বিকেল মিইয়ে পড়লে ব্যায়াম করার ভঙ্গিতে ছুঁয়ে নেন পায়ের আঙুল। হাততালি দেন। এলোমেলো হাসেন। কোনও অ্যাকশন নেই, কোনও কাট বলা নেই। সাউন্ড রোলিং হতে হতে ঢুকে পড়ছে বাইরের খুচরো জরুরি শব্দ, যা ছাড়া জীবন হয় না। সিনেমা হয়তো হয়। চলতে থাকে তাঁর জীবনের গালগল্প। যা তিলে তিলে গড়ে তুলেছে সঞ্জয় মিশ্রাকে। বহু বহু সিনেমায় তাঁর অসামান্য অভিনয় দেখার পরও, কেন মনে হয় এই আত্মজীবনীটি, এই না-অভিনয়টিকেই সবথেকে ভালোবেসে ফেলেছি আমি।
বেনারস। গঙ্গার ঘাট। ছলাৎছল। গোটা পঞ্চাশেক মানুষের জটলা। জটলার কেন্দ্রে এক মহাজাগতিক বাঁশিওয়ালা– উস্তাদ বিসমিল্লা খাঁ। রয়েছে কয়েকজন বিদেশিও। একটি বছর ষোলোর উসখুসে, চঞ্চল ছেলেও সেখানে জুটেছে। বিসমিল্লা খাঁ বাঁশি বাজাতে শুরু করলেই, সে আগাপাশতলা ডুবে যায় সুরে। তবলা বাজায়, সঙ্গত করে।
কিন্তু কোথায় তবলা! তার তো অস্তিত্বই নেই! কিন্তু বাবু হয়ে বসে থাকা সেই ছেলের দুটো হাঁটু আছে। হাঁটুই তবলা হয়েছে তখন। চোখ বন্ধ করে, বেজায় মাথা নেড়ে, সে বাজাতে থাকে তার হাঁটু দু’খানা—– তখন তারা ‘ডাহিনা’ আর ‘বাঁয়া’। বাঁশি শুনে শরীরেরই একটা অংশ হয়ে ওঠে বাদ্যযন্ত্র।
এই হল শরীরে সুর পাওয়া। রক্ত চলাচলের মতো সুর। কিন্তু সেই সুর প্রবেশ করছিল কান দিয়ে। যে-কান আজকাল আর শুনতে চায় না তেমন। কথার মধ্যে যে রহস্য, তাকে আর ধরে রাখতে চায় না স্মৃতিতে। কথা যেন অনর্গল, প্রবাহসম্বল।
একথা বলার কারণ, সেই ষোলোবর্ষীয় বালক আজ ৬০-এ পা দিলেন। তিনি, অভিনেতা সঞ্জয় মিশ্রা। তিনি বলছেন, শোনা জরুরি। আজকাল আমরা নিজেদের শোনা বন্ধ করে দিয়েছি। এই ‘নিজেদের’ বলতে শুধু মানুষ না, আশপাশ, প্রকৃতি-নির্মিত শব্দতরঙ্গও এসে পড়ে। একথা বলার পরই, তিনি চুপ করলেন, আর শোনা গেল পাখির ডাক, গরুর গলার ঘণ্টা। তিনি আঙুল তুলে দিকনির্দেশ করছেন। সে আঙুল– তর্জনী। এসব শোনানোর পর, তিনি বলে ওঠেন, ‘ম্যায় কিউ সাইলেন্স ব্রেক কর রাহা হু?’ অতর্কিতে মনে পড়ে যায়–
‘মনে হয় যেন খুব বেশি বলা হয়ে গেল এই কতদিনে। সমস্ত দিনের পর গভীর রাতে বাড়ি ফিরে গ্লানির মতো লাগে। কথা, কথা। যেন একটু চুপ ছিল না কোথাও, থাকতে নেই, হাতে হাত রাখতে নেই। যে-নীরবকে খুঁজতে বেরিয়েছিল সবাই মিলে, কোথায় সেসব মিলিয়ে গেল বাতাসে, যেন সেসব জানতে নেই কখনো।’ (নিঃশব্দের তর্জনী। শঙ্খ ঘোষ)
সঞ্জয় মিশ্রা বলছেন, তাঁর তাড়া নেই। অভিনয়-টভিনয় কতদিন? মাঝে মাঝে সব ছেড়ে, চুপচাপ, স্লো। কলাগাছের লাল ফুল দেখা। শান্ত করা নিজেকে। যারা এগিয়ে যাচ্ছে, যাক। কিন্তু স্লো ভালো, ভালো একটু জিরিয়ে শুষে নেওয়া আস্ত এই জীবনটাকে।
জীবন আর জীবনবোধের মধ্যে এটাই বোধহয় পার্থক্য। বাঁচা আর ফাটিয়ে বাঁচার মধ্যেও। কোথায় বলছেন এসব কথা? না, কোনও সিনেমায় নয়, কোনও চরিত্রের মুখ দিয়ে নয়। সঞ্জয় মিশ্রা যে চরিত্র পেয়েছেন এই পৃথিবীতে, তিনি সেই সঞ্জয় মিশ্রা হয়েই বলছেন। বলছেন ‘দ্য স্লো ইন্টারভিউ’তে। নীলেশ মিশ্রার নেওয়া এই ‘স্লো’ সাক্ষাৎকার। যার মধ্যে কোনও তাড়াহুড়ো নেই। কথার পিঠে চতুর কথার বিষম ভার চেপে যায় না। এই সাক্ষাৎকার মুক্ত ও জাদুকরী। সমস্ত দ্রুততার ভেতর এ এক জলজ্যান্ত বাঁচার বিজ্ঞাপন।
হলুদ ফুলের খেত নেপথ্যে। দু’-তিনটে পাতাঝরা ন্যাড়া লম্বা গাছ। তার তলায় সেই সাধারণ দুটো খাটিয়া। জুতো খুলে উঠে বসেছেন তাঁরা। বিকেলের তুলো রোদ এসে পড়ছে গায়ে-হাতে-মুখে। সঞ্জয় মিশ্রা বলে যাচ্ছেন নিজের জীবন। আত্মজীবনী। নড়ছেন-চড়ছেন। গান গাইছেন। সারা শরীর কথা বলার সময় জেগে উঠছে তাঁর। চোখ-মুখের প্রতিটা ভাঁজ, গলার স্বর, বলার ভঙ্গিমা– কথায় কথায় বদলে বদলে যাচ্ছে। আড্ডা চলতে চলতেই কখন যে তাঁরা এলিয়ে পড়েন, হেলান দেন পাশবালিশে– দর্শকের চোখের আরাম হয়। লোভ হয় সেই এলানো বাঁচায়, বিকেলের রোদে খাটিয়ায় শুয়ে থাকাকে নিজের উচ্চাশা বলে মনে হয়।
বিকেল মিইয়ে পড়লে ব্যায়াম করার ভঙ্গিতে ছুঁয়ে নেন পায়ের আঙুল। হাততালি দেন। এলোমেলো হাসেন। কোনও অ্যাকশন নেই, কোনও কাট বলা নেই। সাউন্ড রোলিং হতে হতে ঢুকে পড়ছে বাইরের খুচরো জরুরি শব্দ, যা ছাড়া জীবন হয় না। সিনেমা হয়তো হয়।
চলতে থাকে তাঁর জীবনের গালগল্প। যা তিলে তিলে গড়ে তুলেছে সঞ্জয় মিশ্রাকে। বহু বহু সিনেমায় তাঁর অসামান্য অভিনয় দেখার পরও, কেন মনে হয় এই আত্মজীবনীটি, এই না-অভিনয়টিকেই সবথেকে ভালোবেসে ফেলেছি আমি। একইসঙ্গে, এই ঘটনাবহুল বিচিত্র জীবন যদি সিনেমা না হয়, কাকে বলব সিনেমা!
ছোট থেকেই সঞ্জয় মিশ্রা বিশ্বাস করেন ‘মাহোল’ শব্দটিতে। বাংলায় বললে, ‘আবহ’, যা হয়ে দাঁড়ায় আবহ-নির্মাণ। গড়ে তুলতে হবে তা, যেন-তেন প্রকারে। তবেই জীবন জাদুকরী। বলছেন, আমি ‘মাহোলবাজ’। উদাহরণ দিচ্ছেন সরোদবাদক যতীন ভট্টাচার্যর। যাঁর সঙ্গে সবসময় মজুত থাকত আতর। যখনই তিনি স্টেজে উঠতেন, গায়ে মেখে নিতেন নানা সুগন্ধি আতর। কারণ তিনিও বিশ্বাস করতেন এতে তৈরি হয় একরকম ‘আবহ’, তা না থাকলে ব্যাপারটা ঠিক জমে না।
লচ্ছু মহারাজ, প্রবাদপ্রতিম নৃত্যশিল্পী, দুরন্ত তবলাবাদক, গামছা পরেই চলে আসতেন সঞ্জয় মিশ্রার বাড়িতে। কিশোর সঞ্জয়ের খুবই ইচ্ছে, সে-ও মহারাজের মতোই তবলা বাজবে! তাই খানিক পিছু করে মহারাজের, কী কী করেন মহারাজ তাই দেখতে। গিয়ে দ্যাখে, এক পানের দোকান থেকে পান নিলেন, মুখে পুরে হাঁটা লাগালেন। আচ্ছা, এই তবে ব্যাপার, নির্ঘাত ওরকম তবলা বাজাতে গেলে, পান খেতে হয়– বুঝল সেই মাহোলবাজ।
সঞ্জয়ও সেই পান কিনেছিলেন দোকান থেকে, কিন্তু সেরকম মজা পাননি খেয়ে। মনে হল, কিছু একটা গোলমাল হচ্ছে। পরক্ষণেই বুঝলেন, গোলমালটা কী। কারণ, তিনি তো প্যান্ট পরে! তিনি খালি গায়ের লচ্ছু মহারাজের মতো আনন্দখানা পাবেন কী করে! অতএব গামছা পরে, খালি গায়ে হাজির হলেন সেই পানের দোকানে। ‘পান দিও ভাইয়া!’ এখানে সেই মাহোল তৈরি হল সফলভাবে।
প্রায় ১ ঘণ্টা ২০ মিনিটের এই সাক্ষাৎকার দেখার পর, জীবন শান্ত হয়ে আসে। শ্বাস নিতে নিতে ফিরে আসে, পুরনো ভুলে যাওয়া টুকরোটাকরা গন্ধও। যা কিছু ছোট, ফেলনা, তাকেও এ জীবনে মনে হয় জরুরি। জীবনকে আরেকটু যত্ন করতে ইচ্ছে করে। মনে হয়, একটু আতর দিই এই জীবনের গায়ে। ডাবে দু’বার টান দিই, দেখে নিই, সবটুকু জল খেয়েছি কি না। উঁকি মারি, শাঁস আছে? তাহলে ডাবেরই ছাল দিয়ে তুলে খাওয়া যাবে।
যিনি সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন, তিনি নিজের সত্তাখানা হাট করে খুলে দিয়েছেন, এমন কাজ খাস বাংলাতেই করেছিলেন অঞ্জন দত্ত। যদিও তাঁর ঘরানা আর নীলেশ মিশ্রার ঘরানার মধ্যে পার্থক্য অনেক। কিন্তু মনে রাখতে হয়, ‘চলো অঞ্জন’-এর প্রত্যেকেই এসেছিলেন বেড়াতে, অঞ্জন দত্তর সঙ্গে। একটু ছুটিতে, বিরামচিহ্নে।
বিরামচিহ্নই তো ‘স্লো’ হতে বলে। বলে, ধীরে। খোলাখুলি কথা হোক। বলো তোমার জীবন, শুধু জীবন না, জীবন দর্শন। আজ ৬০ হল আপনার, তবে বুড়ো হলেন না। আর আপনিই তো বলেছেন ছোটবেলা আর ছোটবেলামি– কোনও দিন ফুরোতে দেওয়া উচিত নয়। সে মানুষ যদি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত না থাকেন, তাও।
মাহোল বজায় থাক মিশ্রাজি। শুভ জন্মদিন।