১১ জানুয়ারি চলে গেলেন দেবারতি মিত্র। মনে পড়ছে, এর ঠিক একবছর আগের বই প্রস্তুতির দিনগুলোর কথা। তখনও বুঝিনি, সেই বই বইমেলা নয়, এপ্রিলে আপনার জন্মদিনেও নয়; প্রকাশিত হবে জুলাই-অগাস্ট মাসের কোনও এক অখ্যাত, সাধারণ কর্মমুখর বর্ষার দিনে এবং শুধুমাত্র আপনার কারণেই সেই দিনটা আমাদের কাছে অলৌকিক পরব হয়ে থেকে যাবে চিরকাল। বইয়ের নাম ভেবেচিন্তে রাখা হল– ‘ফুল, পুতুল আর আগুন’; দেবারতি মিত্রের নির্বাচিত সাক্ষাৎকার এবং অগ্রন্থিত গদ্যের বই।
তুমুল অভিমানে সরে যাওয়া আদি-গঙ্গা থেকে একঝলক হাওয়া এসে উড়িয়ে দিল সাদা থান– এভাবে তাঁর মুখ দেখতে চাইনি আমরা কেউ। তবু এভাবেই তিনি দেখা দিলেন–স্তব্ধ, অতিদূর, রণক্লান্ত হয়ে। যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট ওই মুখে রোগভোগের কালশিটে। শুয়ে আছেন দেবারতি। তাঁকে ধারণ করে রয়েছে পবিত্র মেদিনী। এই অপস্রিয়মাণ শীতের বেলায় যে-হাওয়া বইছে, তা কোনও পুরাণপ্রান্তরের হাওয়া– তাঁকে নিয়ে যাবে বলে বহুদূর থেকে উড়ে এসে বসেছে ওই চায়ের দোকানে। একটু জিরিয়ে নিচ্ছে। সেই অপেক্ষায় তখন একে-একে মনে পড়ে যাচ্ছে আমাদের সমবেত না-দেখা ঘটনাক্রম। ৩১ ডিসেম্বর, দু’-হাজার আঠারোর পরে, আমরা কেউই তাঁর সঙ্গে থাকতে পারিনি। আমাদের পক্ষে আর থাকা সম্ভব ছিল না। বোড়াল-শ্মশানের রাস্তা ফুরনোর একটু আগেই ‘যোগিয়া বাড়ি’ বরাবরের মতো হারিয়ে ফেলেছে তার অধিষ্ঠানকে। তবে এই শোক, অন্তত এই বাড়িটির কাছে কোনও বিচ্ছেদ নয়, বরং পুনর্মিলন। শিব আগেই চলে গিয়েছেন কৈলাসে। গতকাল পার্বতী চলে গেলেন। বাংলা কবিতার নিবিষ্ট পাঠক অন্তত একবার যেন এই হতভাগ্য বাড়িটির কথা স্মরণ করেন– যে-ঘরে নবতিপর মণীন্দ্র গুপ্ত অসহ্য শারীরিক কষ্ট নিয়ে শেষ করেছেন অভিনব উপন্যাস, যে-ঘরে একা দেবারতি একদৃষ্টিতে জানলার বাইরে তাকিয়ে অসম্ভব অপেক্ষার পিপাসায় কাটিয়ে দিয়েছেন বিনিদ্র অবস্থায় রাতের-পর-রাত, যে-ঘরে মহাকাল প্রত্যক্ষ করেছে স্বামীর প্রয়াণে লিখে ওঠা একনিষ্ঠা স্ত্রীর অপ্রতিরোধ্য বাংলা কবিতার পঙক্তিসমূহ– এই সমস্ত ইতিহাসের স্ফুলিঙ্গ পড়ে রইল ওই ঘরে– একাকী, বান্ধবহীন; তাদের বিমূর্ত কান্নার ভাষা আর কেউ পড়তে পারবে না।
কিন্তু এত কাছে কীভাবে আসতে পারলাম দেবারতিদির? কীভাবে বুঝতে পারলাম, যে-মানুষের হৃদয়ে নক্ষত্রের জন্য বিরহ জন্মায়, তাঁর কাছে আর কোনও মানুষ পৌঁছতে পারে না? আমি যত ভেবেছি, বোধহয় তাঁর কাছে গিয়েছি, ততই চলে গিয়েছি আরও দূরে। বুঝেছি এ-সরোবরে ঢিল ছুড়ে তরঙ্গ উৎপাদন করা আমার কর্ম নয়। তবুও পতঙ্গ যেমন আগুনের দিকে ধাবিত হয়, আমিও তাঁর কাছে ছুটে গেছি প্রশ্নের উৎসাহে, কিছু জানার ইচ্ছায়। নীল আকাশের দিকে বিমনা হয়ে তাকিয়ে থাকা করুণ-যোগিনী আমাকে প্রতিহত করেছেন তাঁর নিস্পৃহতায়। তারপর ক্রমে-ক্রমে কখনও বা অন্যমনস্কতায় এই অবোধকে স্নেহের বশে বলে ফেলেছেন– ‘বেঁচে থাকা এত কষ্টের কেন বলো তো রাজু?’; রাজু কিছু উত্তর দিতে পারেনি সেইদিন। আমি নিশ্চিত, সে আজও এই শ্মশানের চৌকাঠে বসে এখনও তার উত্তর খুঁজে চলেছে। মাথা খুঁড়ে মরছে। কিন্তু কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছে না। গতকাল ছিল ১১ জানুয়ারি, মনে পড়ছে, এর ঠিক একবছর আগের বই প্রস্তুতির দিনগুলোর কথা। তখনও বুঝিনি, সেই বই বইমেলা নয়, এপ্রিলে আপনার জন্মদিনেও নয়; প্রকাশিত হবে জুলাই-অগাস্ট মাসের কোনও এক অখ্যাত, সাধারণ কর্মমুখর বর্ষার দিনে এবং শুধুমাত্র আপনার কারণেই সেই দিনটা আমাদের কাছে অলৌকিক পরব হয়ে থেকে যাবে চিরকাল। বইয়ের নাম ভেবেচিন্তে রাখা হল– ‘ফুল, পুতুল আর আগুন’; দেবারতি মিত্রের নির্বাচিত সাক্ষাৎকার এবং অগ্রন্থিত গদ্যের বই। ১২ এপ্রিল কী আনন্দই না-হয়েছিল ‘যোগিয়া বাড়ি’তে! বইয়ের ডামি-কপি দেখিয়ে নিচ্ছি দিদিকে। দিদির সেদিকে মন নেই। আমরা জানতে চাইছি তাঁর কাছে, ‘বইটা এভাবে আপনার ব্যক্তিগত জীবনসূত্রের বিভিন্ন ছবি, পাণ্ডুলিপি, এইসব দিয়ে যে-সাজিয়ে তুললাম, আপনার কেমন লাগছে? আরও কোনও সাক্ষাৎকারের কথা মনে পড়ছে আপনার?’ যত জিজ্ঞাসা করছি, ‘উনি বলছেন ভালোই তো, আমার আর কিছু মনে নেই! তোমরা যা-পারো করো। আচ্ছা, তোমরা জানো, আমার চার্জার খারাপ হয়ে গেছে? একা থাকি, কথা বলতে ইচ্ছে হয় খুব, এখন আমি কী করে কথা বলি বলো তো!’
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
নিজের কবিতাজীবন সম্পর্কে কী বলেছিলেন দেবারতিদি? ‘আমাকে যেতেই হবে স্থির পরিশ্রমের পথে– মত্ততা, উৎকেন্দ্রিকতা কিংবা নিজের ছককাটা আলোকসাধারণ কোর্টে নিজেরই খেলার বারবার পুনরাবৃত্তি আমার নয়। তাতে যদি কখনও অপ্রত্যাশিত সাফল্যও পাওয়া যায় তবুও নয়।…’ ভাবতে অবাক লাগে, নিজেকে নিয়ে এত কুণ্ঠিত, আত্মবিশ্বাসহীন মানুষটির ভেতরে-ভেতরে কী অসম্ভব প্রস্তুতি ছিল। স্থির পরিশ্রমের আহ্বান যিনি কবিতাজীবনের শুরুতেই পেয়ে যান, তাঁকে আর টলাতে পারে কে?
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আদতে ভুল মনে হয়েছিল আমাদের। তিনি অনেক আগেই এইসব ক্ষণকায় আনন্দকে অতিক্রম করে গেছেন। আমরাই দূর থেকে আত্মকেন্দ্রিকতায় তাঁর সেই নিস্পৃহতার মননবিশ্বে প্রবেশের চাবিকাঠি খুঁজে পাইনি। আমাদের আবদার– জন্মদিনে দেবারতিদি কবিতা পড়বেন। কোথা থেকে পড়লেন দিদি? ‘ও-ও-ও-ও’ থেকে। যে-বইয়ের প্রতিটি কবিতা মণীন্দ্র গুপ্তকে নিয়ে লেখা। নিজের জন্মদিনে, অচ্ছেদ্য প্রিয় মানুষটিকে এইভাবে ডাকা ছাড়া কীভাবে পূর্ণ হয়ে উঠত এই জন্মদিন? কবিতা পড়েছেন দেবারতিদি, গলা সামান্য কেঁপেছে, চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়েছে আবছায়া জল। সেই জল আমারা কেউ দেখতে পাইনি। সেদিনও পুরাণপ্রান্তর থেকে হাওয়া এসেছিল– উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল সেইসব জলের প্রতিবিম্বকে।
নিজের কবিতাজীবন সম্পর্কে কী বলেছিলেন দেবারতিদি? ‘আমাকে যেতেই হবে স্থির পরিশ্রমের পথে– মত্ততা, উৎকেন্দ্রিকতা কিংবা নিজের ছককাটা আলোকসাধারণ কোর্টে নিজেরই খেলার বারবার পুনরাবৃত্তি আমার নয়। তাতে যদি কখনও অপ্রত্যাশিত সাফল্যও পাওয়া যায় তবুও নয়।…’ ভাবতে অবাক লাগে, নিজেকে নিয়ে এত কুণ্ঠিত, আত্মবিশ্বাসহীন মানুষটির ভেতরে-ভেতরে কী অসম্ভব প্রস্তুতি ছিল। স্থির পরিশ্রমের আহ্বান যিনি কবিতাজীবনের শুরুতেই পেয়ে যান, তাঁকে আর টলাতে পারে কে? জনপ্রিয়তার আস্বাদ পেয়েও তাই তাকে তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছেন স্থির পরিশ্রমের একাগ্র আগুনে। এরপরে ‘মত্ততা’-র ঘোর বলতে কি দেবারতিদি নিজের প্রথম জীবনের জনপ্রিয়তাকেই কাউন্টার করতে চাইলেন? উৎকেন্দ্রিকতা কি ওই স্থির পরিশ্রমের বৃত্তের বাইরে চলে যাওয়ার ভয়? ছককাটা– শব্দটি লক্ষ করুক বাংলা কবিতার পাঠক। কেননা পাঠকের অদৃশ্য প্রত্যাশা অনেকসময় খাপ বসিয়ে ফেলে, দাগিয়ে দিতে চায়– এই হল কবিতা, এই নয়! এই ছকের ভেতরে, নিজের প্রথম জীবনের ‘আলোকসামান্য’ কোর্টেও নিজের সবচেয়ে নতুন খেলাটাই খেলতে চান দেবারতিদি। তাঁর কবিতা তাই অপ্রত্যাশিতের পরাগ-সংযোগ হয়ে থেকে যায় প্রায় যে কোনও ক্ষেত্রেই। সে কারণেই তিনি একাধিক উল্লেখযোগ্য পুরস্কার পেলেও ‘জনপ্রিয়’ কবি নন। বরং তিনি গ্রহণযোগ্য কবি। বাংলা ভাষা যতদিন বাঁচবে, ততদিন, দেবারতি মিত্রের কবিতা গ্রহণ করবেন পাঠক। অথচ এসব নিয়ে কথা বলতে গেলেই তাঁর তুমুল আপত্তি। আমাদের আধো-প্রশ্ন ও তাঁর অপার, অপাপবিদ্ধ মৌনতার মাঝখানে শুধু পাখা-ঘুরে যাওয়ার শব্দ– এইভাবেই কয়েকটি গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীত ও বসন্ত পেরিয়েছে, প্রস্তুত হয়েছে ‘ফুল, পুতুল আর আগুন’।
যে কোনও শ্মশানের ধারে চায়ের দোকান থাকে এবং সেখানে চমৎকার চায়ের সুস্বাদ জন্ম-জন্মান্তরের তেষ্টা মিটিয়ে দেয়। আমরা প্রত্যেকে সেই তেষ্টার সহযাত্রী। জন্ম জন্ম চা না-খাওয়ার বেদনা নিয়ে যিনি চলে যাচ্ছেন, আমাদের ঠোঁটে, চায়ের উত্তাপে, তাঁরই মৃতদেহ পুড়ছে। রাতের অজ্ঞাতে ইঁদুরে বিক্ষত করে দিয়ে গেছে শয্যাশায়ী আঙুল। সেই রক্তপাত, সেই আঙুলের শীর্ষ আজ তরুণ কবিদের পুনর্জন্মভূমি, তাদের ধৈর্যের পরীক্ষা। তবে মৃতদেহ মাত্র। আর সেই কবিমন তো কবেই মহাকালের নাভি হয়ে অভিসারে দিশাহারা হয়েছে প্রিয় মানুষের সঙ্গে– স্বেচ্ছায়। আমরা কেউ টের পাইনি, দপদপ করতে থাকা পরলোকের সঙ্গে পিপাসার্ত প্রণয় সৃষ্টি হয়েছে। তাকে নিঃশেষিত করবে এমন আগুন কোথায়? মনে পড়ল, দেবারতিদি নিজেই লিখেছিলেন– ‘কাল রাত্রে সাদা মেঘের স্রোতে-উল্টানো নৌকার মতো কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ ভেসে চলেছে দেখে মনে হল, সে হয়তো আমাকে কবিতার দেশে পৌঁছে দিতে পারে;…’। আমরা আজ যারা শোকজ্ঞাপন করছি, যারা শ্মশানের ছাই মেখে ভোলামন হয়ে বসে আছি চুল্লির পাশে, তারাও আসলে জানতে পারব না কোনও দিন– জীবনের ভার ঠিক কখন মৃত্যু এসে হালকা করে দিয়ে যায়।