীল। তাঁর অনুভূতির জায়গা থেকে তিনি সমাজকে তাঁর ছবিতে তুলে ধরতে চান। নিজের ছবির ফর্ম নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করেন। আমরা ডিরেক্টরদের দেখেছি, নিজেদের অভিনেতাদের প্রতি ভালোবাসা এবং স্নেহ নিয়ে কথা বলতে। করুণা দেবী অভিনেতা হিসেবে সেসময় দাঁড়িয়ে এই একই অবস্থান নিয়েছেন। যে-সব পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন, তাঁদের নিয়ে লিখেছেন। মেঠো সর্বজয়ার চরিত্রে অভিনয় করা করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের বইতে সাফদর হাশমির ‘হাল্লা বোল’ নাটকটি দেখে লিখেছেন একটি পথনাটক। মানুষের এত কাছাকাছি পৌঁছে মানুষের হয়ে কথা বলছেন, তাও-বা একটি রাজনৈতিক কার্টুনের আকার ধারণ করে। করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের অন্তর থেকে অভিনয় দিয়ে মানুষকে মুগ্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর আশপাশের শিল্প, নাটকের ফর্ম, ক্রাফট দিয়ে তাঁর মতামত দিয়েছেন।
কাঞ্চনজঙ্ঘা ছবিতে করুণা দেবীর লাবণ্য পাহাড়ের বুকে নীরবতা ভেঙে তাঁর মেয়েকে সাহস দিয়ে বলেন যে, সে যদি বিয়ে করতে না চায়, তাঁকে বিয়ে করতে হবে না। সর্বজয়া হরিহরের সঙ্গে সংসারের অর্থনীতি বুঝে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ছেলেমেয়েদের মানুষ করল।
এ বিপ্লবের চেয়ে কম কী!
মজার বিষয়, শ্যাম বেনেগাল যখন হঠাৎই 'বোস: দ্য ফরগটেন হিরো' বানাচ্ছেন, এনডিএ আমলের শেষ ও ইউপিএ আমলের শুরুর আবহে, তার আশপাশে ভগৎ সিংয়ের গোটা দুই বায়োপিক মুক্তি পেয়ে গেছে, একটিতে নায়ক অজয় দেবগণ, অন্যটিতে সানি দেওল। অজয় দেবগণ অভিনীত বায়োপিকটিই বেশি স্মর্তব্য হয়ে রইল, সানি দেওলের 'ঢাই কিলো কা হাত' এক্ষেত্রে অকেজো হয়ে গেল।